ছি ছি এত্তা জঞ্জাল! তা-ও কি না নিজের বাড়িতে!
৭ রেস কোর্সের ফটক দিয়ে লরি বেরোচ্ছে তো বেরোচ্ছেই। পুরনো ফাইল, বাতিল কাগজপত্র, খারাপ হয়ে যাওয়া কম্পিউটার, ফ্যাক্স মেশিন-সহ নানা যন্ত্রপাতি, পুরনো আসবাব— কিছু আর বাকি নেই। দেখতে দেখতে জঞ্জাল বোঝাই করে পাক্কা এক ডজন লরি। আর সেগুলো বেরোল যাঁর সরকারি বাসভবন থেকে, তিনি দেশে-বিদেশে তোলপাড় ফেলে দেওয়া ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের প্রাণপুরুষ— খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী!
গোটা দেশকে আবর্জনামুক্ত, ঝকঝকে-তকতকে করে তুলতে গত বছর গাঁধী জয়ন্তীতে ঝাঁটা হাতে নেমে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন মোদী। ইতিমধ্যেই নিজের লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীকে জঞ্জালমুক্ত করার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। সাফাই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন সেখানেও। কিন্তু নিজের ঘরেই যে এই পরিমাণ জঞ্জাল জমে ছিল, তা সম্ভবত দিল্লির এই প্রসিদ্ধ ঠিকানার বাসিন্দা হওয়ার পর প্রথম দিকে টেরই পাননি মোদী। আর যখন পেলেন, তখন বরাবরের মতোই সিদ্ধান্ত নিতে কোনও সময় নিলেন না।
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের ঠিকানা ৭ নম্বর রেস কোর্স রোড হলেও আসলে ওই ১২ একর এলাকায় পাঁচটি বাংলো রয়েছে। একটিতে প্রধানমন্ত্রী থাকেন। অন্যগুলির কোনওটিতে অতিথিশালা, কোনওটি এসপিজি-র অফিস। সূত্রের খবর, এইসব বাংলোর আনাচে-কানাচে তো বটেই, একটি গুদামেও পুরনো জিনিসপত্র ঠাসা ছিল। সম্প্রতি মোদী ব্যাপারটা খেয়াল করেন। এমনকী নিজেই গুদামের হাল দেখতে চলে আসেন। এবং সব দেখেশুনে নির্দেশ দেন, যত দ্রুত সম্ভব দূর করতে হবে জঞ্জাল।
কবে থেকে জমছে এই আবর্জনা?
ইতিহাস বলছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীব গাঁধী প্রথম ৭ রেস কোর্সে থাকতে এসেছিলেন। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের আমলে এটি পাকাপাকি ভাবে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন হয়। তার আগে প্রধানমন্ত্রীরা সাংসদ হিসেবে যে বাংলো পেতেন, সেটিই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাংলো হয়ে যেত। বোঝাই যাচ্ছে, দস্তাবেজ জমতে শুরু করেছে সেই আটের দশক থেকে। কিন্তু যে সব যন্ত্রপাতি বা কাগজপত্রের প্রয়োজন ফুরোয়, সেগুলো নিয়মিত ফেলে দেওয়া হয় না কেন?
সরকারি কর্তাদের বক্তব্য, এটা শুধু প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বা দফতরের সমস্যা নয়। সরকারের যে কোনও মন্ত্রকে এই এক ব্যাপার। প্রায় সব কাগজেরই ফটোকপি করে রাখা হয়। তার পর তা ফাইলে ঢুকে যায়। এমন ফাইলের পর ফাইল জমতে থাকে। কোনও আমলাই অপ্রয়োজনীয় ফাইল ফেলে দিতে উদ্যোগী হন না। সরকারি যন্ত্রপাতি খারাপ হয়ে গেলেও তা ফেলে দিতে গেলে হাজারো নিয়ম মানতে হয়। ফলে সেগুলোও জমে যায়।
তবে এই জঞ্জালেরও ভারও কিছুটা লাঘব হয়েছে। গত বছর নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সব সরকারি দফতরে পুরনো ফাইল ও কাগজপত্র দূর করার নির্দেশ গিয়েছিল। যে নির্দেশ পেয়ে নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লক থেকে শুরু করে শাস্ত্রী ভবন, নির্মাণ ভবন, উদ্যোগ ভবনের মতো সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি অফিস থেকে একই ভাবেই ট্রাক ভর্তি করে করে পুরনো কাগজপত্র, খারাপ কম্পিউটার, এসি মেশিন, আসবাব সরানো হয়েছিল। দাঁড়িপাল্লা নিয়ে পুরনো জিনিসপত্রের ব্যবসায়ীদের ভিড় জমে গিয়েছিল। এই তৎপরতার ফলও মিলেছে। নর্থ ব্লকের এক আমলা বললেন, ‘‘পুরনো কাগজপত্র বিদায় হওয়ার একটা সুবিধে হয়েছে। কাজের গতি এসেছে। দরকারি ফাইল কাজের সময়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।’’
নিজের সচিবালয়ের অফিসারদের মোদী বলেছেন, এই জঞ্জাল জমানোর অভ্যেসটা আসলে মানসিকতার সমস্যা। মানসিকতার সমস্যা রয়েছে বলেই বেনারস দেশের ‘আধ্যাত্মিক রাজধানী’ হওয়া সত্ত্বেও এত নোংরা। গঙ্গার ঘাট, বিশ্বনাথ মন্দির, অপরিসর অলিগলির মতো আবর্জনাও বেনারসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে রয়ে গিয়েছে। অথচ তিনি নিজে একাধিক বার বেনারসে গিয়ে জঞ্জাল সাফাই অভিযানে হাত লাগিয়েছেন। গঙ্গার ঘাট সাফ করেছেন। কিন্তু বাকি শহরে তার কোনও ছাপ পড়েনি। তাই মানসিকতায় বদল চাই। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক কর্তার কথায়, ‘‘সিঙ্গাপুরের রাস্তাঘাট যে এত পরিষ্কার, তার কারণ, সেখানে রাস্তায় ময়লা ফেললে কড়া শাস্তি হয়। এমনকী জনশৌচালয় নোংরা করে বেরিয়ে এলেও জরিমানা দিতে হয়।’’
এ দেশে তেমন আইন এখনও দূর অস্ত্! তবে মোদী মনে করেন, শুধু সরকারি দফতর নয়। স্বচ্ছ ভারত অভিযান সফল করতে হলে প্রত্যেককে নিজের বাড়িতে, পাড়ায়, অফিসে উদ্যোগী হতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’-এর আদর্শ উদাহরণ রেখে যে কাজটা তিনি নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রের পর নিজের বাসভবনেও করে দেখালেন। এখন এই বার্তায় ভর করে মোদীর স্বপ্নের প্রকল্প গোটা দেশে কত দূর সফল হয়, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy