Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
মাকে ঘৃণা, বাবার জন্য টান

শিনাদের কথা জানতেন বাবলি

পনেরো বছর আগে মেয়ে শিনার সঙ্গে তাঁর শেষ এক বার ফোনে কথা হয়েছিল, এই সোমবারও এমনটাই দাবি করেছিলেন সিদ্ধার্থ দাস। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের হাতে আসা শিনার বেশ কিছু চিঠি এবং ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে এখন দেখা যাচ্ছে, শিনা অন্তত তাঁর স্কুলজীবনের শেষ দিক অবধি সিদ্ধার্থকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। সিদ্ধার্থ ফোন করছেন না কেন, তাই নিয়ে অনুযোগও করতেন।

সোমা মুখোপাধ্যায় ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৪:০৪
Share: Save:

পনেরো বছর আগে মেয়ে শিনার সঙ্গে তাঁর শেষ এক বার ফোনে কথা হয়েছিল, এই সোমবারও এমনটাই দাবি করেছিলেন সিদ্ধার্থ দাস। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের হাতে আসা শিনার বেশ কিছু চিঠি এবং ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে এখন দেখা যাচ্ছে, শিনা অন্তত তাঁর স্কুলজীবনের শেষ দিক অবধি সিদ্ধার্থকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। সিদ্ধার্থ ফোন করছেন না কেন, তাই নিয়ে অনুযোগও করতেন।

শিনার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ যে ২০০০ সালেই ফুরিয়ে যায়নি, সে কথা বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজে স্বীকারও করলেন সিদ্ধার্থ। আর সিদ্ধার্থর স্ত্রী বাবলি স্বীকার করেছেন যে, শিনার সঙ্গে স্বামীর যোগাযোগের কথা তাঁরও অজানা ছিল না। ‘না জানা’র তত্ত্ব থেকে ঘুরে গিয়ে তিনি এ দিন বলেছেন, ‘‘সন্তানস্নেহ কাকে বলে জানেন? সন্তানের সঙ্গে একেবারে যোগাযোগ বন্ধ করে থাকা কোনও জন্মদাতার পক্ষেই সম্ভব নয়।’’

এ দিন সকাল থেকেই শিনার লেখা কিছু চিঠি এবং ডায়েরিকে ঘিরে সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। এর মধ্যে ডিয়ার ড্যাডি সম্বোধনে দু’টি চিঠি এবং ছ’দিনের ডায়েরি রয়েছে। চিঠিগুলি সম্ভবত খসড়া। পরে সেগুলি সিদ্ধার্থকে পাঠানো হয়েছিল কি না, স্পষ্ট নয়। ডিএনএ সংবাদপত্রের সৌজন্যে পাওয়া ওই সব চিঠি ও ডায়েরির ছত্রে ছত্রে বাবার প্রতি শিনার প্রবল টানের সাক্ষ্য ছড়িয়ে রয়েছে। তবে গুয়াহাটির বাড়িতে দাদু-দিদা কেউই যে সিদ্ধার্থকে পছন্দ করতেন না, তার কথাও বিস্তারিত ভাবেই আছে।

শিনা লিখেছেন, তিনি চাইলেও ইচ্ছেমতো ফোন করতে পারেন না। এমনকী বাবাকে চিঠি পাঠানোর জন্য খাম কিনতে দেওয়াটাও বেশ অসুবিধাজনক। কিছু কথা লিখেও কেটে দিয়েছেন। এক জায়গায় লিখেছেন, বাবার জায়গাটা আর কেউই নিতে পারবে না। দাদুকে তিনি যথেষ্ট আপন ভাবতে পারেন না বলেও তাঁর দাবি। দাদু এক বার সিদ্ধার্থর ব্যাপারে খারাপ কিছু বলায়, প্রতিবাদ করেছিলেন শিনা। দাদু তাঁকে চড় মারেন বলে লিখেছেন তিনি। জানিয়েছেন, ঘটনাটা ঘটেছিল যখন তিনি তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন। তার পর থেকে বাবা সম্পর্কে খারাপ কথা শুনলেও শিনা চুপ করে থাকতেন আর মনে মনে গুমরোতেন। কিন্তু চিঠির প্রায় প্রতিটি লাইনে ধরা পড়েছে, বাবাকে কতটা ভালবাসেন, কতটা ‘মিস’ করেন তিনি। মা ছেড়ে চলে গেলেও মায়ের প্রতিও একটা ভালবাসা যে রয়ে গিয়েছে কোথাও, লিখেছেন সেটাও। কিন্তু ‘বুড়ো লোকটা’র (সময়ের হিসেব মিলিয়ে দেখলে যাঁকে পিটার মুখোপাধ্যায় বলেই মনে হয়) সঙ্গে বিয়ের পরেই মায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা উগরে দিয়েছেন ডায়েরির পাতায়।

সোমবার সন্ধেয় আনন্দবাজার যখন সিদ্ধার্থ-বাবলিকে প্রথম খুঁজে পায়, তখন সিদ্ধার্থবাবু জানিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে মেয়ের শেষ বারের মতো কথা হয়েছে ২০০০ সালে। যখন সে দশম শ্রেণির ছাত্রী। জানিয়েছিলেন, সে দিন তাঁর ছেলে মিখাইল তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায়নি।

এ দিন যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় শেষ কবে শিনার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল, সিদ্ধার্থ বলেন, ‘‘অত দিনক্ষণ আমার পক্ষে মনে রাখা সম্ভব নয়।’’ তবে স্বীকার করেন, তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে, দেখাও হয়েছে কয়েক বার। একটি চিঠিতে শিনা বাবাকে তাঁর এইচএসএলসি (মাধ্যমিক) পরীক্ষা শেষ হওয়ার খবর দিয়েছেন। ডায়েরির পাতায় সেটা ৩০ জুলাই, ২০০২। তবে মনে হয়, শিনা চিঠিটি পুরনো ডায়েরির পাতায় লিখেছিলেন। কারণ তাঁর পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড বলছে, তিনি এইচএসএলসি পরীক্ষা দেন ২০০৪ সালে। অর্থাৎ এটুকু বোঝাই যাচ্ছে, অন্তত ২০০৪ অবধি তাঁর সঙ্গে সিদ্ধার্থর যোগাযোগ ছিলই। এবং সিদ্ধার্থর স্ত্রী বাবলিও সেটা জানতেন। যদিও সোমবার এই বাবলিই দাবি করেছিলেন, ঘটনাটা তিনি টেলিভিশন দেখে জেনেছেন। স্বামীর অতীত সম্পর্কে তাঁর কিছু জানা ছিল না।

কিন্তু সেই বাবলি এ দিন স্বীকার করেছেন, তাঁর স্বামীর ওই দুই সন্তানের কথা নিজের বিবাহিত জীবনের গোড়া থেকেই জানতেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘সিদ্ধার্থ আমাকে ঠকায়নি। আমার কখনও কখনও কষ্ট হতো। কিন্তু বাধা দিইনি। সন্তানস্নেহ কী তা আমি জানি, তাই অন্য কাউকে তা থেকে বঞ্চিত করব কী ভাবে?’’ বাবলির এক বান্ধবীও এ দিন জানিয়েছেন, সিদ্ধার্থের আগের ছেলেমেয়ের কথা বাবলি বহু বছর ধরেই জানতেন। ওই বান্ধবীর কথায়, ‘‘ওদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এতটাই শক্তপোক্ত যে এত বড় সত্যটা গোপন থাকার কথা নয়।’’ বাবলি সবটাই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি নিজের ছেলের জন্য ওঁর মনে একটা ভয়ও ছিল। ওই বান্ধবীর কথায়, ‘‘কোনও ভাবে নিজের ছেলে যেন সিদ্ধার্থের স্নেহ থেকে বঞ্চিত না হয় সেটাই নিশ্চিত করতে চাইত বাবলি।’’ সিদ্ধার্থর এক বন্ধু এ দিন জানিয়েছেন, শিনার সঙ্গে সিদ্ধার্থ নিজে যোগাযোগ রাখলেও

শিনা যেন বাড়িতে ফোন না করে বা চিঠি না লেখে সেটা তাকে বলে দেওয়া ছিল। ‘‘সিদ্ধার্থ খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ। বাড়িতে এ নিয়ে কোনও টেনশন ও চাইত না।’’ সিদ্ধার্থদের এক পুরনো প্রতিবেশী বলেন, ‘‘বাবলি, বাবলির মা-বাবা, দিদি সকলেই সিদ্ধার্থের পুরনো সম্পর্ক ও সন্তানের কথা জানতেন। ক’বছর আগেও ছুটিছাটায় সিদ্ধার্থ অসমে যেতেন। মেয়ের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ ছিল বলেই মনে হয়।’’

কিন্তু আগে সে কথা কেন গোপন করলেন? এ প্রশ্নে এ দিন নিরুত্তরই থেকেছেন দাস দম্পতি। মঙ্গলবার থেকে সংবাদমাধ্যমের নানা প্রশ্ন, চেনা-অচেনা মানুষের অজস্র কৌতূহলে বিপর্যস্ত অবস্থা তাঁদের। এ দিন ভোরে সকলের অলক্ষে ঘর ছাড়েন তাঁরা। এক ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী জানান, এ দিন ভোরবেলা বাবলি তাঁকে ফোন করে বলেন, ‘‘মানুষ কী চাইছে? আমাদের মেরে না ফেলে কি কারও কৌতূহল মিটবে না?’’ তার পরে বাবলিদের সঙ্গে তাঁর আর কথা হয়নি বলে জানান ওই প্রতিবেশী। বলেন, ‘‘বাবলি আর ফোন ধরছে না। আমাদের একটাই ভয়, এই ঝড়ঝাপটায় তিন জনের সুন্দর সংসারটা না ছারখার হয়ে যায়!’’ বস্তুত এই ভয় ওই দম্পতির পরিচিত প্রায় সকলেরই। বিয়ের পর বাবলি ও সিদ্ধার্থ যেখানে প্রথম ভাড়া থাকতেন, সেখানকার বাসিন্দারাও জানিয়েছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক খুবই গভীর। চরম দারিদ্রেও কখনও অধৈর্য্য হননি তাঁরা। বর্তমান সঙ্কটও ঠিকই কাটিয়ে উঠবেন বলে প্রতিবেশীদের আশা। এ দিন দুপুরে সিদ্ধার্থদের বাড়ির পিছনের দিকের খোলা জানলা দিয়ে দেখা যায়, ভিতরে পরিপাটি করে গোছানো বিছানা। কিন্তু ঘরে কেউ নেই। সন্ধ্যায় জানা যায়, সিদ্ধার্থ পুলিশের সঙ্গে মুম্বই গিয়েছেন। তার আগে অবশ্য আনন্দবাজারের সঙ্গে তাঁর কথা হয়।

আগের দিন ইন্দ্রাণী পুলিশকে বলেছিলেন, মিখাইল দত্তক সন্তান। সিদ্ধার্থ কিন্তু এ দিনও বলেন, মিখাইল তাঁর আর ইন্দ্রাণীর সন্তান। তাঁর কথায়, ‘‘ইন্দ্রাণী কী বলেছে তা আমি জানি না। জানতে চাইও না।’’ বুধবার মুম্বই পুলিশি যখন জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছিল তখন তাদেরও এ কথাই বলেছেন বলে জানান সিদ্ধার্থ। তিনি বলেন, ‘ইন্দ্রাণীর বাবা-মা কেমন মানুষ, তাঁর সঙ্গে বাড়ির বাকিদের কেমন সম্পর্ক ছিল সবটাই জিজ্ঞাসা করেছে।’’ পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন পিটার বা সঞ্জীব খন্নার সঙ্গে ইন্দ্রাণীর যোগাযোগ ছিল কি না সেটাও জানতে চাওয়া হয়। সিদ্ধার্থ জানিয়েছেন, তিনি দুজনের কাউকেই চিনতেন না।

এ দিন সঞ্জীবের এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মুম্বই পুলিশ। তাঁর মধ্য কলকাতার অফিসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রের খবর, ব্যবসায়ীর বাড়ি কলকাতায় হলেও তাঁর ব্যবসা মুম্বইয়ে। সঞ্জীবকে জেরা করেই ওই বন্ধুর সন্ধান মিলেছে্। তিনি শিনা হত্যায় কোনও ভাবে সঞ্জীবদের সাহায্য করেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters Babli Seena Bora MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE