‘রেইড’-এ অলোকবাবুর চরিত্রে অজয়।
সিনেমা জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আয়কর দফতরের এক কর্তা। নীতিনিষ্ঠ নির্ভীক ওই অফিসারকে বাগে আনতে পারছে না খোদ প্রধানমন্ত্রীর ফোনও। তিনি অময় পট্টনায়ক। বলিউড থ্রিলার ‘রেইড’-এর নায়ক। পর্দায় ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ওই চরিত্রকে দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, বাস্তবের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। কিন্তু শুনলে অবাক হতে হবে, রুপোলিপর্দার ওই চরিত্র কিন্তু বাস্তবেরই এক জাঁদরেল অফিসারের জীবনীভিত্তিক। এবং ঘটনাচক্রে তিনি এক জন বাঙালি। নাম অলোককুমার বটব্যাল।
উত্তর ভারতে একটা সময়ে কালো টাকার কারবারিদের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল এই অলোকবাবুর দাপটে। সেটা ১৯৮১ সাল। উত্তরপ্রদেশের কানপুর শহরে এক লোহা কারবারির বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছিলেন জাঁদরেল ওই আয়কর কর্তা। সেখানে এক কোটির বেশি নগদ টাকা ছাড়াও উদ্ধার হয়েছিল সোনার বাট-সহ প্রচুর গয়না। কালো টাকার বিরুদ্ধে অভিযানে আয়কর দফতরের এক অন্যতম বড় সাফল্য ছিল ওই ঘটনা। অলোকবাবু এবং তাঁর এই সব কীর্তির উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে বলিউড ব্লকবাস্টার ‘রেইড’। গত সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে সত্, নির্ভীক আয়কর অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অজয় দেবগন।
তাঁর জীবনের উপর ভিত্তি করেই যে সিনেমা তৈরি হয়েছে, তা আদৌ জানতেন না অলোকবাবু। পুরনো সহকর্মী আর বন্ধুদের কাছ থেকেই প্রথম শুনেছিলেন ‘রেইড’-এর কথা। কিন্তু, সাঁইত্রিশ বছর আগের সেই দিনের প্রতিটা মুহূর্ত এখনও স্পষ্ট ৮০ বছরের অলোকবাবুর স্মৃতিতে। বেঙ্গালুরু থেকে টেলিফোনে তিনি বলছিলেন, “সিনেমার মতোই ৮১ সালের সেপ্টেম্বরের ওই দিনটা শুরু হয়েছিল আসলে রাত থাকতেই। কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম ইন্দর সিংহের স্বরূপনগরের বাড়িতে। সেই সময় গোটা উত্তর ভারতের মধ্যে ইন্দর ছিলেন প্রথম সারির লোহা ব্যবসায়ী।” ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলেছিল তল্লাশি। আটটা দলে সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০ জন। নগদ টাকার সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল প্রচুর গয়না আর ৩০টি সোনার বাট। এক একখানা বাটের ওজন প্রায় সাড়ে তিন কেজি— টেলিফোনের ওপারে এ সবই গড়গড় করে বলছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: দিশাহীন রেইডে দর্শকদের হাতে শুধুই পেন্সিল
নিজের চরিত্রে অজয় দেবগনকে কেমন লাগল?
হাসির সঙ্গে জবাব এল, “আসল ঘটনার সঙ্গে ছবির অনেকটাই মিল রয়েছে। রয়েছে অতি নাটকীয়তাও! অনেক কিছুই বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।” ভাল থ্রিলার বানানোর জন্য পরিচালককে সিনেমাটোগ্রাফিক স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষে তিনি। আর সে কারণেই বললেন, ‘ছবিটা কিন্তু বেশ টানটান হয়েছে।’’ তবে একটা বিষয়ে তাঁর অভিযোগ রয়েছে পরিচালকের বিরুদ্ধে। সিনেমায় অজয় দেবগনকে মদ খাওয়ার পাশাপাশি সিগারেট খেতেও দেখা গিয়েছে। বৃদ্ধের অনুযোগ, “আমি জীবনে কখনও মদ-সিগারেট খাইনি জানেন! ওটা না দেখালেই ভাল হত।”
বাবা কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুবাদে অলোকবাবুর বড় হওয়াটা ইলাহাবাদে। এর পর ১৯৬৩তে ‘ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস’-এ উত্তরপ্রদেশ ক্যাডার হিসাবে কাজে যোগ দেন তিনি। ঘটনাচক্রে প্রথম পোস্টিংই ছিল কলকাতায়। এর পর কানপুরের ডেপুটি ডিরেক্টর (ইনটেলিজেন্স) পদে বদলি হওয়ার পর ছোটখাটো তল্লাশি আর মন মন ভরছিল না তাঁর। তাই শুরু হয়েছিল বড় অপারেশনের প্রস্তুতি। সেই সময়েই ওই ইন্দর সিংহের ঘটনা। তাঁকে কি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন ইন্দরের বাড়িতে তল্লাশির সময়? আবারও হাসি। হাসতে হাসতে বললেন, “আরে না না। ওগুলো সব রং চড়ানো। আমাকে সে দিন কোনও রাজনৈতিক চাপ সামলাতে হয়নি।” ইন্দর সিংহের বাড়িতে শুধু ওই এক দিনের অভিযানই শুধু নয়, ’৬৩ থেকে ’৯৮— গোটা কর্মজীবনে কোনও দিনই নাকি তাঁকে রাজনৈতিক চাপের মুখোমুখি হতে হয়নি।
বেঙ্গালুরুতে স্ত্রী মঞ্জুদেবীর সঙ্গে আলোককুমার বটব্যাল।—নিজস্ব চিত্র।
পর্দার অময়কে কোথাও থামতে হয়নি। তাঁকে কেউ থামাতে পারেনি। সর্বত্রই জয় এসেছে। তবে, বাস্তবের অময়কে ‘ডাকাতরানি’ ফুলনের ডেরা থেকে এক বার খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছিল। ‘রানি’র মারমুখী চেলাদের হাত থেকে কোনও মতে সে বার প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছিলেন কানপুরের সেই সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ আয়কর অফিসার অলোকবাবু। তাঁর কথায়, “কানপুর শহরের বাইরেই একটা গ্রাম আছে। নাম, মুসানগর। খবর পেলাম ফুলনের লুটের মালপত্র ওখানেই জমা করা হয়েছে। খবর পেয়েই দৌড়েছিলাম। কিন্তু, সফল হইনি। ফুলনের চেলাদের তাড়ায় সে বার পালাতে হয়েছিল।” তবে, কিছু দিন পর বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ফেন হানা দিয়েছিলেন ওই ডেরাতেই। উদ্ধার হয়েছিল প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকার গয়না!
লেখাপড়া, বড় হওয়ার পাশাপাশি অলোকবাবু বিয়েও করেছিলেন উত্তরপ্রদেশে। মঞ্জুদেবী এবং তাঁর দুই ছেলে। এক জন বেঙ্গালুরু, অন্য জন দুবাইতে থাকেন। তা-ও শিকড়ের টানে অবসরের পরেই অলোকবাবু ফিরে এসেছেন কলকাতায়। এই মুহূর্তে বেঙ্গালুরুতে ছেলের কাছে রয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, এখনও দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা কালো টাকা। বললেন, “আজও সমস্যাটা একই রয়ে গিয়েছে। এর সমাধানে আয়কর দফতরের মতো সংস্থাকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। না হলে এই কালো টাকার জাল থেকে মুক্তি মিলবে না।’’
পর্দায় অজয় যতই বিপ্লবের কথা বলুন না কেন, রিয়েল লাইফের অময় কিন্তু সব শেষে মেনে নিচ্ছেন, ‘‘সেই সময় থেকে এই সময়— সিস্টেমটা অপরিবর্তিতই রয়ে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy