দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামার কিছু দিন পরে বারাসতের মতো এক ছোট্ট জায়গাও কেঁপে উঠেছিল একটি ঘটনায়। সেই সময় নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধ বন্দিদের নিয়ে একটি ট্রেন এসে থেমেছিল বারাসত স্টেশনে। অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণে ঘেরা নেতাজির মৃত্যু সংবাদ তখন চার দিকে।
অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটা সময়ে বারাসতে থাকতেন। তাঁর আত্মজৈবনিক নাটক ‘তৃতীয় অঙ্ক, অতএব’-এর একটি অংশ, বারাসতবাসের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, সেই দিন ভাই সম্বিতকে নিয়ে ওই বন্দিদের দেখতে গিয়েছিলেন সৌমিত্র। সশস্ত্র মিলিটারি পাহারায় ঘেরা বন্দিদের দেখার জন্যে সেখানে তখন অসংখ্য মানুষের ঢল। ওই বন্দিদের নাকি নীলগঞ্জ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে এক সময় বিপ্লবীদের কারাবাসে রাখা হত।
‘এক সময় তাঁদের ট্রেন থেকে নেমে লাইনের পাশে দাঁড়ানোর হুকুম হল। মিলিটারি লরি এসে নাকি তাঁদের নিয়ে যাবে। কিন্তু বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়, লরি আর আসে না। কাঠফাটা রোদ্দুরে লাইনের এক দিকে তাঁরা অন্য দিকে শহরবাসীরা। একটা সময়ে বৃটিশ প্রহরীরা তৃষ্ণার্ত বন্দিদের দর্শনার্থীদের কাছ থেকে জল চেয়ে খেতে অনুমতি দিল। জল চাইতেই ছেলে বুড়ো জোয়ানের দল তাঁদের জন্যে জল নিয়ে ছুটে এলো।
‘আমি আর সম্বিতও তাই করলাম। এক জন শিখ বন্দি আমাদের দেওয়া জল খেয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, “কৌন জাত হো বেটা?” কী জানি কেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “Indian”। তাই শুনে লোকটা আমাকে কোলে তুলে আকাশে ছুড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল— “সাবাস বেটা সাবাস! বোলো জয় হিন্দ।”
এই কথা চল্লিশ দশকের। নেতাজির অলক্ষ্য প্রচ্ছায়া তখন আকাশে বাতাসে। বদলে গিয়েছে পৃথিবী, বদলে গিয়েছে আমাদের চিন্তা চেতনার জগৎ। বছর কয়েক আগে দিল্লিতে সেনাবাহিনীর এক জওয়ানের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি বেশ শিক্ষিত। আমার সঙ্গে শুদ্ধ ইংরেজিতেই কথা বলছিলেন। আমি তাঁকে নেতাজির কথা বলাতে, তিনি কেমন অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি জানেন না নেতাজিকে। তাঁদের পাঠ্যগ্রন্থে পড়ানো হয়নি কোনও সুভাষচন্দ্র বসুর গৌরবগাথা, হলেও তাঁর মনে নেই।
অথচ পড়শি দেশের এক অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ পেলাম অতি সম্প্রতি। সময় ১৯৬৯। পটভূমি গণ অভ্যুত্থানকালীন পূর্ব পাকিস্তান। লেখকের নাম উমা বসু। তাঁর স্বামী ভোলানাথ বসু খুলনার বাগেরহাটের এক জন সফল ব্যবসায়ী। খুলনার জজ কোর্টে সামরিক আদালতে তাঁকে হাজিরা দিতে হবে। তিনি যে দেশের শত্রু নন, তার প্রমাণ দিতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলো মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়েছে। তখন ওখানকার অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, বহু সাধারণ মানুষ তার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন ওই রকম মিথ্যে মামলার জালে জড়িয়ে। ভোলানাথবাবু চলে যাওয়ার পরে নানা আশঙ্কায় যখন শ্রীমতী বসু কালাতিপাত করছেন, এমন সময়কার একটি বিবরণ তাঁর ভাষাতেই উদ্ধৃত করছি—
‘দুপুর তখন ক’টা বাজে, বারোটা বা একটা। হঠাৎ নীচতলায় তাঁর গলার আওয়াজ পেয়ে কেটে গেল আচ্ছন্ন ভাবটা। কী হল— এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন? লাফিয়ে উঠে নীচে নামলাম। হাসিমুখে বারান্দার চেয়ারে বসলেন। উনি হাসছেন, হা হা শব্দে হাসছেন। পাগল হয়ে গেল নাকি লোকটা! হাসিই যে থামছে না। ছেলেমেয়ে দুটোকে জিজ্ঞেস করলাম— কী হয়েছে? কথা বলছিস না কেন? ওরাও কিছু জানে না। সারা রাস্তা তাদের তিনি কিছুই বলেননি। স্বাভাবিক হলেন তিনি। যে ঘটনা বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনের ইতিহাসে কোনও ‘দেশের শত্রু’ অর্থাৎ সংখ্যালঘু হিন্দুদের জন্য অন্য আর একটিও এমন ঘটনা ঘটেছিল কি না, ইতিহাসই বলতে পারে।
‘প্রথম মামলাতেই ডাক পড়ল তাঁর... অবাঙালি মেজর ইশারায় বসতে বলে উর্দুতে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘আপনার নাম কী?’ তিনি আত্মস্থ হওয়ার সময়টুকুও পাননি। তবু ধীর স্থির ভাবে নিজের নাম বললেন— ‘ভোলানাথ বোস।’ মেজর যেন চমকে গেলেন। তিনি আবার বললেন— ‘বোস? সুভাষ বোস নেতাজি, সেই বোস?’ উনি বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন— ‘হ্যাঁ, আমি সেই বোস।’ বিচারক তাঁর কাগজপত্র দেখতে চাননি, আর একটাও প্রশ্ন করেননি। কোমল স্বরে তাঁকে বললেন— ‘আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যান।’ মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ষড়যন্ত্র, অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তি ঘটেছে। ঘটনাটা ঘটতে পাঁচ মিনিটও লাগেনি। নেতাজি সুভাষ বসুর দেশপ্রেম, ভারতীয় জাতীয়তাবোধ হয়তো মুগ্ধ করেছিল পাকিস্তানি সেনা বিভাগের মেজরকে। নেতাজি নিরুদ্দেশ। তিনি ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, দেশভাগ চাননি। এই মেজর হয়তো দেশভাগ চাননি।’ (বিপন্নকালের ভেলা, উমা বসু, পৃষ্ঠা ৬৭-৬৯, গাঙচিল, কলকাতা)
এমন সব চিত্তাকর্ষক মিথ যাঁকে ঘিরে, অচিরেই যে তিনি নানা মিথ্যের মায়াজালে আটকে যাবেন তাতে আর সন্দেহ কী! কার্যত হয়েছেও তাই। এক দিকে রাজনৈতিক টানাপড়েন, দলতন্ত্র, অন্য দিকে ভক্তিরসাসৃত ধর্মীয় বাতাবরণে নেতাজি হয়ে থাকলেন ফুলের মালা আর ধূপের ধোঁয়ার কুহকে আটকে। বস্তুত সেই কুহকজালে পড়েছে নানা মিথ্যের প্রলেপ, গায়ে কাঁটা দেয়া বহু আখ্যানের জন্ম হয়েছে এই ভাবেই।
তাঁর জীবনালেখ্য নিয়ে সত্যিকারের গবেষণাধর্মী নাটক বা সিনেমাও পেলাম না আমরা। অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগই মুখরোচক গল্পের রোমহর্ষক বিবরণ মাত্র। অনেক আশা নিয়ে শ্যাম বেনেগালের ছবি দেখেছিলাম। তিনি যেন অতি সাবধানে বিতর্কের লক্ষণরেখা মেনে এক জন বীরের জয়গাথা রচনা করলেন কেবল। আমরা পেলাম না ব্যতিক্রমী পরিচালকের কোনও আত্মজিজ্ঞাসা, সৃজনশীল অভিব্যক্তি। অতি প্রচারিত গল্পের ছক মেনে তিনি আমাদের উপহার দিলেন অতি সাধারণ মানের এক ছবি।
সম্প্রতি আরও দু’টি ছবি তৈরি হওয়ার কথা জানা গেল। একটি করবেন এক সময়কার দিকপাল অভিনেতা বিশ্বজিৎ, অন্যটির পরিচালক অম্লানকুসুম ঘোষ। বিশ্বজিতের ছবিতে নাকি একটি গান গাইবেন লতা মঙ্গেশকর। সে ছবির প্রচারের প্রধান হাতিয়ার এই তথ্য, নেতাজি নয়। অন্য ছবিটির নাম ‘সন্ন্যাসী দেশনায়ক’। এই ছবিতে নাকি উত্তর ভারতের বিভিন্ন গোপন আস্তানায় এবং ভারত সীমান্তে এক গুমনামি সন্ন্যাসীর সাধন জীবনের কাহিনিই ফুটে উঠবে এই প্রজন্মের কিছু তরুণ-তরুণীর ভাবনাচিন্তার মধ্য দিয়ে। অভিনয় করবেন ভিক্টর, শাশ্বতের মতো তারকারা। দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গীতায়োজনে গান গাইবেন নাকি শুভা মুদগল, অজয় চক্রবর্তী। এই দু’টি ছবি নিয়েও আমাদের প্রত্যাশা আর কিইবা হতে পারে! দেশপ্রেমের কান্নাভেজা আর কত দেখব!
মিথ ও মিথ্যের মায়াজাল ছিন্ন না করলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে যাবেন চিরকালের অধরা, এই আপ্তবাক্যটুকুর মর্মবাণী কবে বুঝবেন আমাদের ছবি করিয়েরা! আখ্যান নির্মাতারা! প্রশ্ন সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy