শিলচর কালচারাল ইউনিট তাদের ৩৭-তম বর্ষপূর্তি পালন করল। ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা। দু’টি নাটক মঞ্চস্থ করা হল। সম্মান জানানো হল নাট্যচর্চায় নিবেদিত-প্রাণ চামেলি কর, পঙ্কজ পুরকায়স্থ, রন্টু বাগচি, আশিস ভৌমিক এবং লোক-গবেষক তুষারকান্তি নাথকে। এমন ছোটখাট উদ্বোধনী পর্বই নাট্যসংগঠনের কাছে প্রত্যাশিত। দর্শক উপস্থিতিও ছিল উৎসাহজনক।
সন্ধ্যার প্রথম নাটক গণসুরের ‘উড়োমেঘ’। নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়, পরিচালনায় সুব্রত (শম্ভু) রায়। এক আপাদমস্তক স্ত্রৈণ আইন ব্যবসায়ী মনে করেন, তাঁর স্ত্রী শুধু সর্ববিরাজমানা নন, সর্বদ্রষ্টাও বটে। স্ত্রীর অবর্তমানে তার ছবিই তাঁকে পরিচালিত করতে পারে। ঘটনাচক্রে তিনি আবিষ্কার করেন, তাঁর মধ্যেও ঈর্ষা কাজ করে। মানবমনের আঁধারটুকু স্পষ্ট করে তুলতে নাট্যকার এক মজাদার পরিস্থিতি তৈরি করেন। হাসতে হাসতে আমরা মেনে নিই, নানান ভুলভ্রান্তি সম্বলিত, কান্নাহাসিতে ভরপুর আমাদের মানবজীবন। পৌষ-ফাগুনের এই জীবনপঞ্জিকায় সম্পূর্ণ সংলাপনির্ভর একটি জীবনরঙ্গ। চরিত্র মাত্র দু’টি। যাঁদের উপর নাটকের দাবি খুব বেশি। তাঁদের প্রতিটি সেকেন্ড, হাঁটাচলা-নড়াচড়া অনেকক্ষেত্রে অভিনয়ের পরিপূরক আঙ্গিক হিসেবে ধরা দেয়। এই নাটকে সুব্রত রায় ও রুমা রায় সেই সময়জ্ঞান, কণ্ঠস্বরের ওঠানামার সৌকর্যে নাটকটিকে সত্যি প্রমাণ করিয়ে দেন। এই ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয়, মঞ্চে দু’জনের বোঝাপড়া আসলে জীবন থেকে নেওয়া। তাই নাট্য পরিস্থিতি তার সম্পূর্ণ দাবি মিটিয়ে নিয়েছে। গানগুলির ব্যবহার যথাযথ, যদিও কখনও সামান্য উচ্চকিত মনে হচ্ছিল। আর শেষমুহুর্তে ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না’ গান (ড্রয়িং রুমের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে মনে হয়েছে পুনরাগমন হয়েছে) পরিচালক একটু পিছনে রাখুন, শিবশম্ভুর ড্রয়িং রুম ছাড়িয়ে সেটা সর্বজনীন হবে বলে বিশ্বাস। সুজিত পানের সেট কখনও বোঝা হয় না। ওটা বুঝতে হয়। এখানেও তাই। নাটকের শুরুতে আলো ছাড়াই স্ত্রীর ছবি দেখেন শিবশম্ভু। নাট্যের শেষে আবার একই পরিস্থিতি। এ বার ছিল আলোর ঝর্ণাধারা। দুটোতেই আলোর সামঞ্জস্য থাকলে ভালো হতো। বাকি সব জায়গায় ফুলমার্কস।
একই সন্ধ্যার দ্বিতীয় নাটক ‘সোপান’ অনুষ্ঠানের আয়োজক শিলচর কালচারাল ইউনিটের। রচনা-নির্দেশনা শেখর দেবরায়। মানবজীবনের একমাত্র ধ্রুবসত্য হচ্ছে মৃত্যু, শেখর এই সত্যকে দেখাতে চেয়েছেন। সেই দেখার সপক্ষে উঠে এসেছে লোকজীবনের অনুভব। এসেছেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এবং রবীন্দ্রনাথ। শেখর জানিয়েছেন, ‘সব মরণ নয় সমান।’ কোনটা হালকা পালক, কোনওটা পাথরের মতো ভারি। ‘রক্তকরবী’তে রঞ্জন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঘুমভাঙানির গান গেয়েছে। তার মৃত্যুতে হত্যাকারী রাজা নিজেই ভেঙে চুরমার। অফুরন্ত প্রাণ, প্রেম ও প্রকৃতির প্রতিমূর্তি ‘নন্দিনী’ জানে রঞ্জনের পুনরাগমন কেবল সময়ের ব্যাপার। ফলে ফোকাসটা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রাণের অনন্ত জয়যাত্রায় কেন্দ্রীভূত।
সেই একই বিশ্বাসে শেখর প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ডাকঘর’-র অমলকে কে নিয়ে গেল মৃত্যু না মুক্তি। নাকি এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এক শ্রান্তিহীন শান্তি। ধ্রুবতারার আলোয় পথ চিনে অমল-শিশুটি লৌকিক ও শাস্ত্রের বন্ধনে জীর্ণসমাজকে পেরিয়ে গেল। এমনকী মর্ত প্রেমের উজ্জ্বল প্রকাশ যে সুধা সেও নিজহাতে আর ফুল দিতে পারল না। ফুলের তাজমহল তুলে দিল ফকিরবেশী ঠাকুর্দার হাতে। জীবনপত্রের সাদা পাতায় ঠাকুর্দা ও অমল পড়তে পারে রাজার আমন্ত্রণ-- সেই তার জয়। পার্থিব কোনও বন্ধন তাকে অসীম থেকে আর বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।
অন্যদিকে, পিতৃতুল্য ডানকান হত্যার পেছনে যার হাত সবচেয়ে বেশি সক্রিয়, সেই লেডি ম্যাকবেথ আত্মহননের মাধ্যমে মুক্তি পেতে চাইছে অসহ্য পাপবিদ্ধ মানসিক চাপ থেকে। জীবনকে স্বার্থপরতার কালো অক্ষরে পাঠ করা এই দম্পতি কৃতকর্মের প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে দিতে প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠছে। মৃত্যুর পরাক্রমে এখানে জীবনের পরাজয় রচিত হচ্ছে। আবার এই মৃত্যুমিছিলে কোনওটাই অবাস্তব নয়।
অত্যন্ত কঠিন সত্যের এই তত্ত্বকে নাট্যক্রীড়ায় নিয়ে আসাটা আরও কঠিন কাজ। কিছু ছবির কোলাজ দেখাতে চেয়েছেন নাট্যকার পরিচালক। পরিচিত ও বিচ্ছিন্ন নাট্যাংশে সাসপেন্স থাকার কথা নয়। তবে নাট্যক্রীড়ায় কাঙ্ক্ষিত গতি কিছুটা স্তিমিত থাকায় বিষয়বস্তু ভারি ভারি হয়ে উঠেছিল। যে ‘সেট অব অ্যাক্টরস’ দুটো ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কাজ করলেন সেখানে চরিত্রানুগ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে কম। একই নাটকের দুটি দৃশ্যের মত অভিন্ন কিছু ছবি ও চরিত্রাভিনয় বক্তব্যকে পরিস্ফুট করলেও অভিনয়ের জায়গাটা সুচারু হয়ে ফুটে ওঠেনি। যদিও বুঝি, এটা প্রথম পরিবেশনা।
আলো অন্তত ‘রক্তকরবী’র জালের ফ্রেমকে গুরুত্ব দিতে পারত। কারণ তারই পেছনে অদৃশ্য রাজা, সামনে মৃত রঞ্জন। আর লেডি ম্যাকবেথকে অরিজিনাল জেন্ডার ভাববেন না পরিচালক? ডাকঘর অধ্যায়ে অমলকে একটু সামনে আনা দরকার ছিল। নয়তো বেশির ভাগ সংলাপে (অমলকে উদ্দেশ্য করে যেহেতু) অভিনেতাদের পেছনটাই পাচ্ছিলেন দর্শকরা। রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি সু-গীত। এবং আন্তরিক শুভেচ্ছা নন্দিনীকে, অমলকে। সবশেষে বলার হল, মাধব দত্তের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। নাটকে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবস্থা তো ভালো নয়।’ কিন্তু অমলের জানালা বোঝাতে যে আর্টটা ছিল, সে যেন মোড়লের বাড়ি থেকে ধার করা। ১৯৯৭ সালে জোড়াসাকোর বিচিত্রাভবনের অভিনয় মঞ্চে গৃহীত ফোটোগ্রাফটিতে দেখাচ্ছে খড়ের চাল, সাধারণ আসবাব, শূন্য পাখির খাঁচা। বড়ই অর্থবহ।
তবু এক কথায় বললে, চিন্তনীয় প্রয়াস। বহু পরিবেশনায় সফল হয়ে উঠবে সব ও সবাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy