Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
জগন্নাথদেবের নবকলেবর

নবীনের সামনে চ্যালেঞ্জ পূর্বসূরী জেবি

তিনি নেই। তবু তাঁর অদৃশ্য ছায়ার সঙ্গেই যেন কোথাও একটা লড়াই ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর। মধ্যজীবনে পিতা বিজু পট্টনায়কের মৃত্যুর পর যেন উত্তরাধিকার সূত্রেই রাজনীতিতে আসা আনকোরা নবীন পট্টনায়কের।

ঋজু বসু
পুরী শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:৩৭
Share: Save:

তিনি নেই। তবু তাঁর অদৃশ্য ছায়ার সঙ্গেই যেন কোথাও একটা লড়াই ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর।

মধ্যজীবনে পিতা বিজু পট্টনায়কের মৃত্যুর পর যেন উত্তরাধিকার সূত্রেই রাজনীতিতে আসা আনকোরা নবীন পট্টনায়কের। এ যাবত্ কখনওই প্রতিপক্ষ নেতাদের নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি উত্কল রাজনীতির বিরল চরিত্র, কনভেন্ট শিক্ষিত নবীনকে। শুধু প্রতিপক্ষই নয়, নিজের দলের ট্রেডমার্ক ধুতি-পরা, পান-চিবানো লাল ঠোঁটের সাবেক ওড়িয়া রাজনীতিবিদদের সংস্রব বরাবর কিছুটা কৌশলী ভঙ্গিতেই এড়িয়ে চলেছেন নবীন।

কিন্তু জগন্নাথদেবের নবকলেবরের এমনই মহিমা যে এই প্রথম চার দফার মুখ্যমন্ত্রী, কার্যত নিরঙ্কুশ নবীন পট্টনায়ককেও তেমনই এক সাবেক রাজনীতিবিদের ভাবমূর্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে।

বিরোধী দলনেতা ও মুখ্যমন্ত্রীর তখ্‌তে তাঁর পূর্বসূরী, প্রয়াত জানকীবল্লভ পট্টনায়কের কথা এখন ভেসে বেড়াচ্ছে পুরীর মহল্লায়। নবীন ও সদ্য প্রয়াত জেবি পট্টনায়কের সম্পর্ক কখনওই আপাত সৌজন্যের আড়ালে ছিটেফোঁটা ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছয়নি। নবীনের পরিশীলিত ভাবমূর্তির উল্টো পিঠে জেবি যেন সেকেলে রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধি। সুপুরি চিবোচ্ছেন। ইংরেজি বলছেন নিখাদ ওড়িয়া টানে। আর জীবনের বেশির ভাগটাই ওড়িশার বাইরে কাটানো নবীন রোমান হরফে পড়ে ওড়িয়ায় বক্তৃতা দেন। এমনিতে ওড়িশার রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে এ সব খামতি নবীনের সামনে বাধা হয়নি।

তবে এত দিন পর জগন্নাথদেবের প্রতি ভক্তির নিক্তিতে ওড়িশাবাসীর মনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সেই ‘জেবি’-ই নবীনের মূল প্রতিপক্ষ।

নবকলেবরের আবহে মন্দির-চত্বরে এখন জগন্নাথ-ভক্ত জেবিকে নিয়েও নানা কিংবদন্তি ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকেই বলেন, কারও সঙ্গে আধ ঘণ্টা কথা বললে ১৫ মিনিট জগন্নাথদেবকে নিয়ে আলোচনা করতেন তিনি। ’৭৭ সালের জনতা দলের মুখ্যমন্ত্রী নীলমণি রাউতরায়ের জমানায় নবকলেবরের প্রথম রথযাত্রার সকালে ভক্ত জেবি ছিলেন মন্দিরের ভিতরে, ‘মুদুলি পেন্ডি’র কাছের সিঁড়িতে। বিগ্রহের হেলান দেওয়ার প্রয়োজনীয় কাঠের পাটাতন এসে না-পৌঁছনোয় জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার ‘পাহুন্ডি বিজয়’ ঘটতে ঘটতেই বিকেল কাবার। বাইরে উপোসী ভক্তকুল অশান্ত। চরম বিশৃঙ্খল আবহ। শোনা যায়, তখনও পর্যন্ত একবারও মুখ্যমন্ত্রী না-হওয়া, ক্ষমতার ত্রিসীমানায় না-থাকা কংগ্রেস নেতা জেবি নাকি তখন জোড় হাতে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘‘কোনও এক নবকলেবরে তোমার সেবা করার সুযোগ একটি বার তুমি আমাকে দিও!’’

সেই সুযোগটা আসে ১৯৯৬ সালে। পরের নবকলেবরের ঠিক এক বছর আগে। সেই সময় ঘটনাচক্রে জেবি-ই হন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এবং সে বার যা ঘটেছিল, তা সত্যিই বেনজির। মন্দিরের পুরনো নথিতে ষোড়শ শতক থেকে নবকলেবরের যা ফিরিস্তি রয়েছে, তাতে কখনওই জগন্নাথ দেবের রথ সূর্যাস্তের আগে গুন্ডিচা মন্দিরে পৌঁছতে পারেনি। বিংশ শতকের শেষ নবকলেবরের এক বছর আগে থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বৈঠক শুরু করেন জেবি। এবং সে-বার নবযৌবন দর্শন থেকে শুরু করে রথযাত্রা পর্যন্ত সব আচার-অনুষ্ঠান হয় একেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে। বিংশ শতাব্দীর তো বটেই, এ যাবত্ সব থেকে সফল নবকলেবরের রূপকার হিসেবে ভক্ত জানকীবল্লভের নাম এখনও পুরীর মানুষের মুখে মুখে।

এমনিতে নবকলেবরে কোনও না কোনও বিশৃঙ্খলা অবশ্য অভূতপূর্ব নয়। এ বার নবীনের জমানায় ব্রহ্ম বা ঘট-পরিবর্তন নিয়ে বিভ্রাটের আগেও বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা ঘটেছে। ১৮৫৫-য় নবযৌবন উত্সবের দিন মন্দিরের সিংহদুয়ারে পদপিষ্ট হয়ে চার জন মারা যান। ১৮৯৩-এ আবার আংশিক নবকলেবর হয়েছিল।

নবকলেবরের এক বছরের মধ্যে রাজপরিবার, মহারথকার ও পুরোহিতদের পরিবারে এক জনের মৃত্যু হয়, এই কুসংস্কারে তত্কালীন নাবালক রাজার অভিভাবক রানি সূর্যমণি পুরো নবকলেবর হতে দেননি। সে-বার বিগ্রহের কাঠ না-বদলে শুধু পোশাক বদল করা হয়।

বিংশ শতকেও ঘটেছিল নানা গোলমেলে ঘটনা। কখনও সাধুরা প্রসাদ লুঠ করেছেন। কখনও পুলিশের লাঠি খেয়ে সাধুরা ওড়িশা ত্যাগ করেছেন। ’৭৭ সালের সেই কেলেঙ্কারির নবকলেবরে সন্ধের মুখে যা-ও বা রথ কয়েক পা এগোল, বলভদ্রের রথের চাকা খুলে আবার গেরো।

সে-দিক দিয়ে ব্রহ্ম পরিবর্তন নিয়ে বিতর্কের বাইরে এ বার সব কিছুই পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছে। কিন্তু ওই এক ঘট-পরিবর্তনের ঘটনাই ভক্তদের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। নবীন পট্টনায়ক ইতিমধ্যেই পুরীর শঙ্করাচার্য নিশ্চলানন্দ সরস্বতীর কাছে তিরস্কৃত হয়েছেন। মন্দিরের যাবতীয় অঘটনের দায় তাঁর ঘাড়েই এসে পড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে নবীনের ঘনিষ্ঠ-মহলও নানা ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর নির্ভেজাল জগন্নাথ-ভক্তি প্রমাণ করতে মরিয়া। তাঁরা বলছেন, এই তো গত বছরের ২১ মে, চতুর্থ বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগের মুহূর্তেও নবীন সাত-সকালে ভুবনেশ্বর থেকে পুরী উড়ে এসেছিলেন। মন্দিরে জগন্নাথদেবের আশীর্বাদ নিয়েই দুপুরে ভুবনেশ্বরে ফিরে শপথ নেন।

মুখ্যমন্ত্রীর শিবির জানে, কাল নবকলেবরের ফাইনাল রাউন্ড বা নবযৌবন উত্সবে ছিটেফোঁটা গোলমাল হলেও রাজ্য-রাজনীতিতে তার অভিঘাত সূদূরপ্রসারী হবে। জগন্নাথদেবের নবযৌবন উত্সবের দিনে মন্দিরের সেবায়েত-কর্মচারীরা ছাড়া কেউ মন্দিরের ভিতরে ঢুকতে পারবে না বলা হলেও মন্দিরের দরজায় জনবিস্ফোরণের আশঙ্কা করছে প্রশাসন।

এমন নানাবিধ দুশ্চিন্তার মধ্যেই তিনি প্রভুর কত বড় ভক্ত, প্রতিনিয়ত তার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে নবীনকে।

আর তখন রাজ্যের সুপুরি-চিবানো, সাদা-সিধে প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জেবি-র ছায়াও যেন প্রতিপক্ষের মতোই তাঁর মুখোমুখি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE