Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

রাম-বাধা কাটবে তো, প্রশ্নবাণে জর্জরিত সীতা

রামচন্দ্র এখনও জন্মাননি! সীতাও আসেননি। কিন্তু পুরোদস্তুর রামায়ণ শুরু হয়ে গিয়েছে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসে! এ রাম অবশ্য সে রাম নন। সীতাও পৌরানিক কোনও চরিত্র নন। দলটার নাম যখন সিপিএম, পুরান-বৃত্তান্তের কোনও জায়গা সেখানে থাকারও কথা নয়। এ রাম, এ সীতা ঘোরতর ভাবে রক্তমাংসের!

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

সন্দীপন চক্রবর্তী
বিশাখাপত্তনম শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৩
Share: Save:

রামচন্দ্র এখনও জন্মাননি! সীতাও আসেননি। কিন্তু পুরোদস্তুর রামায়ণ শুরু হয়ে গিয়েছে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসে!

এ রাম অবশ্য সে রাম নন। সীতাও পৌরানিক কোনও চরিত্র নন। দলটার নাম যখন সিপিএম, পুরান-বৃত্তান্তের কোনও জায়গা সেখানে থাকারও কথা নয়। এ রাম, এ সীতা ঘোরতর ভাবে রক্তমাংসের! এ বারের পার্টি কংগ্রেস যে হেতু সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তনের আসর, তাই উত্তেজনা তুঙ্গে! এস রামচন্দ্রন পিল্লাই না সীতারাম ইয়েচুরি, কে বসবেন শীর্ষ পদে? দেশ জুড়ে সিপিএমের অবস্থা যতই সঙ্গিন হোক, চুলচেরা বিতর্ক চলছে দক্ষিণী এই উপকূল শহরে।

কেরলের রামচন্দ্রকে সিপিএমের উচ্চ মার্গের নেতারা ছাড়া কেউ তেমন চেনে না। দলের ভিতরে পাটিগণিতের জোর তাঁর পক্ষে যতই থাক, বাইরের জগতে পরিচিতি না থাকায় তিনি কিছুটা নিস্তার পেয়েছেন বটে! কিন্তু অন্ধ্রের ভূমিপুত্র সীতা ভূ-ভারতে পরিচিত নাম। দেশের যে কোনও রাজ্যে রাজনীতির বাইরেও লোকজন এক ডাকে তাঁর নাম জানে। তাই তাঁর নিস্তার নেই! নিজের রাজ্যে পার্টি কংগ্রেসের জন্য পা দেওয়া ইস্তক যেখানে যাচ্ছেন, তাঁর পিছনে পিছনে প্রশ্ন ছুটছে! আপনিই তা হলে সিপিএমের নতুন কাণ্ডারী? সীতা যত এড়াতে যান, তত ধেয়ে আসে প্রশ্নবাণ! সোজা রাস্তায় না হলে ঘুর পথে! ইংরেজিতে উত্তর না পেলে হিন্দিতে! হিন্দিতে সীতা কাটিয়ে বেরোলে তেলুগুতে! তাতেও ডজ দিতে পারলে বাংলায়! সীতা যতই বলছেন, চার দিন হয়ে গিয়েছে। আর তো দেড় দিন! অপেক্ষা করুন না। কে শোনে? সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের ভাষায়, জাতি জানতে চায়, প্রকাশ কারাটের উত্তরসূরি কে? এক্ষনই!

অধিবেশনের চতুর্থ দিনে মিডিয়া সেন্টারে যেমন ঘটল। সীতারামকে হাতের কাছে পেয়েই প্রশ্ন এল, কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক? রামচন্দ্রন হোন বা সীতারাম, এই প্রশ্নের একটাই কেতাবি উত্তর আছে সকলের। পার্টি কংগ্রেস নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করবে। তারা আবার নতুন সাধারণ সম্পাদক এবং পলিটব্যুরো বেছে নেবে। সীতারাম এ দিনও অজস্র বার এই বাঁধা বুলির পুনরাবৃত্তি করেছেন। কিন্তু ছুটলে কথা থামায় কে! প্রশ্ন হল, রাজ্যসভার সাংসদ থেকেও কেউ কি সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হতে পারেন? গুগলি বুঝে নিয়ে সীতা দ্রুত বলের লাইনে গেলেন— ‘‘যত ক্ষণ তিনি সিপিএমে আছেন, তত ক্ষণ সব কিছুই পারেন!’’ রোল উঠল, তার মানে সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দিচ্ছেন না! হেসে পরিস্থিতি হাল্কা করার আগেই রিভার্স সুইং! ভারতের মতো দেশে হিন্দি, ইংরেজির সঙ্গে বেশ ক’টা আঞ্চলিক ভাষা জানেন, এমন কারও সম্পাদক হওয়াই ভাল নয় কি? সীতা দেখেশুনে খেললেন, ‘‘সংগঠনে কাজ করার জন্য রাজনীতির জ্ঞানই যথেষ্ট। বাকি জ্ঞানগুলো উপরি। ওতে বিরাট কিছু এসে যায় না!’’ কেরল, অন্ধ্র, ত্রিপুরা, বাংলা, দিল্লির সংবাদ-বুভুক্ষু মিডিয়া এতে ছাড়ে? এল ইয়র্কার— বাংলায় সিপিএমের সঙ্কটের সময়ে বাংলা বোঝেন, এমন কেউ সম্পাদক হলে কি পশ্চিমবঙ্গে দলের পক্ষে ভাল? বুনো ওলের মুখে সীতা যেন বাঘা তেঁতুল— ‘‘তা হলে বাংলার কাউকে দায়িত্ব দিলে আরও ভাল হয়!’’

শেষ পর্যন্ত এক বার তাঁকে বলতেই হল, ‘‘ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন করলে আমার কাছ থেকে আলাদা উত্তর পাওয়া যাবে না! বড়সড় একটা নাটক হবে আর আপনারা জমিয়ে খবর করবেন, এ রকম কিছুও ভাববেন না!’’ তখনই আবার পাল্টা প্রশ্ন, তার মানে শান্তিপূর্ণ ভাবেই দলের ব্যাটনটা তাঁর হাতে উঠবে? এ বারে কপালে হাত দিয়ে হেসে ফেললেন সীতারাম। ‘‘অপেক্ষা করুন একটু!’’

কথা আর রসিকতার মোড়কে যতই চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন, সীতারাম মনে মনে জানেন কঠিন যুদ্ধে নেমেছেন! সাম্প্রতিক কালে রাজ্যসভায় তাঁর ভূমিকা, নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপরে সংশোধনী এনে ভোটাভুটিতে সব দলকে সঙ্গে নিয়ে হারিয়ে দেওয়া— এ সব তাঁর খ্যাতি বাড়িয়েছে। সঙ্গে বিনামূল্যে এসেছে বিড়ম্বনা! বিশাখাপত্তনমে এসে যা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বাংলা থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সাংসদ! ঘরোয়া আলোচনায় অ-বিজেপি বেশির ভাগ দলের নেতারাই বলছেন, সীতা ছাড়া সিপিএমের গতি নেই। ঘরোয়া আলাপচারিতায় প্রমাদ গুনছেন বিজেপি-র কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, সীতা সিপিএমের কাণ্ডারী হওয়া মানে ঠিক রাস্তা বার করে জনতা পরিবারের সঙ্গে মিলে বিজেপি-কে আরও বিপদে ফেলবেন! তুলনায় রামচন্দ্রন নিরাপদ! একলা চলার আনন্দে বহু ব্যাপারেই অন্যদের সঙ্গে দূরত্ব রাখবেন!

পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে আনুষ্ঠানিক ভাবে নতুন সম্পাদকের নাম আসবে রবিবার। কিন্তু তার আগে শনিবার রাতেই বিদায়ী পলিটব্যুরোয় আসল খেলা জমবে! রীতিমাফিক নতুন সম্পাদকের নাম প্রস্তাব করতে হবে বিদায়ী সম্পাদককেই। ঐকমত্য হলে ভাল। না হলে পলিটব্যুরোয় ভোট। সমর্থন আদায়ের অঙ্কেই এ দিন তাই হোটেলে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের ঘরে আলোচনা করতে যান কারাট-রামচন্দ্রন। আলাদা করে কথা বলতে যান সীতারামও। কেরলের নতুন রাজ্য সম্পাদক কোডিয়ারি বালকৃষ্ণনকে নিয়ে দু’তরফে জম্পেশ টানাটানি চলছে! কলকাতায় বসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অবশ্য সীতারামের জন্য যাকে বলে বডি ফেলে দিয়েছেন! পলিটব্যুরোয় বাংলার বাকি নেতাদের নিয়েও সীতারামের তেমন চিন্তা নেই।

সিপিএমে পার্টি কংগ্রেসের সাধারণ প্রতিনিধিরা সাধারণ সম্পাদক বাছতে ভোট দিতে পারেন না। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘প্রতিনিধিদের মধ্যে ব্যালট নিলে তো সীতার প্রতিদ্বন্দ্বীদের জামানত জব্দ হতো!’’ কিন্তু এখন রশি শীর্ষ স্তরের নেতাদের হাতে! শেষ পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে ভোটাভুটির ঝুঁকি তিনি নেবেন? বাউন্সারটা ‘ডাক’ করলেন সীতা!

দক্ষিণী ধাঁচে রবিবার দলের নয়া সাধারণ সম্পাদককে হুডখোলা লাল জিপে চাপিয়ে সমাবেশে নিয়ে যাওয়া হবে। পোর্ট েস্টডিয়ামে লাল টুকটুকে সে রথ আপাতত প্রতীক্ষায়! কারাট রশি ছাড়লে সে নতুন সারথি পাবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE