Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

মাথায় হাত দাউদের, জালনোট চক্র চুলোয়

করাচি, পেশোয়ার কিংবা বালুচিস্তান....। পাকিস্তানের যে এলাকাগুলিতে এ যাবৎ দিন-রাত এক করে জাল ভারতীয় নোট ছাপার কাজ চলত, গোয়েন্দারা বলছেন, সেই সব কারখানায় এখন কেবল নিস্তব্ধতা।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১১
Share: Save:

করাচি, পেশোয়ার কিংবা বালুচিস্তান....।

পাকিস্তানের যে এলাকাগুলিতে এ যাবৎ দিন-রাত এক করে জাল ভারতীয় নোট ছাপার কাজ চলত, গোয়েন্দারা বলছেন, সেই সব কারখানায় এখন কেবল নিস্তব্ধতা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এক ঘোষণায় পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট রাতারাতি বাতিল হয়ে যাওয়ায় কার্যত তালা পড়ে গিয়েছে পাকিস্তানের ওই সব জাল নোট ছাপার কারখানায়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজুর কথায়, ‘‘করাচি, পেশোয়ার-সহ সমস্ত জাল টাঁকশালের কর্মীরা এখন বেকার হয়ে পড়েছে!’’ পথে বসেছে পাকিস্তানের জাল নোট চক্রও। সব মিলিয়ে মাথায় হাত পাকিস্তানের।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হিসেব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি জাল টাকা পাকিস্তান থেকে ভারতে ঢুকেছে। যাদের অধিকাংশই পাঁচশো ও হাজারের নোট। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে প্রতি ১০ লক্ষে ২৫০টি নোট জাল। গুজরাত এবং পঞ্জাব ছাড়াও গোয়েন্দাদের বড় চিন্তার জায়গাটি হল পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ ও ভারত-নেপাল সীমান্ত। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, পাক এজেন্টদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগণা হয়ে কলকাতায় ঢুকে ওই সব জাল নোট ছড়িয়ে পড়ছিল গোটা দেশে। সম্প্রতি দিল্লি-সহ উত্তর ভারতে যে ক’জন জাল নোটের কারবারি ধরা পড়েছে, তারা সকলেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের এই যোগাযোগের কথা গোয়েন্দাদের জানিয়েছে। এ ছাড়া নেপাল-থেকে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর, বিহারের কয়েকটি জায়গা এমনকী সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ দিয়েও জাল নোট দেশে ঢুকছে বলে তদন্তে জানতে পারছিলেন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র গোয়েন্দারা।

প্রাথমিক ভাবে ধাক্কা খেলেও পাকিস্তান যে ফের নোট জাল করার খেলায় নামবে, তা বিলক্ষণ জানে ভারত। তাই কেন্দ্রের এখন এখন মূল লক্ষ্য হল, এক দিকে সীমান্তে টাকা পাচারের ফাঁকগুলি ভরাট করা। অন্য দিকে মূলত দাউদ ইব্রাহিমের নেতৃত্বে সীমান্তের দু’পারে যে জাল টাকার নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছিল, তা এই সুযোগে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ১৪ নভেম্বর কলকাতা যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সূত্রের খবর, তাঁর সঙ্গে মন্ত্রকের শীর্ষ কর্তাদের একটি দল পশ্চিমবঙ্গে যাবে। যাদের কাজ হবে, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তকে একেবারে নিশ্ছিদ্র করে ফেলা। এবং পাকিস্তান কোমর কষে নতুন জাল টাকা ঢোকানোর আগেই সে কাজ সেরে ফেলতে চায় কেন্দ্র। তার পরেই বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি ও নেপালের সঙ্গে বৈঠক করবে কেন্দ্রের ওই দলটি। কেন্দ্রের আশা, এর আগে অনায়াসে পাকিস্তান নিজেদের মাটিতে বসে নোট জাল করতে এবং তা ভারতে ঢোকাতে সক্ষম হলেও এ বার তাদের কাছে কাজটি যথেষ্ট কঠিন হবে।

কেন? পাক সরকার মূলত সে দেশের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের সরাসরি মদতেই দেশের বিভিন্ন শহরে জাল নোট ছাপার কাজটি করে বলে বহু দিন ধরেই অভিযোগ করছেন গোয়েন্দারা। সেই সব নোট এতটাই নিখুঁত যে খালি চোখে তার পার্থক্য করা কঠিন। গোয়েন্দাদের ব্যাখ্যা, ভারত এত দিন নোটের জন্য কাগজ ও কালি জার্মানির ফ্রাঙ্কফার্ট ও সুইৎজারল্যান্ড থেকে কিনত। দেখাদেখি পাকিস্তানও একই সংস্থা থেকে কাঁচামাল কিনতে শুরু করে। ঘুরপথে জোগাড় করে ভারতীয় টাকা ছাপার মেশিনও। এ কারণেই পাকিস্তানে তৈরি জাল নোটের সঙ্গে আসল নোটের ফারাক করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। ভারতীয় গোয়েন্দারা এ-ও বলছেন, পাকিস্তান নিজেদের নোটের থেকে ভারতীয় নোট বেশি ছাপাত!

কেন্দ্রের আর্থিক গোয়েন্দা শাখা-সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা দীর্ঘ দিন ধরেই কেন্দ্রকে বলে আসছিল যে, জাল টাকা বন্ধ করতে হলে এক ধাক্কায় তা বাতিল করতে হবে। তা না হলে বর্তমানের চালু টাকায় যতই সুরক্ষাবিধি বাড়ানো হোক, ক’দিন পরে পাকিস্তান তা জাল করে ফেলবেই। একই সঙ্গে পাল্টাতে হবে কাগজ এবং ছাপার নকশাও। দেরিতে হলেও সেই সুপারিশ মেনেছে কেন্দ্র। তাই বর্তমানে যে দু’হাজার ও পাঁচশো টাকার নোট বাজারে আসতে শুরু করেছে, সেগুলির কাগজ সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের। কালিও আলাদা। নতুন ধরনের সুরক্ষাবিধি যোগ করা হয়েছে এই নোটগুলিতে। ফলে পাকিস্তানের পক্ষে এই নোট এখনই জাল করা বেশ কষ্টকর বলেই মনে করছে অর্থ মন্ত্রক।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে, টাকা বাতিলের সিদ্ধান্তে ঘোর সমস্যায় দাউদ ইব্রাহিমও। তার অন্যতম দায়িত্ব ছিল, নেপাল ও বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতে জাল টাকা ঢুকিয়ে এ দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করা। গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে নেপাল-বাংলাদেশ-দুবাই-তাইল্যান্ডের মাধ্যমে ভারতে জাল টাকা ঢোকানোর বিশাল এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল দাউদ। জাল হাজার টাকা বাজারে চালাতে পারলে পাঁচ থেকে ছ’শো টাকা অবধি কমিশনের লোভ দেখিয়ে পূর্ব ভারত ও নেপালে এক বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল দাউদ। কিন্তু এক ধাক্কায় পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিল হয়ে যাওয়ায় সেই নেটওয়ার্ক পুরোটাই বসে গিয়েছে। ফলে দাউদের প্রাসঙ্গিকতা আইএসআইয়ের কাছে এক ধাক্কায় অনেকটা কমেছে বলে মত গোয়েন্দাদের।

একশো টাকার নোট কি তা হলে জাল হয় না?

গোয়েন্দারা বলছেন, হয়। কিন্তু পরিমাণে খুব অল্প। কারণ একশো টাকার জাল নোট ছাপাতে যে খরচ পড়ে, তার পরে এজেন্টকে বেশি কমিশন দেওয়া সম্ভব হয় পাচারকারীদের। আর লাভের অঙ্ক কম থাকায় অধিকাংশ এজেন্ট একশো টাকা চালানোর ঝুঁকি নিতে চান না। তা ছাড়া একশো টাকার বান্ডিলের মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাচার করার ঝুঁকি অনেক বেশি। সেই কারণেই এত দিন পাঁচশো-হাজার টাকা জাল করার উপরে জোর দিয়েছিল আইএসআই। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরে এখন পাকিস্তানকে নতুন রণকৌশল তৈরি করতে হবে বলেই মনে করছেন গোয়েন্দারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE