প্রথমে উৎফুল্ল হয়েও পরে চুপসে গেলেন তৃণমূল সাংসদরা!
বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তখন বলছেন, “চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ থেকে সর্বাধিক লাভবান হতে চলেছে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ। তা সত্ত্বেও পূর্বের রাজ্যগুলিকে আরও দ্রুত বৃদ্ধির সুযোগ করে দেওয়া দরকার। তাই অন্ধ্রপ্রদেশকে যে রকম বিশেষ সহায়তা দেওয়া হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারকে ঠিক সেই রকম বিশেষ সহায়তার প্রস্তাব করছি।”
শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলবল। তাঁদের ধারণা ছিল, নগদ টাকা আসতে চলেছে রাজ্যের কোষাগারে। বিশেষত যখন আর্থিক সুরাহার দাবি নিয়েই ক’দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করতে আসার কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
অচিরেই সেই ‘ভুল’ ভাঙে।
বাজেটের পরে জেটলি জানান, পশ্চিমবঙ্গে নতুন শিল্প বা উৎপাদন ইউনিট স্থাপনের জন্য অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ করে ‘ইনভেস্টমেন্ট অ্যালাওয়েন্স’ ও যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ‘ডেপ্রিসিয়েশন অ্যালাওয়েন্স’ দেওয়া হবে। আগামী অর্থবর্ষ থেকে শুরু করে আগামী পাঁচ বছর এই সুবিধে পাবে দুই রাজ্য। এই ব্যাখ্যা শুনেই সম্বিত ফেরে তৃণমূল সাংসদদের। তাঁরা বুঝতে পারেন, মমতার ব্যাটের মুখে মোক্ষম গুগলি ফেলেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। কারণ, একে তো এই সহায়তায় নগদ টাকার কোনও গল্প নেই। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে কোনও সংস্থা বিনিয়োগ করলে সে ক্ষেত্রেই ওই অ্যালাওয়েন্সের প্রশ্ন উঠছে। তা পাবে সংশ্লিষ্ট শিল্প সংস্থা। এক দিক দিয়ে দেখলে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে শিল্প গড়ার অস্ত্রই তুলে দিয়েছেন জেটলি। কিন্তু সমস্যা হল, তৃণমূল সরকারের জমি ও সামগ্রিক নীতির কারণে এই রাজ্যের থেকে আগেই মুখ ফিরিয়েছেন অধিকাংশ নতুন বিনিয়োগকারী।
এই মর্মার্থ উপলব্ধি করেই চুপসে যান তৃণমূল সাংসদেরা। রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনকে বলতে শোনা যায়, “বিহার বা বাংলাকে কোনও প্যাকেজই দেননি অর্থমন্ত্রী। সবটাই বুজরুকি। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম অন্ধ্রের মতো সাড়ে আটশো কোটি টাকা পাবে পশ্চিমবঙ্গ। যদিও সেই টাকাটাও পশ্চিমবঙ্গের দাবির তুলনায় কম। এখন ভাল করে বাজেটটা দেখার পর বুঝতে পারছি, কেন্দ্রের চালাকিতে সেটুকু টাকাও পাওয়া যাবে না।”
তাৎপর্যপূর্ণ হল, ডেরেকের মতো এমন হতাশ প্রতিক্রিয়া দেননি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। বিশেষ আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকারের পাশাপাশি বিহারে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এইমস)-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার ঘোষণা হয়েছে আজকের বাজেটে। যা শুনে নীতীশ আজ বলেছেন, “রাজ্য পুনর্গঠনের পর স্বাভাবিক নিয়মে বিহারের যা পাওয়া উচিত ছিল, বাজেটে তা-ই দেওয়া হয়েছে। এটা ইতিবাচক।” তিন দিন আগে জেটলির বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে নৈশভোজ করেছিলেন নীতীশ। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, কেন্দ্রের কাছ থেকে এটুকুও যে তিনি আদায় করতে পেরেছেন, সেটাই রাজনৈতিক ভাবে তুলে ধরতে চাইছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী।
একই মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। তাঁরা মনে করছেন, অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার নেপথ্যে যত না অর্থনৈতিক উন্নতির তাড়না রয়েছে, তার চেয়ে বেশি নিহিত রয়েছে রাজনীতি। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ প্রকাশের পরেই জেটলি বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের ঋণের
সমস্যা থাকবেই। কারণ, কমিশনের সুপারিশেই বলা হয়েছে, রাজ্যের মোট ঋণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ঋণের পরিমাণ খুব সামান্য। বরং ক্ষুদ্র আমানতকারীদের থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ বেশি। তাই ঋণ পুনর্গঠন করার জায়গা খুবই সীমিত। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতার কথা মেনে নিয়েও জেটলি সে দিন এবং আজ এই বার্তাই তুলে ধরতে চেয়েছেন যে, অর্থ কমিশনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হচ্ছে। কয়লা খনি নিলামের মাধ্যমেও রাজ্যের কোষাগারে যে বিপুল অর্থ আসছে। জেটলির বক্তব্য, এর পরেও প্রধানমন্ত্রী পূর্বের রাজ্যগুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে চান। তাই আগ বাড়িয়ে বিশেষ সহায়তার কথা বলা হল। আর এখানেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আসলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রভাব বিস্তারের জমি তৈরি করে রাখলেন। এর পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ টানতে সফল না হলে বা কর কাঠামোর সংস্কার করে আর্থিক শৃঙ্খলা কায়েম করতে না পারলে সেটাই হবে বিজেপির অস্ত্র।
দেরিতে হলেও সেই কৌশল আঁচ করেছে তৃণমূলও। বিকেল থেকে তাদের দুই কক্ষের নেতারাই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। লোকসভার সাংসদ সৌগত রায় বলেন, “অর্থমন্ত্রী গোটা দেশকে বিভ্রান্ত করছেন। বারবার বলছেন, কেন্দ্র বাড়তি অর্থ দিচ্ছে। অথচ ঘটনা হল, আগে ৬১.৮৮ শতাংশ টাকা দিত কেন্দ্র। এখন দেবে ৬২ শতাংশ। বাড়তি অর্থের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?” অন্য দিকে ডেরেক বলেন, “চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে রাজ্যকে যেমন অনুদান দিয়েছে কেন্দ্র, তেমনই মাছের তেলে মাছ ভাজার ব্যবস্থাও করেছে। কেন্দ্রীয় অনুদানে চলা ১৫টি প্রকল্পে এ বার টাকা বন্ধ করে দিতে চলেছে তারা। পরিবর্তে ওই সব প্রকল্পে রাজ্যকে খরচ করতে বলছে। এর মধ্যে যেমন পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে, তেমনই রয়েছে পুলিশের আধুনিকীকরণ, মডেল স্কুল নির্মাণ, পর্যটন পরিকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি।”
তবে প্রকাশ্যে এই সব সমালোচনা করলেও ঘনিষ্ঠ মহলে পশ্চিমবঙ্গের সরকারের ওপর ক্ষোভই জানিয়েছেন তৃণমূল সাংসদদের একাংশ। তাঁদের মতে, বাজেটের আগে নীতীশ ছাড়াও অন্ধ্র, ওড়িশা, কর্নাটকের মতো অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রীরা জেটলির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কেন্দ্রের কাছে নিজেদের রাজ্যের দাবি-দাওয়া পেশ করেছিলেন তাঁরা। আজকের বাজেটে সেই সব রাজ্যের জন্য কোথাও নতুন বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, কোথাও হাসপাতাল, কোথাও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের একটি সূত্রই জানাচ্ছে, নীতীশের সঙ্গে জেটলির নৈশভোজ-বৈঠকের সময় বাজেটের নথি ছাপতে চলে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও জেটলি এই বিশেষ আর্থিক সহায়তার বিষয়টি তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
অথচ এই উদ্যোগটাই দেখা যায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর অনুগত অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের মধ্যে। অমিতবাবু আজ বলেছেন, “অন্ধ্রকে ৮৫০ কোটি টাকার মতো প্যাকেজ দিয়েছিল কেন্দ্র। যদি ওই টাকা দেয়, তা দুই রাজ্যের মধ্যে ভাগ হবে। যা নামমাত্র।” অথচ বাজেটের আগে দিল্লিতে অর্থমন্ত্রীদের বৈঠক এড়িয়ে গিয়েছিলেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। রাজ্যের বিরোধীদের বক্তব্য, মমতাও যে এখন মোদীর সাক্ষাৎ চাইছেন, সেটা সারদা নিয়ে প্যাঁচে পড়ে। মাত্র ক’দিন আগেও নীতি আয়োগের বৈঠক বয়কট করেন তিনি। অর্থ মন্ত্রকের এক আমলার মতে, এ সবেরই হাতেনাতে ফল পেল পশ্চিমবঙ্গ। তাই এ বারের বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তি কার্যত শূন্য। রাজ্যের হতাশ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গ মেধার পীঠস্থান। এই রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থেই পশ্চিমবঙ্গে আরও কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উৎকর্ষ কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার।”
গত জুলাইয়ে কল্যাণী-সহ চারটি নতুন এইমস-এর জন্য ৫০০ কোটি বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্র। তার এক পয়সাও খরচ করতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ। এ দিন নতুন ও পুরনো এইমস মিলিয়ে যে ১৭৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব হয়েছে, তাতে কল্যাণীর জন্যও টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু জমি-জটে জেরবার রাজ্য এ বারেও কিছু করতে পারবে কি না, স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাই সংশয়ে।
রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে বলেন, “কল্যাণীতে ১৫০ একরের দু’টি জমি পছন্দ করে দিল্লিকে জানানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের টেকনিক্যাল টিম এবং এক জন যুগ্মসচিব জমি দেখেও গিয়েছেন। তার পর ওঁরা কিছু জানাননি। জানালেই জমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে।” তবে রাজ্যের শিক্ষা-স্বাস্থ্য অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আগে কল্যাণীটা চালু হোক। এইমস-এর মতো নতুন কোনও হাসপাতালের কথা ভাবছি না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy