সনিয়া গাঁধীর স্বপ্নের ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের খোলনলচে বদলে দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী।
‘জব কার্ড’ দেখিয়ে আবেদন করলেই আর ঢালাও কাজ মিলবে না এই প্রকল্পে। সর্বত্র চলবেও না এই প্রকল্প। এ বার থেকে মূলত পিছিয়ে পড়া ব্লক এবং পিছিয়ে পড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেই অগ্রাধিকার পাবে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পটি। সেখানেও আবার সবার জন্য কাজের বরাত নয়, ‘প্রকৃত অর্থে’ যাঁদের কাজের প্রয়োজন, তাঁরাই আসবেন এই প্রকল্পের আওতায়। তবে তাঁরা যাতে বছরে ১০০ দিনই কাজ পান, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে সরকার।
মোদী সরকারের তৈরি রূপরেখা অনুযায়ী, শুধু মজুরি বিলি নয়, ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য হবে স্থায়ী সম্পদ তৈরি করা। নয়া চেহারায় এই প্রকল্প শুরু হবে আগামী বছর, অর্থাৎ ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে। তবে এর জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের যুগ্মসচিব আর সুব্রহ্মণ্যম ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের এই নয়া পরিকল্পনার কথা সোমবার সমস্ত রাজ্যকে জানিয়ে দিয়েছেন। বলে দেওয়া হয়েছে, নতুন নিয়মে যাঁরা এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার যোগ্য, আগামী অগস্ট মাস থেকেই তাঁদের তালিকা তৈরিতে নামতে হবে রাজ্যকে।
মন্ত্রক সূত্রের খবর, এখন প্রচলিত নিয়ম অনুসারে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত নন, এমন যে কেউ ‘জব কার্ড’ পাওয়ার আবেদন করতে পারেন। তিনি পঞ্চায়েতে আবেদন করলে সরকার ১৫ দিনের মধ্যে তাঁকে কাজ দিতে বাধ্য। কাজ না পেলে বেকার ভাতা পাওয়ার কথা আবেদনকারীর। কিন্তু এই কার্ড বিলি এবং কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে। কাজ-প্রাপকদের নামের তালিকা (মাস্টার রোল)-য় প্রচুর ভুয়ো নাম ঢোকানো হয় বলে অভিযোগ। অনেক সময় কার্ডধারী নিজে কাজে না গিয়ে তাঁর ‘জব কার্ড’টি অন্যকে ভাড়া দেন, এমন অভিযোগও নতুন নয়। কেবল তা-ই নয়, যে টাকায় যতখানি কাজ হওয়ার কথা, বাস্তবে হয় তার চেয়ে অনেক কম। গোটা কর্মকাণ্ডই চলে কার্যত শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্বের তত্ত্বাবধানে।
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী যে নতুন নীতিমালা রাজ্যগুলিকে পাঠিয়েছেন, তাতে এর উল্টো পথে হাঁটার কথাই বলা হয়েছে। এখন থেকে আর সব ব্লকে নয়, গোটা দেশে ৬৫৭৬টি ব্লকের মধ্যে পিছিয়ে পড়া ২৫০০টি ব্লকেই ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পটি অগ্রাধিকার পাবে। ব্লকগুলি অবশ্য বাছবে সংশ্লিষ্ট রাজ্যই। পশ্চিমবঙ্গের ৩৪১টি ব্লকের মধ্যে কেন্দ্র ইতিমধ্যেই ১২৪টি ব্লককে পিছিয়ে পড়া বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু কোন কোন ব্লক এই তালিকায় আসবে, তা রাজ্যই ঠিক করবে।
বাড়ি বাড়ি ঘুরে সম্ভাব্য কাজ-প্রাপকদের তালিকা তৈরি করতে বলেছে মন্ত্রক। তফসিলি জাতি, উপজাতি, বিপিএল-সহ কাদের এ কাজে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তা-ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের মাপকাঠি মেনে চিহ্নিত পরিবারগুলির বাইরে অন্য কেউ কাজ পেতে চাইলে তার আবেদন গ্রামসভায় বিবেচনার জন্য পেশ করতে হবে। গ্রামসভা মঞ্জুর করলে তবেই কাজ প্রাপকের তালিকায় নাম উঠবে।
মন্ত্রকের নির্দেশ, পঞ্চায়েত স্তরে অন্তত ১০ জনের দল গড়ে বাড়ি বাড়ি সমীক্ষা করিয়ে কাজ প্রাপকদের তালিকা তৈরি করতে হবে রাজ্যকে। সেই সঙ্গে যোজনা কমিশনের ঠিক করে দেওয়া পদ্ধতি মেনে বাছাই করতে হবে পিছিয়ে পড়া ব্লক। মূলত কোনও ব্লকে কৃষি কাজে নির্ভরতা, মহিলাদের সাক্ষরতার হার, পানীয় জল, শৌচালয়, বিদ্যুৎহীন বাড়ি এবং ব্যাঙ্কের শাখা থেকে দূরত্ব সেই সব দেখেই পিছিয়ে পড়া ব্লক চিহ্নিত করবে রাজ্য। নতুন নিয়মে মজুরি মিটিয়েই দায় সেরে ফেললে চলবে না। তার বিনিময়ে স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে বলে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন গডকড়ী।
কেন্দ্র স্পষ্ট জানিয়েছে, এই প্রকল্পে যে টাকা বরাদ্দ হবে, তার ৬০% সামাজিক সম্পদ তৈরিতে কাজে লাগাতে হবে। বাকি ৪০% টাকায় প্রশাসনিক খরচ এবং দক্ষ, আধা-দক্ষ শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া যাবে। পাশাপাশি, এখন থেকে চাইলেই আর যে কোনও সরকারি দফতর ১০০ দিনের কাজ করাতে পারবে না। নরেন্দ্র মোদী চান, কেবল কৃষি ক্ষেত্রের উন্নয়নেই এই প্রকল্পের কাজ হোক। তার জন্য জমি উন্নয়ন, জলাশয় তৈরি এবং ক্যানাল, বাঁধ, জাতীয় ও রাজ্য সড়কের ধারে গাছ লাগাতে উদ্যোগী হতে বলা হয়েছে।
নতুন সরকারের নয়া নিয়মে অবশ্য বিরক্ত রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, “রাজ্যের ২১৭টি ব্লকে আগামী বছর থেকে ১০০ দিনের কাজ কার্যত হবে না। এই কাজে প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা পাওয়া যায়। কেন্দ্র যা করছে, তাতে প্রকল্পের উদ্দেশ্যটাই বদলে যাচ্ছে। আমরা এর বিরোধিতা করব।” কিন্তু এই প্রকল্প নিয়ে যে বিস্তর অভিযোগ? সূব্রতবাবুর দাবি, এ রাজ্যে ১০০ দিনের প্রকল্পে অনিয়ম হয় না। তা ছাড়া, কাজ ঠিক হয়েছে কি না, গ্রামের মানুষকে দিয়েই তা দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। তার উপরে, কেবল এই প্রকল্পের হিসাব দেখার জন্য প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে এক জন করে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিয়োগ করার কথাও বলা হয়েছিল।
ক্ষোভ জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও। তিনি বলেন, “ইউপিএ আমলের সব চেয়ে জনপ্রিয় প্রকল্পটি শেষ করে দিচ্ছে বিজেপি। এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে গ্রামের গরিব মানুষ খাবে কী করে?” যদিও এই তত্ত্ব মানতে চাননি বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “১০০ দিনের কাজে পুকুর চুরি হচ্ছিল। সিএজি রিপোর্টেও সে কথা বলা হয়েছে। মোদী সরকার এখন প্রকৃত কাজ প্রাপকদের কাজ দেবে। কংগ্রেস এবং তৃণমূল কর্মীদের হাতখরচের টাকা তোলার দিন শেষ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy