এই দেখো, আমি তোমার থেকেও ছোট। শনিবার ইন্ডিয়া গেটের অনুষ্ঠানে এক স্কুলছাত্রীর সঙ্গে অমিতাভ বচ্চন। ছবি:পিটিআই।
দু’বছর আগে দেশের অবস্থা কী ছিল, আর এখন কী হয়েছে— দেশবাসীই সেটা মিলিয়ে দেখুন। মিলিয়ে দেখুন কেন্দ্রে আগের সরকার বেশি কাজ করেছে, না এই সরকার। তার পর ফারাক বুঝে সিদ্ধান্ত নিন। শনিবার ইন্ডিয়া গেটে সারাদিন ধরে চলা ‘মেগা শোয়ের’ সর্বশেষ বক্তা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যা বললেন, তার নির্যাস এটাই!
লোকসভা ভোটের স্লোগান ছিল ‘অচ্ছে দিন’। সেই শুভদিন যে রমরমিয়ে এসে গিয়েছে, গত কাল উত্তরপ্রদেশের সহারনপুরে তাঁর সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে মোদী নিজেও এ কথা বুক ঠুকে বলেননি। বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরের পিছিয়ে পড়া মানুষেরা কী ভাবে তাঁর আমলে উপকৃত হয়েছেন, খানিকটা ভোটমুখী মেজাজেই তার খতিয়ান দিয়েছিলেন।
আজ কিন্তু ভারতের টি-২০ স্কোয়াডের অধিনায়কের মতোই যথার্থ ‘ফিনিশারের’ ভূমিকা নিতে চাইলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অধিনায়ক।
তাঁর আগে? মেনকা গাঁধী থেকে উমা ভারতী বা স্মৃতি ইরানি। অরুণ জেটলি থেকে নিতিন গড়কড়ী। অমিতাভ বচ্চন থেকে বিদ্যা বালন। মেগা-শো-এর পর্বে পর্বে কখনও মোদীর বিশ্বস্ত বাহিনীর সদস্যরা, কখনও গ্ল্যামার জগৎ তুলে ধরল এনডিএ সরকারের একের পর এক মন্ত্রকের সাফল্যের ‘কেস স্টাডি’। অর্থমন্ত্রী জেটলি যেমন দাবি করলেন, গোটা বিশ্বে মন্দা সত্ত্বেও ভারতের অর্থনীতি সাড়ে সাত শতাংশ হারে এগিয়ে চলেছে। তার ওপর বাড়তি আশা দিচ্ছে পর্যাপ্ত বর্ষার পূর্বাভাস।
অমিতাভ বোঝালেন ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পের মাহাত্ম্য। এক খুদে স্কুলছাত্রী বলেছিল, ‘‘আপনি তো বিগ বি!’’ স্নেহশীল জেঠুর মতোই তাকে কাছে ডেকে সটান মাটিতে বসে পড়ে অমিতাভ বললেন, ‘‘এই দেখো, আমি তোমার চেয়ে ছোট হয়ে গেলাম!’’ অমিতাভের পাশাপাশিই মঞ্চে এসে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে গিয়েছেন বিদ্যা বালন, রবিনা ট্যান্ডন, কাজলেরা। ইন্ডিয়া গেট থেকে তা সরাসরি সারা দেশে পৌঁছে দিয়েছে দূরদর্শন।
পিচটা এ ভাবেই তৈরি ছিল। দিনভর মেঘালয় সফর সেরে দিল্লি ফিরেই সেই পিচে নেমে পড়লেন মোদী। আর সব মন্ত্রকের আলাদা আলাদা কাহিনির সুতোগুলো বাঁধতে বসলেন। বললেন, ‘‘সরকারের কাজকর্মের মূল্যায়ন নিশ্চয়ই হওয়া উচিত। কিন্তু দেখা যাক, আগে কী হয়েছিল।’’
কী হয়েছিল?
মোদীর বক্তব্য, ইউপিএ আমলে কয়লাখনি বণ্টন এমন ভাবে হয়েছিল যে, সেই প্রক্রিয়াই সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর সরকার যে ভাবে কয়লাখনি বণ্টন করেছে, তা নিয়ে এখনও প্রশ্ন ওঠেনি। উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ভর্তুকির টাকা পৌঁছে দিতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, লক্ষ লক্ষ ভুয়ো রেশন কার্ড রয়েছে। এক সময়ে সাংসদরা তাঁদের হাতে থাকা রান্নার গ্যাসের কুপন সাধারণ মানুষকে বিলি করে বড়াই করতেন। এখন সরকারের আহ্বানে ভর্তুকি ছেড়ে দিচ্ছেন অজস্র মানুষ। এর পাশাপাশি, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রেও দুর্নীতি কিছুটা রোখা গিয়েছে। এলইডি ল্যাম্পে বিদ্যুতের সাশ্রয় হয়। সরকার কম দামে এলইডি ল্যাম্প বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। এখানে সংবাদমাধ্যমকেও এক প্রস্ত খোঁচা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘৬০-৭০ টাকা দামের এলইডি ল্যাম্প নিয়ে খবর করার কথা কেউ ভাবে না। কী আর করা যাবে?’’
কী কী তাঁরা করেছেন, কী করতে চান— সেই যাবতীয় খবরাখবর সমাজের তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দিতে মোদী মন্ত্রিসভার ৩০ জন মন্ত্রী আগামী ১৫ দিন ধরে দেশের ২০০টি শহরে যাবেন। দলের সমস্ত সাংসদ ও বিধায়ককে নিজের নিজের কেন্দ্রে সাত দিন ধরে সময় কাটানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যমের বিজ্ঞাপনে। ‘অচ্ছে দিনের’ পর ইতিমধ্যেই নতুন স্লোগান বেছে নিয়েছে বিজেপি। দলের থেকে প্রচারে বলা হচ্ছে— ‘একটু হাসুন!’ বিজেপি মুখপাত্র সম্বিৎ পাত্রের ব্যাখ্যা, ‘‘অন্ধকারের দিন শেষ হয়ে নতুন সকাল আসছে। তাই দেশবাসীকে এ বার অন্তত হাসতে বলছি আমরা।’’
যদিও রাহুল গাঁধী আজই মোদী ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের বিরুদ্ধে দিল্লিতে মশাল মিছিল করেছেন। দিল্লির সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে রাহুল বলেন, ‘‘গোটা দেশ যখন খরার কবলে, তখন ইন্ডিয়া গেটে বলিউডি নাচ-গান চলছে। জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছে প্রচারে।’’ জেটলির যুক্তি খণ্ডন করতে দীর্ঘদিন পর কংগ্রেস আজ মাঠে নামায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে। ‘সততার আয়না’ নামে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে চিদম্বরম দাবি করেন, ‘‘গত দু’বছরে উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। অর্থনীতি বিপর্যস্ত। উৎপাদন কমেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অথচ সরকার নিজেদের ঢাক পেটাতে ব্যস্ত।’’
বিজেপি সূত্রের দাবি, মোদীকে আক্রমণ করে ঝাঁঝালো প্রতি-আক্রমণের পথটা আজ খুলে দিয়েছেন রাহুলই। তাতেই ইউপিএ জমানার সঙ্গে তুলনা টানার সুযোগ পেয়ে গেলেন মোদী। প্রধানমন্ত্রী সাফ বললেন, ‘‘তখন তো সংবাদপত্রে, আলোচনায় দুর্নীতি ছাড়া কোনও প্রসঙ্গই উঠত না।’’ ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। মনমোহন সিংহের আমলে একের পর এক দুর্নীতির কথা শুনতে শুনতে মানুষের বিরক্ত হয়ে যাওয়ার দিনগুলোর স্মৃতিই উস্কে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবং কৌশলী বার্তা দিয়েছেন, পুরনো অবস্থাটা বদলানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে। কাজ চলছে। কংগ্রেস বলছে, ‘‘দো সাল, দেশ কা বুরা হাল।’’
আর মোদী বলছেন, ‘‘লুঠ রুখেছি, গালি তো আমায় খেতেই হবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy