খেলাঘর: দিল্লির মদনগিরি খাদানে রোহিঙ্গা শিশুরা। —নিজস্ব চিত্র।
ঘুরপথে আসা মায়ানমারের সিগারেট মজুত এখানকার নড়বড়ে দোকানগুলিতে। বাক্সে বড় যত্ন করে রাখা রয়েছে সে দেশের দু’চারটে নোট। যে ভাষায় কথাবার্তা চলছে নিজেদের মধ্যে সেটিও হিন্দি মেশানো রাখাইন প্রদেশের কথ্যভাষা।
কিন্তু দিল্লির মদনগিরি খাদানের এই কলোনিবাসীদের মায়ানমার দূরস্থান, কোনও দেশই নেই। যেটা রয়েছে, তা হল চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক এবং ক্ষোভ।
এগারোশো গজের মাছি ভনভন জমিতে রাজ্যের আবর্জনা, নেড়ি কুকুরের সঙ্গে সহাবস্থান করছেন রোহিঙ্গারা। যাঁদের কেউ তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছেন রাখাইন প্রদেশ থেকে, কেউ বা পেট চালাতে না পেরে চলে এসেছেন কক্সবাজার অথবা নদিয়া জেলা থেকে। এখানে আপাতত এঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে জাকাত ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। প্রায় ৬০টি শিশুকে স্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছে এই সংস্থা।
‘‘আপনারা তো আসবেন কথা বলবেন, ফিরে গিয়ে লিখবেন আমরা আতঙ্কবাদী। জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। আসলে আমাদের দিয়ে যে কোনও রাজনৈতিক দলেরই তো কোনও কাজ হয় না। তাই খেদিয়ে দিতে নানা রকম যুক্তি সাজানো হচ্ছে,’’ বললেন এখানকার ‘কমিউনিটি লিডার’, মহম্মদ হারুন। ক্ষোভ আর স্মৃতি একই সঙ্গে খেলছে তার দুঃস্থ মুখের জ্যামিতিতে। বলে চলেন, ‘‘বাপ-দাদার ৪ কাঠা জমি ছিল জানেন মায়ানমারে। দু’তলা বাড়ি। এক দিন মিলিটারি ঢুকে এমন মারল পনেরো দিন উঠতে পারিনি। আমার দোষ, মুরগি ধরে নিয়ে যেতে চাওয়ায় বাধা দিয়েছিলাম। তার পরে আর থাকা গেল না। গেলাম নদিয়া জেলায়। সেখানেও মজদুরি করে পেট চলে না। অতএব এখানে।’’
আরও পড়ুন:সন্ত্রাসের দায়মুক্ত হাফিজ, উদ্বেগ ভারতের
এখানেও আর কত দিন? সেই অনিশ্চয়তায় এখন রাত কাটছে কলোনির। উৎখাতের জন্য নোটিস জারি করেছিল কেন্দ্র। পাল্টা সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছেন রোহিঙ্গারা। তাঁদের হয়ে লড়ছেন প্রশান্তভূষণ বিনা পয়সায়। ‘‘তবে কত দিন এখানে টিঁকে থাকতে পারব জানি না,’’ বলছেন মহম্মদ সালিমুল্লা। কক্সবাজার থেকে আসার সময় যা-কিছু নিয়ে আসতে পরেছিলেন, তা দিয়ে একটি কোনও রকমে একটা মণিহারি দোকান দাঁড় করিয়েছেন। বলছেন, ‘‘জাকাত ফাউন্ডেশনের দয়ায় আমাদের ছেলেরা এখানকার স্কুল জ্ঞানদীপ বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হয়েছে। ওখানেই অন্যদের মুখে কিছু শুনে থাকবে। এক দিন এসে আমায় বলছে, বাবা আমার ঘর কোথায়? জবাব দিতে পারিনি।’’
সরু সরু গলি, বাঁশের মাচায় ছোঁড়া চট আর কাপড়ের জোড়াতাপ্পিতে যেন পুতুলের সংসার। আপাতত ৫৭ পরিবারের ২৩০ জন মানুষের কাছে এটাই ‘দেশ’। ‘‘মায়ানমার বা বাংলাদেশের তুলনায় এখানে ভাল আছি। এ দেশের মানুষের মনে তা-ও দরদ আছে’’ বলছেন বছর পঁচিশেকের আব্দুল করিম। পেশায় জনমজুর।
কিন্তু দিল্লির বুকে এই ‘বিন্দু বিন্দু জীবনযাপন’ গৃহহীন, স্বজনহীন, রাষ্ট্রহীন মানুষদের। উদ্যত খাঁড়ার নীচে। দীর্ঘদিন ‘ভাল থাকা’ যে কপালে নেই তা জানে এই মহল্লা। সামনে বিপদ আসতে পারে, আঁচ পাচ্ছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy