Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

মোদীর পথেই মন্ত্রী ‘চা বিক্রেতা’ পরিমল

দিল্লির মসনদ সামলান এক জন। অন্য জন আজ প্রথম বসলেন অসমের মন্ত্রীর আসনে। দু’জনের তুলনা টানা তা-ই কঠিন। কিন্তু চায়ের দোকান মিলিয়ে দিল তাঁদের! কারণ দু’জনের বাবাই ছিলেন চা বিক্রেতা। বাবাকে সাহায্য করতে ছোটবেলায় চায়ের দোকানে বসতে হয়েছিল দু’জনকেই।

অসমে বিজেপি সরকারের শপথের দিন বিজয় মিছিল করিমগঞ্জে। মঙ্গলবার উত্তম মুহরীর তোলা ছবি।

অসমে বিজেপি সরকারের শপথের দিন বিজয় মিছিল করিমগঞ্জে। মঙ্গলবার উত্তম মুহরীর তোলা ছবি।

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৬ ০২:৫৬
Share: Save:

দিল্লির মসনদ সামলান এক জন। অন্য জন আজ প্রথম বসলেন অসমের মন্ত্রীর আসনে। দু’জনের তুলনা টানা তা-ই কঠিন।

কিন্তু চায়ের দোকান মিলিয়ে দিল তাঁদের! কারণ দু’জনের বাবাই ছিলেন চা বিক্রেতা। বাবাকে সাহায্য করতে ছোটবেলায় চায়ের দোকানে বসতে হয়েছিল দু’জনকেই।

প্রথম জন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আরেক জন হলেন সর্বানন্দ সোনোয়াল মন্ত্রিসভার সদস্য তথা বরাকের ধলাইয়ের বিধায়ক পরিমল শুক্লবৈদ্য।

এক সময় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা রেলের যাত্রীদের জন্য চা নিয়ে যেতেন মোদী। তেমনই ডাক এলেই পরিমলবাবু চা নিয়ে ছুটতেন আইরংমারার এ দোকান, ও দোকানে। কেউ বলতেন দু’টোকে তিন ভাগ করে দিতে। কেউ কেউ চারটেকে ছ’টা। নিজের হাতে এগিয়ে দিতেন চায়ের কাপ।

পরিমলবাবু প্রথম বার ভোটে দাঁড়ান ১৯৯১ সালে। তখন তিনি আইরংমারা এমই স্কুলের প্রধানশিক্ষক। দীর্ঘদিন এলাকাবাসীই স্কুলটি চালিয়েছেন। তখন নামমাত্র বেতন মিলত শিক্ষকদের। এলাকার ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে বিএ পাশ করে প্রায় বিনা বেতনে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৮৬ সালে স্কুলের সরকারি স্বীকৃতি মেলে। পরিমলবাবুও প্রধানশিক্ষকের পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা পান। এরই মধ্যে রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। ৮৭ সালে বিজেপির সদস্যপদ নেন। কিন্তু সরকারি চাকরির জন্য প্রকাশ্যে দলের কাজ করার সুযোগ মেলেনি। ১৯৯১ সালে যেন সে সুযোগই পেয়ে গেলেন হাতের কাছে। সে বার বিধানসভা ভোটের সময় ধলাই আসনে প্রার্থিত্ব নিয়ে সঙ্কটে পড়ে দল। তফসিলি জাতির জন্য আসনটি সংরক্ষিত বলে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বদ্রীনারায়ণ সিংহ এবং দ্বারিকানাথ যাদব কথা বলেন পরিমলবাবুর সঙ্গে। রাজি হয়ে যান তিনি।

আজ খানাপাড়ায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান স্থলে দাঁড়িয়ে টেলিফোনে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ আনন্দবাজার পত্রিকা-কে বলেন, ‘‘ধলাইয়ে কাকে প্রার্তী করা যায়, বড় চিন্তায় ছিলাম সে বার। এরই মধ্যে বদ্রীনারায়ণ সিংহ ফোন করে পরিমলের কথা বললেন। আমি তখন তাঁকে একেবারেই চিনতাম না। বদ্রীদাকে বলি, তাঁকে আমার বাড়ি পাঠাতে।’’

পরদিন সকালেই যুবক পরিমল শুক্লবৈদ্য যান কবীন্দ্রবাবুর নতুনপট্টির বাড়িতে। অত্যন্ত সাদাসিধে। প্রণাম করে নিজের পরিচয় দেন। কবীন্দ্রবাবু প্রথমে তাঁর বাড়িঘরের খোঁজ নেন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন সরকারি স্কুলের প্রধানশিক্ষক। কবীন্দ্রবাবুর কথায়, ‘‘আমাকেও রাজনীতির জন্য স্কুলের অধ্যক্ষের চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। বড় আর্থিক কষ্টে কাটে শুরুর দিনগুলি। তাই তাঁকে খোলাখুলি বলি, জিতলে খুব ভাল। বিধায়কের বেতন-ভাতা মন্দ নয়। কিন্তু হারলে কী হবে? আমাকে বিস্মিত করে পরিমল জবাব দেয়, হেরে গেলে সমস্যা হবে না। চায়ের দোকানে নিয়মিত বসব। সংসার চালানোর মত রোজগার হয়ে যাবে।’’ তাঁর কথা শুনে কবীন্দ্রবাবু তখনই তাঁকে টিকিট দেওয়ার কথা পাকা করে নেন। সে সময় বরাক উপত্যকায় দলের মনোনয়নের জন্য কবীন্দ্রবাবুই ছিলেন প্রথম এবং শেষ কথা।

৩২ বছরের পরিমল শুক্লবৈদ্য বিজেপি প্রার্থী হিসেবে ধলাই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রথম বারই অগপ-র কামাখ্যাপ্রসাদ মালাকে হারিয়ে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালে হেরে গিয়ে জেতেন ২০০১ এবং ২০০৬ সালেও। এ নিয়ে চতুর্থ বার বিধায়ক হলেন পরিমলবাবু। মাঝে তাঁকে হারতে হয়েছে লোকসভা নির্বাচনেও। তফসিলি সংরক্ষিত করিমগঞ্জ আসনে দল দু’বার তাঁকে প্রার্থী করেছিল।

কবীন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘যত বার পরাস্ত হয়েছে পরিমল, তাঁর ওই ‘হেরে গেলে চায়ের দোকানে বসে সংসার চালিয়ে নেওয়া’র কথাটি আমার কানে বেজেছে। দুশ্চিন্তা হতো তখন। আজ সে সবের অবসান ঘটেছে।’’

এ দিন অবশ্য তাঁর বাবা প্রফুল্ল শুক্লবৈদ্য বেঁচে নেই। চায়ের দোকানও সেই কবে উঠে গিয়েছে। তবু তাঁর বাল্যবন্ধু জ্যোতিরিন্দ্র দেব (ওরফে শিবু) বললেন, ‘‘পরিমলের পুরনো দিনের কথা বললে চায়ের দোকানের কথাই প্রথম মনে পড়ে। বাবাকে সাহায্যের জন্য চায়ের কাপ নিয়ে ছুটোছুটি করত। শুধু বিএ পাশ করেই নয়, প্রধানশিক্ষক হয়েও নিয়মিত চা বানিয়েছে। তাই চারবার বিধায়ক হলেও অহংকার ছুঁতে পারেনি তাঁকে।’’ একই দাবি পরিমলবাবুর অনুগামী রূপম সাহার। তিনি বললেন, ‘‘আজ পরিমলবাবু গুয়াহাটির সরকারি বাসভবনে দিনভর ধলাই থেকে যাওয়া দলীয় কর্মীদের সঙ্গেই সময় কাটিয়েছেন। অনেকে গিয়েছেন মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে। কিন্তু তাঁর মধ্যে মন্ত্রীর হাবভাব ছিল না বিন্দুমাত্র।’’

মন্ত্রী হয়েই প্রথম প্রতিক্রিয়ায় পরিমলবাবু আনন্দবাজার-কে বলেন, ‘‘বহুদিনের স্বপ্ন ছিল অসমে দলের সরকার হবে। আজ সেই স্বপ্নপূরণ হল। এ আমাদের কাছে বিশাল প্রাপ্তি। মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিজেপি এলে ন্যায় পাবে। এ বার তা আমাদের পূরণ করতে হবে।’’ পাঁচ বছর সবাই মিলে কাজ করার অঙ্গীকার করেন তিনি। পরিমলবাবু বলেন, ‘‘নিজের দফতরের মন্ত্রী হিসেবে গোটা অসমের জন্যই কাজ করব। কিন্তু নেতা হিসেবে বিশেষ ভাবে ভাবতে হবে বরাক উপত্যকার জন্য। কারণ এই অঞ্চল দীর্ঘদিন থেকে বঞ্চনার শিকার ছিল।’’ তিনি আশাবাদী, মন্ত্রিসভার পরিবর্তন সকল মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

পরিমল শুক্লবৈদ্যর মন্ত্রিত্বলাভে ধলাই-সহ বরাক জুড়ে এ দিন মানুষ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। স্থানে স্থানে বাজি পোড়ে, হর্ষোল্লাস হয়। এরই মধ্যে বার বার এককথা উঠে আসে, চায়ের দোকান থেকে কোথায় পৌঁছনো যায় প্রথম দেখিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী, আজ দেখালেন পরিমল শুক্লবৈদ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parimal shukla Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE