Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রমই মণ্ডপ তরুণ ক্লাবে

নচিকেতার গান এ বার বাস্তব তরুণ ক্লাবের মণ্ডপে! ‘আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’… উদ্যোক্তারা চাইছেন ঠিক তেমনই আদলে পুজোপ্রাঙ্গন সাজাতে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলচর শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৩৬
Share: Save:

নচিকেতার গান এ বার বাস্তব তরুণ ক্লাবের মণ্ডপে!

‘আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’… উদ্যোক্তারা চাইছেন ঠিক তেমনই আদলে পুজোপ্রাঙ্গন সাজাতে।

পাঁচের দশকে শুরু হয়েছিল তরুণ ক্লাবের পুজো। প্রথম দিকের উদ্যোক্তারা ছিলেন মলয় ভট্টাচার্য, রবি চৌধুরী, যশোদাসুন্দর ভট্টাচার্য, রবি আচার্য, নকুল দাস। তাঁদের অনেকে এখন বেঁচে নেই। যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা পুজোয় সক্রিয় নন। দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন পরের প্রজন্মের হাতে। এর পর কত হাতবদল যে হয়েছে!

এখন যাঁরা সক্রিয়, দু’চারজন প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়। বাকি সবাই যুবক। তাঁরাই এ বছর বৃদ্ধাশ্রমকে থিম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পুরো এলাকা জুড়ে নচিকেতার গানটিকে চিত্রিত করা হবে বলে জানিয়েছেন সম্পাদক পল্লব দেব। তরুণ ক্লাবের দুর্গাপুজোর জাঁকজমক বাড়ছে দিনদিন। এ বারও ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন পুজো
কমিটি যখন বাজার মন্দা, চাঁদার সমস্যার কথা বলছে, তরুণ ক্লাব তখন সে সব নিয়ে মোটেও ভাবছে না। কোনও সংশয় না করেই বাজেট বাড়িয়েছে এ বারও।

পুজো কমিটির সভাপতি রতন দত্তের দাবি, প্রতিমাতেও নজর কাড়বেন তাঁরা। বিভিন্ন রকমের বীজে সেজে উঠবেন দেব-দেবী। জাম, কাঁঠাল, তরমুজ, আমড়া। সঙ্গে থাকবে নারকেলের মালা। মণ্ডপ-প্রতিমার মূল কারিগর নবদ্বীপের তপন মালাকার। সহ-শিল্পীরা আগরতলার।

আলোকসজ্জায় চমকের কথা শোনালেন পুজো কমিটির প্রবীর রায় ও অপু নাগ। তাঁরা জানান, এখানে শিশুদের কথা বিশেষ ভাবে ভাবা হয়েছে। কলকায় তাদেরই আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে চলেছেন আলোকশিল্পী সঞ্জীব দাস।

তাঁরা শোনান, তরুণ ক্লাব আগে বিভিন্ন বছর বাঁশ-বেত-পাটের মণ্ডপ করে বরাকবাসীকে সোনাই রোড মুখো করেছে। নব্বইয়ের দশকে এক বার বিশাল প্রতিমা গড়ে। পুজোর দিনগুলি ভালই কাটছিল। মুশকিল হয় বিসর্জনের সময়। জায়গায় জায়গায় মূর্তি আটকে যাচ্ছিল উচ্চতার জন্য। বাঁশের কাঠামো কেটে কেটে এগোতে হয়েছিল সে বার। ওজন নিয়েও বড় সমস্যা হয়। দেব-দেবী সকলকে মাটির অলঙ্কার পরানো হয়েছিল। তারপর থেকে ওজন-উচ্চতার কথা খেয়াল রাখেন তাঁরা।

প্রথম দিকের পুজোর স্মৃতিচারণ করে ৮৫ বছরের মলয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘যশোদা চৌধুরী ও রমেন্দ্র ভট্টাচার্যকে নিয়ে পুজো শুরু করি। এখন ৪৮টা গলি এই এলাকায়। তখন সব মিলিয়ে ৩টে গলি। ওই সময় শ’পাঁচেক টাকা চাঁদা ওঠে।’’ তিনি জানান, প্রথম পুজোর পুরোহিত ছিলেন রবীন্দ্র আচার্য। শুরুর দিকে অনেক বছর তিনি নিজে আমাদের চাঁদা আদায়ে সাহায্য করতেন। বড় খরচ বইতেন এলাকার নকুল দাস। প্রতিমা গড়তেন অমূল্য পাল। নকুলবাবু পুরো খরচ মিটিয়ে দিতেন। এ ছাড়া, নবমী পুজোর সম্পূর্ণ খরচ দিতেন তিনিই। রাকেশ রায়ের কথাও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন মলয়বাবু। রাকেশবাবু পুরসভার প্রাক্তন উপসভাপতি তথা দীর্ঘদিন পুজো কমিটির শীর্ষপদে থাকা রঞ্জিত রায়ের পিতা। তিনি প্রথম দিকে সমস্ত ফল দিতেন। তখন তো আর আপেল-আঙ্গুরের তেমন প্রচলন ছিল না। রাকেশবাবু প্রচুর নারকেল, বাতাবি লেবু, আখ মণ্ডপে পাঠিয়ে দিতেন ষষ্ঠীর সন্ধ্যায়।

হোলিক্রশ স্কুলের উল্টোদিকে ছিল নবীনচন্দ্র রাইসমিল। শুরুতে বেশ কয়েক বছর সেখানে পুজো হয়। পরে বানিয়ার মাঠে। সেখানে বাড়িঘর হয়ে গেলে পুজোর জায়গা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। একেক বছর একেক জায়গায় পুজো হয়। বছর তিরিশেক ধরে অবশ্য একস্থানে। পুজো হচ্ছে সমাজকল্যাণ বিভাগের ফাঁকা জায়গায়। তবে পুজোর জায়গা নিয়ে ফের সঙ্কটের ইঙ্গিত মিলছে। শিলচরের পুরপ্রধান নীহারেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুর মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এই মাঠে দাঁড়িয়ে কয়েক দিন আগে এখানে জলপ্রকল্প গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছেন। ক্লাব সদস্যরা অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, পুজোর জায়গা স্থায়ী ভাবে দিয়ে পুরসভা জলপ্রকল্প করলে আপত্তি নেই। এই ধরনের একটি প্রকল্প এলাকার মানুষের জন্য দরকারও। তাঁদের কথায়, ‘‘স্বচ্ছল না হলেও এই এলাকার মানুষের জমি দখলের মানসিকতা নেই। না হলে বারবার জায়গা বদলাতে হতো না।’’ তাই তাঁদের দাবি, সমাজকল্যাণ বিভাগের ফেলে রাখা জমিতে পুজো কমিটির নামে ৪ কাঠা জমি লিখে দেওয়া হোক। আগেও একবার স্থায়ী ভাবে জমি প্রদানের কাজকর্ম অনেকটা এগিয়ে রহস্যজনক ভাবে বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান তাঁরা।

শুরুর দিকে টিনের একচালা মণ্ডপ তৈরি হতো। সাজসজ্জা বলতে প্রতিমার উপর চাঁদোয়া। আর মণ্ডপের এখানে-ওখানে কাগজের কাজ। রঙিন কাগজে নানা রকমের পতাকা, শিকল বানানো হতো। বাল্ব জ্বালানোর গল্প বেশি দিনের নয়। তখন হ্যাজাক ভাড়া করে আনা হতো। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মলয়বাবু বললেন, ‘‘জাঁকজমক আর প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতার শুরু ক্লাব বিভাজনের পর। ১৯৬৯ সালে প্রথম বিভক্ত হয়ে একদল রাখি সংঘ গড়েন। আশির দশকে পৃথক হয় জুভেনাইল।’’

মলয়বাবুর মতো প্রবীণদের অবশ্য কিছুটা আক্ষেপও রয়েছে। বিশেষ করে নাটকের কথা উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, ‘‘সেই সংস্কৃতি অনেকদিন হল এখানে লোপ পেয়েছে। তবে এখন হয় আগমনী।’’ বর্তমান পুজো কমিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বারও ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় আগমনী হবে। এর আগে হবে মণ্ডপ উদ্বোধন। এ বার অবশ্য নেতা-আমলা বা কোনও বিশেষ মুখকে উদ্বোধনের জন্য ডাকছেন না তাঁরা। উদ্যোক্তরা জানালেন, শুধু বৃদ্ধাশ্রমকে মণ্ডপের থিম করেই দায় সারছে না তরুণ ক্লাব। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রবীণদের আনা হবে। তাঁদের হাতের ছোঁয়াতেই শুরু হবে এ বারের পুজো। দুস্থ বৃদ্ধদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণেরও পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।

মাঝে কয়েক বছর এলাকার মহিলারা পুজোয় সক্রিয় হতেন না, কিছু পরিবারও নিজেদের সরিয়ে রাখতেন, এ কথা জানিয়ে পুজোর কর্কর্তাদের দাবি, গত বছর থেকে ছবিটা বদলেছে। এখন সবাই আসছেন। মহিলারা গত বছর উদ্বোধনী পর্বে লালপাড় শাড়ি পরে উলুধ্বনি করেছেন। এ বারও তা-ই হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE