শতবর্ষে পা দেওয়া শিলংয়ের ঐতিহ্যশালী সেন্ট এডমন্ডস স্কুল নেতাজির শিলং ভ্রমণ ও স্কুলের প্রেক্ষাগৃহে ভাষণ দেওয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে স্মৃতিফলক তৈরি করছে। ওই ফলকে থাকবে সি ভি রমন ও অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তির স্কুলে পদার্পণের কথাও।
১৯২৭, ১৯২৯ ও ১৯৩৮ সালে শিলংয়ে এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। প্রথম বার বার্মার মান্দালয় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বাবা-মা, মেজদা শরৎচন্দ্র বসু, তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ সপরিবার শিলং এসেছিলেন নেতাজি। নেতাজির শিলং সফর নিয়ে গবেষণা চালানো মালবিকা বিশারদ জানান, সে বার অকল্যান্ডের ‘কেলসাল লজ’ ভাড়া করে ছিলেন তাঁরা। তা এখন বিএসএনএলের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের আবাস। ১৯২৭ সালে দু’বার শিলং আসেন নেতাজি। পরের বার আসেন ১৯২৯ সালে। সে বার ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়িতে। এর পর ১৯৩৮ সালেও দু’বার শিলং আসেন নেতাজি। ছিলেন ‘অ্যাসলি হল’-এ। তা এখন অতিথিশালা। ১৯৩৮ সালে গোপীনাথ বরদলৈয়ের নেতৃত্বে অসমে কংগ্রেসের ‘কোয়ালিসন প্রভিনসিয়াল’ সরকার গড়ার জন্য এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র। তিনি তখন জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। ১৯৩৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ‘কোয়ালিসন প্রভিনসিয়াল’ সরকার গঠিত হয়। তখন শিলংই ছিল অসমের রাজধানী। ২০ সেপ্টেম্বর ওই সরকার শপথ নেয়। ওই দিনই শ্রীহট্ট রওনা দেন নেতাজি। পরের মাসে ফের তিনি শিলংয়ে আসেন। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি শিলংয়ের অপেরা হল, জেল রোড, পোলো, খাসি ন্যাশনাল দরবার, লেডি কেনি স্কুল, লাবান হরিসভায় ভাষণ দেন তিনি। দেখা করেন নামকরা খাসি ও অসমীয়া নেতাদের সঙ্গে। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর আইরিশ ব্রাদার্স-এর আহ্বানে নেতাজি সেন্ট এডমন্ড কলেজের (তখন সে নামেই পরিচিত ছিল) কেমব্রিজ সেকশন হল-এ ভাষণ দেন। ১৮৯৪ সালে অসমে আসা আইরিশ মিশনারি এডমন্ড বেকারের স্বপ্ন ছিল এখানে একটি আদর্শ বোর্ডিং স্কুল গড়ে তোলা হবে। অসমের চিফ কমিশনার স্যার আর্কডেল আর্ল সেই ইচ্ছায় ইন্ধন জোগান। ১৯১৩ সালে ব্রাদার স্ট্যানিসলাস ও'ব্রায়েন উপযুক্ত জমির সন্ধানে শিলং আসেন। ২৪ একরের একটি পাইন বন সরকারের তরফে মিশনারিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ও’ব্রায়েন প্রায় একার হাতে দেড় বছরে স্কুলের ভবন তৈরি করেন। স্কুলের বর্তমান প্রিন্সিপাল ব্রাদার সোলেমন মরিস জানান, ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনটি ছাত্র সেন্ট এডমন্ড স্কুলে ভর্তি হয়। অবশ্য স্যার আর্ল আনুষ্ঠানিক ভাবে স্কুলের উদ্বোধন করেন ওই বছর ৬ অক্টোবর। ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্কুলের বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগ তৈরি হয়। সকলে তখন সেন্ট এডমন্ড কলেজই বলত। এখন অবশ্য দু’টি শাখা পৃথক।
নেতাজির ভাষণের সময় স্কুল শাখার প্রধান ছিলেন জে এম ম্যাক গি। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রধান ছিলের ব্রাদার ও লিয়ারি। অমৃতবাজার পত্রিকায় পরে কেমব্রিজ হলের ভাষণের বিশদ সংবাদ প্রকাশিত হয়। নেতাজি ওই ভাষণে কংগ্রেসের উদ্দেশ্য, অসমে নতুন সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘দেশের সামাজিক ও শিল্পক্ষেত্রের বিভিন্ন সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা কংগ্রেসের লক্ষ্য নয়। দেশ গড়তে অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিস্বাধীনতাও জরুরি।’’ অসমের সম্পদগুলির পরিকল্পিত ব্যবহারের উপরেও জোর দেন তিনি। উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমাজ-সংস্কৃতির মধ্যে ঐক্য স্থাপনের লক্ষ্যেও সওয়াল করেন নেতাজি। যে বন্যার সমস্যা বর্তমান অসমকে জেরবার করছে, ৭৮ বছর আগের ভাষণে নেতাজি সেই সমস্যা দূর করতে কর্মসূচি নেওয়া ও সেচব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলেছিলেন। অমৃতবাজারের প্রতিবেদনে নেতাজিকে ‘রাষ্ট্রপতি বোস’ বলে সম্বোধন করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদন সযত্নে রেখেছেন বর্তমান অধ্যক্ষ মরিস। কারণ, কেমব্রিজ হলের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের আর কোনও নথি বা ছবি স্কুলের হাতে নেই।
ইউডিপির সভাপতি তথা শিলংয়ের বিধায়ক পল লিংডোর মতে, নেতাজির স্মৃতি সজীব রাখার দায়িত্ব সকলকে নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। এত বড় দেশনায়কের ঐতিহাসিক সফর ও ভাষণগুলির কথাও মানুষ ভুলে গিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy