প্রতীকী ছবি।
ধুরন্ধর এক গোয়েন্দা সংস্থা। পৃথিবীর এমন কোনও প্রান্ত নেই, যেখানে তাদের গুপ্তচর নেই। শুধু মানুষ-গুপ্তচর নয়, রয়েছে উপগ্রহ-গুপ্তচর বা স্পাই স্যাটেলাইটও। মহাকাশ থেকে এত স্পষ্ট করে ছবি তোলে সে সব স্যাটেলাইট, যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সকালে যখন তাঁর বাংলোর লনে পায়চারি করতে বেরলেন, তখন তাঁর হাতঘড়িতে কটা বেজেছে, সেটাও পড়ে নেওয়া যায়। এ হেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-কেও হারতে হয়েছিল ভারতের কাছে।
ভারতের ‘অপারেশন শক্তি’ ঘোল খাইয়ে দিয়েছিল দুঁদে মার্কিন গোয়েন্দাদেরও। পর পর পাঁচটা পরমাণু বিস্ফোরণ দেখে হতচকিত হয়ে গিয়েছিল সিআইএ সদর দফতর।
মহাকাশ থেকে পৃথিবীর কোন প্রান্তকে কেমন দেখতে লাগছে, কোথায় নতুন ঘরবাড়ি উঠছে, কোথায় জঙ্গল কাটা পড়ছে, কোথায় রাস্তা হচ্ছে, গুগল স্যাটেলাইটের দৌলতে এখন সকলেই সে সব দেখতে পান। কিন্তু গুগল মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর অনেক আগেই সে কাজটি নিজেদের জন্য সেরে ফেলেছিল সিআইএ। পৃথিবীর সব অংশে কড়া নজরদারি চালাত সে সব স্যাটেলাইট।
অপারেশন শক্তির সাফল্যের পর পোখরানে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ, এবং পরমাণু বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম। —ফাইল চিত্র।
সময়টা নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে। আজকের ভারতকে যে ভাবে গোটা বিশ্ব বৃহৎ সামরিক শক্তি হিসেবে দেখে, তখনও ভারত সেই সমীহটা আদায় করে উঠতে পারেনি। তাই নিজেদের ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রমাণ দেওয়াটা খুব জরুরি বলে দিল্লির কর্তারা তখন মনে করছিলেন। ১৯৭৪ সালে অর্থাৎ ইন্দিরা জমানায় প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটায় ভারত। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকটায় পৌঁছে আরও এক বার পরমাণু বিস্ফোরণের প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু প্রকাশ্যে সে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব ছিল না। ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে সিআইএ গুপ্তচরদের উপস্থিতি এবং স্যাটেলাইট নজরদারির কথা ভারত সরকারের অজানা ছিল না। তাই পরমাণু বিস্ফোরণের প্রস্তুতি শুরু হলেই যে হোয়াইট হাউসে খবর পৌঁছবে এবং ওয়াশিংটন থেকে নয়াদিল্লির উপর প্রবল চাপ আসতে শুরু করবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। অতএব, সিআইএ-র চোখকে ফাঁকি দেওয়ার লক্ষ্যেই প্রথম পদক্ষেপটা করল ভারত সরকার। শুরু হল ‘অপারেশন শক্তি’।
ভারতের পরমাণু পরীক্ষা বলয় বা নিউক্লিয়ার টেস্ট রেঞ্জ রাজস্থানের ধু ধু মরুভূমির মাঝে পোখরানে। পাকিস্তানের টেস্ট রেঞ্জ পার্বত্য এলাকায়। স্যাটেলাইটের নজরদারি থেকে আড়াল খুঁজে নেওয়ার কিছুটা হলেও উপায় রয়েছে সেখানে। কিন্তু ধু ধু মরুভূমির মাঝে অবস্থিত ভারতীয় টেস্ট রেঞ্জকে স্যাটেলাইটের নজর থেকে আড়াল করার কোনও উপায় ছিল না। অতএব সিআইএ-র চোখে ধুলো দেওয়ার অন্য কৌশল নেওয়া হল। ১৯৯৮-এর মে মাসে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল ভারত। কিন্তু তার কয়েক বছর আগে থেকে সিআইএ-র চোখে ধুলো দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। পোখরানে হঠাৎ সামরিক মহড়া দিতে শুরু করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ৫৮ ইঞ্জিনিয়র রেজিমেন্টকে এই কাজে লাগানো হয়। পরমাণু বিস্ফোরণের আসল প্রস্তুতি শুরুর আগে দেড় বছর ধরে রুটিন মহড়া দিতে থাকে সেনা।
আন্ডারগ্রাউন্ড ব্লাস্টের পর বিধ্বস্ত বিস্ফোরণ স্থল। —ফাইল চিত্র।
ভারতের প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণও পোখরানেই ঘটেছিল। তাই ওই অঞ্চলে ভারতীয় সেনার তৎপরপতা দেখেই ফের কড়া নজরদারি শুরু করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাটি। ভারতীয় সেনার প্রতিটি পদক্ষেপের উপর লক্ষ্য রাখছিল সিআইএ। কিন্তু সিআইএ-র গুপ্তচর স্যাটেলাইট মাসের পর মাস নজর রেখেও শুধু সাধারণ সেনা মহড়া ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পায়নি। এক সময় তাই বিষয়টির গুরুত্ব কমে যায় তাদের চোখে। পোখরানে ভারতীয় সেনার সব কার্যকলাপকেই রুটিন মহড়া হিসেবে দেখতে শুরু করে আমেরিকা। এই ‘রুটিন মহড়া’ চলতে চলতে কবে ‘আসল’ মহড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল, মার্কিন গোয়েন্দারা তা টের পাননি। রাতের অন্ধকারে ট্রাকে চাপিয়ে পরমাণু পরীক্ষার সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ভোরের আলো ফোটার আগে সে সব লুকিয়ে ফেলা হচ্ছিল। মাটি খোঁড়ার জন্য ব্যবহৃত ড্রিল মেশিন সকাল হওয়ার আগে পোখরান থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। মরুভূমিক বুকে বিছিয়ে থাকা বৈদ্যুতিক তারগুলিকে গুল্ম জাতীয় গাছ দিয়ে ঢেকে রাখা হচ্ছিল।
আরও পড়ুন: পাক মোকাবিলায় হাইড্রোজেন বোমা চেয়েছিলেন রাজীব, দাবি সিআইএ-র
শুধু তাই নয়, ভারতীয় পরমাণু বিজ্ঞানীরা খুব সন্তর্পনে পোখরানে যাতায়াত করতেন সে সময়। এপিজে আবদুল কালাম সেখানে যখনই যেতেন, সেনার পোশাক পরে যেতেন এবং বাহিনীর সঙ্গে একা যেতেন, অন্য কোনও বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিতেন না। অন্য বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসৃত হত।
অবশেষে ১৯৯৮ সালের ১১ মে। ভারত পাঁচটা পরমাণু বোমা ফাটিয়ে দেয় পোখরানে। সেই বিপুল বিস্ফোরণ ঘুম ভাঙে সিআইএ-র। ওয়াশিংটন ডিসি হতচকিত। এত দিন ধরে কী করছিলেন গোয়েন্দারা? ভারত কী ভাবে সিআইএ-কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে পোখরানে এত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল? প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের প্রশ্নের জবাব ছিল না তদানীন্তন সিআইএ প্রধানের কাছে। ‘অপারেশন শক্তি’ ততক্ষণে কাঁপিয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। সিআইএ-র ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাগুলির তালিকায় জুড়ে গিয়েছে ভারতের সে সাফল্যের উপাখ্যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy