Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হিন্দু শবযাত্রীদের জন্যই জীবনপণ শাহনুরের

গত তিন দশকে খুব কম দিনই রাতে টানা ঘুমিয়েছেন শাহনুর বেগম। রাতবিরেতে জানলা ভেদ করে ভেসে আসে হিন্দু শবযাত্রীদের ‘বল হরি, হরিবোল’ ধ্বনি। তন্দ্রা ভেঙে যায় কর্তব্যের টানে। শীত হোক বা বর্ষা—শান্তিপুরের ‘শান্তিবন’ শ্মশানের ভরসা শাহনুর বেগমকে এক ডাকে চেনে আশপাশের গাঁ-গঞ্জের মানুষ! ‘অসিষ্ণুতা’ যখন নিত্যদিনের সংবাদ-শিরোনাম, তখন অখ্যাত গ্রামের কোনও এক শাহনুরের জীবন কেটে যায় হিন্দুদের শ্মশানঘাটে কাঠ জোগাতে, ফুল ফোটাতে।

শাহনুর বেগম

শাহনুর বেগম

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৪
Share: Save:

গত তিন দশকে খুব কম দিনই রাতে টানা ঘুমিয়েছেন শাহনুর বেগম। রাতবিরেতে জানলা ভেদ করে ভেসে আসে হিন্দু শবযাত্রীদের ‘বল হরি, হরিবোল’ ধ্বনি। তন্দ্রা ভেঙে যায় কর্তব্যের টানে। শীত হোক বা বর্ষা—শান্তিপুরের ‘শান্তিবন’ শ্মশানের ভরসা শাহনুর বেগমকে এক ডাকে চেনে আশপাশের গাঁ-গঞ্জের মানুষ! ‘অসিষ্ণুতা’ যখন নিত্যদিনের সংবাদ-শিরোনাম, তখন অখ্যাত গ্রামের কোনও এক শাহনুরের জীবন কেটে যায় হিন্দুদের শ্মশানঘাটে কাঠ জোগাতে, ফুল ফোটাতে।

নগাঁও জেলার ডিমরুগু়ড়ির বাসিন্দা শাহনুরের বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সে। স্বামী তোবিউল হুসেন মাছ বিক্রেতা। নিবাস গোলাঘাটের তিন নম্বর ওয়ার্ড, শান্তিপুর এলাকার জানপুর গ্রামে। বিয়ের পরেই শাহনুর দেখেন তাঁদের বাড়ি শ্মশানঘাটের গা ঘেঁষে। আশপাশে কোনও বাড়িও নেই। তাই তাঁদের ধর্মপরিচয় না জেনেই দিনভর শ্মশানে আসা মানুষজন কখনও জল, কখনও কাঠ কাটার জন্য কুড়ুল, কখনও বা বালতি-মগ চাইতে আসতেন। সব দাবি মেটাতেন সদ্যবিবাহিতা কিশোরী। এ ভাবেই শান্তিবন শ্মশানের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন শাহনুর। আগে আবর্জনার স্তূপ জমে থাকত শ্মশানে। একা হাতে সেই আবর্জনা সাফ করে শান্তিবনের ভোল বদলেছেন তিনি।

শ্মশানের পাশে দাঁড়িয়ে শাহনুর বলেন, ‘‘কত অসহায় অবস্থায় মানুষ শ্মশানে আসে। একে স্বজন হারানোর দুঃখ, তার উপরে এত নিয়মকানুন, সরঞ্জাম। লেখাপড়া না শিখলেও, মানুষ হিসেবে তাঁদের পাশে না দাঁড়ানো যে অন্যায় হতো সেটা বুঝতাম। তাই আর পিছন ফিরে তাকাইনি। ভাবিনি ধর্মীয় অনুশাসনের কথা। শ্মশানে আসা মানুষকে সাহায্য করায় আমার কোনও ক্লান্তি নেই।’’ শাহনুরের পরিবারও এখন তাঁর কাজের শরিক। স্বামী তোবিউলের কথায়, ‘‘মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই বড় ধর্ম। শাহনুর সেটাই করে। তাই বাধা দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না।’’ গভীর রাতে শবদেহ এলেও নির্ভীক শাহনুর একলাই বেরিয়ে পড়েন। কাঠের জোগাড় করা থেকে দাহ শেষে শ্মশানঘাট পরিষ্কার করা পর্যন্ত তার ছুটি নেই। আমরাও এখন সাধ্যমতো হাত লাগাই।’’

৪৫ বছরের শাহনুর বেগম এখন এক পুত্র ও দুই কন্যার মা। ছেলে ফিরোজ, মেয়ে সুমিরাও মায়ের পথে হেঁটে শ্মশানঘাট পরিচ্ছন্ন রাখছে। অনেক সময়ই মৃতের পরিবার শাহনুরকে টাকা দিতে চায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত দাহকার্যে সাহায্য করার জন্য কারও কাছ থেকে টাকা নেননি শাহনুর। শান্তিবন শ্মশান কমিটির সাধারণ সম্পাদক লখি সিংহ গগৈ বলেন, ‘‘১৯৮৬ সাল থেকে এক হাতে শ্মশান দেখভাল করা ওই দরিদ্র পরিবারকে একাধিবার অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এমনকী শ্মশান সাফ রাখার বিনিময়ে শাহনুরকে মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু সব প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। শুধু জেলা নয়, গোটা রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির জীবন্ত নির্দশন শাহনুর।’’

সংখ্যালঘু প্রধান জানপুরের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকেও বাধা পাননি শাহনুর। তাঁর কথা জেনে প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁকে সম্বর্ধনা দেন জেলাশাসক আনোয়ার-উল-হক। সভায় প্রথমে আসতেই চাননি শাহনুর। শেষ পর্যন্ত গ্রামের মানুষের চাপে মঞ্চে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘‘সবাই সবার পাশে দাঁড়ালে সম্প্রীতির জন্য মিটিং-মিছিলের প্রয়োজন হয় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE