Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মোদীর চালে বেহাত হচ্ছে ভারত ছাড়ো!

১৯৪২-এ গাঁধী ব্রিটিশদের ভারত-ছাড়া করার সঙ্কল্প নিয়েছিলেন। ২০১৭-য় সংসদে দাঁড়িয়ে মোদী ‘সঙ্কল্প’ নেবেন আবর্জনা, দারিদ্র, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে ভারত ছাড়া করার।

নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।

নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৭ ০৪:১৪
Share: Save:

স্বচ্ছ ভারতের লোগোতে নিয়েছেন চশমাটি। সাবরমতী আশ্রমে গেলেই বসেন চরকায় সুতো কাটতে। চম্পারণ সত্যাগ্রহের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করেছেন গত এপ্রিলে। এ বার ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ৭৫তম বর্ষ উদ্‌যাপনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নরেন্দ্র মোদী।

যেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে পুরোপুরিই কংগ্রেসের থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছেন তিনি। অন্তত ‘ভারত ছাড়ো’ নিয়ে তাঁর উৎসাহ ও আয়োজনের বহর দেখে এমনটাই মনে করছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সৌম্যজিত রায়।

১৯৪২-এ গাঁধী ব্রিটিশদের ভারত-ছাড়া করার সঙ্কল্প নিয়েছিলেন। ২০১৭-য় সংসদে দাঁড়িয়ে মোদী ‘সঙ্কল্প’ নেবেন আবর্জনা, দারিদ্র, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে ভারত ছাড়া করার। এর জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশন বসবে আগামিকাল। সেখানে ‘সঙ্কল্প’ পাঠ করাবেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। যার ‘সিদ্ধি’ হবে ২০২২-এ, দেশের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে। অর্থাৎ দ্বিতীয় দফায় জিতে তিনি যে ২০২২-এও প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, সুকৌশলে মানুষের মনে সে কথাও গেঁথে দিতে চান মোদী। সৌম্যজিতবাবুর বিশ্লেষণ, ‘‘এটা শুধু জাতীয়তাবাদ বা স্রেফ রাজনৈতিক চাল নয়, নির্বাচনী কৌশলও। এখনকার কংগ্রেস বস্তুত ইন্দিরা গাঁধীর তৈরি। মোদী গাঁধীজির কংগ্রেস থেকে আজকের কংগ্রেসের নেতাদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে চান। কিন্তু গাঁধীজিই কংগ্রেসের প্রধান আইকন। তাঁকে নিয়ে নিলে কংগ্রেস একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়বে।’’

আরও পড়ুন: দিনভর নাটক শেষে জয় হল পটেলরই

স্বাধীনতার পরে গাঁধী নিজেই কংগ্রেসকে ভেঙে দিতে বলেছিলেন। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বারেবারেই মনে করিয়ে দেন কথাটা। জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা এবং কংগ্রেসের থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও তার ‘আইকন’-দের ছিনিয়ে নেওয়া— মোদীর এই কৌশলে জেরবার কংগ্রেসকে এখন পাল্টা কৌশল খুঁজতে হচ্ছে। ১৯৪২-এর ৮ অগস্ট কংগ্রেসের বম্বে অধিবেশনে গাঁধীজি ‘ভারত ছাড়ো’ ডাক দিয়েছিলেন। ঠিক সেই দিনেই, আজ ডাকা হয়েছিল কংগ্রেস কর্মসমিতির বৈঠক।

সনিয়া গাঁধী সেখানে বলেন, ‘‘দেশে সংখ্যালঘু দলিত, মহিলা ও আদিবাসীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিদিন মানুষের স্বাধীনতায় হাত পড়ছে। যে সব সমাজবিরোধীরা তা করছে, তাদেরই হাত শক্ত করছে বহুত্ববাদ-বিরোধী মোদী সরকার।’’ একটি প্রস্তাবও নেওয়া হয় বৈঠকে। যার বক্তব্য, দেশবাসী ও দেশের প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীনতা রক্ষায় কংগ্রেস রুখে দাঁড়াবে।

কংগ্রেস বলছে, মোদী যতই ভারত ছাড়োর ৭৫তম বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন করুন, বাস্তব হল, আরএসএস ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশই নেয়নি। আরএসএস বা হিন্দু মহাসভা, কেউই তাতে অংশ নেয়নি। ইতিহাসবিদ তথা তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু বলেন, ‘‘এম এস গোলওয়ালকরের মতো সঙ্ঘের শীর্ষনেতারাই তাঁদের সংগঠনকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন।’’ সেই ভারত ছাড়োকে মোদী এখন ‘ইভেন্ট’ করে তোলার অর্থ কি এই যে, আরএসএস এখন ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছে? মানতে নারাজ সঙ্ঘ নেতৃত্ব। তাঁদের যুক্তি, আরএসএস ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেয়নি ঠিকই, কিন্তু এর বিরোধিতাও করেনি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আরএসএস-এর কাজ চরিত্র গঠন। তাই এই ধরনের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথাও ছিল না। তবে কর্মীদের বলা হয়েছিল, তাঁরা ব্যক্তিগত ভাবে আন্দোলনে অংশ নিতেই পারেন। সুগতবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘আসলে এত বড় আন্দোলনে যোগ না দেওয়া নিয়ে আরএসএস প্রচারকরা দোটানায় ছিলেন।’’

মোদী যে শুধু কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলেছেন, তা নয়। ভারত ছাড়োর ৭৫ বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপনের পরিকল্পনায় কংগ্রেস ও বামেদের মধ্যেও ফাটল ধরিয়েছেন। বামেরাও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেয়নি। ফলে ‘ভারত ছাড়ো’-র ঐতিহ্য ‘হাইজ্যাক’ করার প্রশ্নে মোদীর বিরুদ্ধে বামেদেরও পাশে নিতে পারছে না কংগ্রেস। উল্টে কমিউনিস্টদের দিকে আঙুল তুলে সঙ্ঘ-বিজেপি বলছে, বামপন্থী ইতিহাসবিদেরা দেখাতে চান, স্বাধীনতা সংগ্রামে সঙ্ঘ অংশ নেয়নি। বাস্তব হল, কমিউনিস্টরাই ভারত ছাড়োর বিরোধিতা করেছিল।

সিপিএমের নীলোৎপল বসুর যুক্তি, ‘‘কমিউনিস্টদের মত ছিল, ফ্যাসিবাদী শক্তি হিটলারের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের লড়াইয়ের কথাও ভাবা দরকার। কিন্তু কমিউনিস্টরা যে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, ব্রিটিশদের রেকর্ডেই তা রয়েছে।’’ সীতারাম ইয়েচুরি নিজেই সংসদে যুক্তি দিয়েছিলেন, কানপুর, জামশেদপুর, আমদাবাদে কারখানায় ধর্মঘটের পর দিল্লি থেকেই লন্ডনে পাঠানো বার্তায় সিপিআই সদস্যদের অংশ নেওয়া কথা উল্লেখ করে তাদের ‘ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সুগতবাবুর অভিযোগ, ‘‘কমিউনিস্টরা ভারত ছাড়োর বিরোধিতা শুধু নয়, ব্রিটিশদের সাহায্যও করেছিল।’’

ইতিহাসের এই চুলচেরা বিচারে মোদী ঢুকছেনই না। গাঁধীর মতো তিনিও গুজরাতের সন্তান। যেন সেই অধিকারেই কংগ্রেসের মুঠো থেকে বার করে এনে গাঁধীকে আপন করে নেওয়ার পথে এগোচ্ছেন তিনি।

৯ অগস্ট কার্যত তারই সঙ্কল্প।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE