সাইক্লোনের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত শিলচর। উপড়ে গিয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। শুক্রবার স্বপন রায়ের তোলা ছবি।
আধঘণ্টার ঝড়ে বিপর্যস্ত শিলচর। গাছপালা ভেঙে তছনছ। ভেঙেছে বহু ঘরবাড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি। বিদ্যুৎ ও পানীয় জল সরবরাহ বন্ধ। বিঘ্নিত স্বাস্থ্য পরিষেবাও। বিদ্যুত-বিচ্ছিন্ন শিলচর শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আজ অস্ত্রোপচার, এক্স-রে, সোনোগ্রাফি, এমআরআই করাই যায়নি। এনডিআরএফ ও এসডিআরএফ জওয়ানরা গাছ কেটে রাস্তাঘাট চলাচলের উপযোগী করছেন।
ঝড় একই রকম দাপট দেখিয়েছে গ্রামীণ কাছাড়েও। কাটিগড়ার ফুলবাড়ি, গণিরগ্রাম এলাকা ফের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দুধপাতিল, তোপখানা, তাপাঙ, রামনগর, উধারবন্দ, মাসিমপুর, ইঅ্যান্ডডি কলোনি, লক্ষ্মীপুরের দিলখুশ অঞ্চলেও। বড় বড় গাছ পড়েছে মেডিক্যাল কলেজের রাস্তায়। ভেঙেছে বিদ্যুতের খুঁটিও।
জেলাশাসক এস বিশ্বনাথন আজ বেলা সাড়ে ১২টায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিভাগীয় কর্তাদের জরুরি বৈঠকে ডাকেন। বিদ্যুৎ ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে তিনি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করতে নির্দেশ দেন। বনবিভাগকে বিপজ্জনক গাছগুলি চিহ্নিত করে কাটানোর ব্যবস্থা করতে বলেন। কোনও মতেই যেন স্কুলগুলিতে এই সময়ে মিড-ডে মিল বন্ধ না হয়, সে জন্য সতর্ক করে দেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে। অঙ্গনওয়াড়ির ব্যাপারেও বিশ্বনাথন জেলা সমাজ কল্যাণ অফিসারকে একই কথা বলেন।
শহরবাসীকে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় একটি বিশাল গাছ শিলচর জল সরবরাহ প্রকল্পের ৫০০ কেভিএ ট্রান্সফর্মারকে নীচে ফেলে দেওয়ায়। এই প্রকল্প থেকেই শহরের ৮০ শতাংশ এলাকায় জল সরবরাহ করা হয়। বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার নষ্ট হওয়ায় এক দিকে জল তোলা বন্ধ। অন্য দিকে, বিভিন্ন রিজার্ভারে জমা জলটুকুও বন্টন করা যাচ্ছে না। এসডিআরএফ সকাল থেকে গাছ কেটে সরিয়ে দেওয়ার কাজে লেগে পড়ে। দুপুরের মধ্যে তারা কাজ শেষ করে। প্রকল্পটির দায়িত্বে থাকা অ্যাসিস্ট্যান্ট এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অমিতাভ চৌধুরী জানিয়েছেন, বিদ্যুত বিভাগ ট্রান্সফর্মার বসানো, খুঁটি মেরামত করা ইত্যাদি কাজ সেরে বিদ্যুত দিলেই জল সরবরাহ শুরু করা হবে।
বিদ্যুত বিভাগের পক্ষে যে এই কাজটি মোটেও সহজ নয়, তা জানিয়েছেন মধ্য অসম বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানির দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার নিরঞ্জন পাল ও দীপঙ্কর নাথ। নিরঞ্জনবাবু মূলত শহরাঞ্চল দেখভালের দায়িত্বে। গ্রামীণ এলাকার বিদ্যুত পরিষেবা দীপঙ্করবাবু দেখেন। নিরঞ্জনবাবু বলেন, ৩৩ কিলোভোল্টের তিনটি লাইনই বিপর্যয়ের শিকার। শহরের এমন কোনও রাস্তা নেই যেখানে গাছ পড়েনি। ইটখলা, জেল রোড, আসাম রাইফেলস রোড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভেন্যু, পুলিশ গেস্ট হাউস এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটির ক্ষতি হয়েছে, তার ছিঁড়েছে। বেশ কিছু জায়গায় ট্রান্সফর্মার ভেঙেছে। সে সব সারাই করে বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক করতে ৫-৬ দিন লেগে যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের জল সরবরাহ প্রকল্পগুলিতে বিদ্যুত জোগানের জন্য সব ধরনের চেষ্টা করে চলেছেন। তিনি আশাবাদী, আগামীকালই ওই সব জায়গায় বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে। সদরঘাট জল-প্রকল্পের ট্রান্সফর্মার বদলানোর কাজও আজই শুরু হয়েছে। দীপঙ্করবাবু বলেন, গ্রাম-গঞ্জে বিদ্যুত পৌঁছতে বেশ ক’দিন লেগে যাবে। কারণ বহু জায়গায় ক্ষতি হয়েছে। প্রথমে মেন লাইন সারাই করতে হবে। এতেই ৩-৪ দিন লেগে যাবে। আর বড় ঝড় না হলে, সব ঠিকঠাক হতে দিন পনেরো লেগে যেতে পারে বলে তাঁর অনুমান।
রাত সোয়া বারোটার ঝড় রেহাই দেয়নি কাউকেই। গাছ পড়ে দুর্যোগ মোকাবিলা বিভাগের কন্ট্রোল রুমের সামনে এবং জেলাশাসকের বাংলোর মুখে। খোদ বনবিভাগের কনজারভেটরের অফিসের চালেও গাছ পড়েছে। দু’দিন আগেই এনডিআরএফের একটি সেকশন আইজল থেকে শিলচরে আসে। তাঁদের মূলত হড়পা বানে ভেসে যাওয়া শ্রমিকদের মৃতদেহের সন্ধানে এখানে আনা হয়েছিল। কাল ঝড়ের পর তাদেরও কাজে লাগায় দুর্যোগ মোকাবিলা বিভাগ।
১৩ জনের এনডিআরএফ টিমটির প্রধান ইন্সপেক্টর হনুমান রাম বলেন, এখানে তাঁদের মাসিমপুরের কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে থাকতে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে দুর্যোগ মোকাবিলা কন্ট্রোল রুমে রিপোর্ট করতে ১৩ জায়গায় গাছ কেটে কেটে আসতে হয়েছে। শিলচর দমকল বিভাগে রয়েছেন এসডিআরএফ-এর ৯ জনের একটি দল। কাজে নেমে পড়েছেন তারাও। অতিরিক্ত জেলাশাসক বরেণ্য দাস ও দুর্যোগ মোকাবিলা শাখার প্রোজেক্ট অফিসার শামিম আহমদ লস্কর জানান, এনডিআরএফ
এবং এসডিআরএফ এমন দিনে শিলচরে থাকায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুবিধা হয়েছে। মোটরচালিত করাত-সহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তাঁরা ব্যবহার করেছে। এ ছাড়াও, কাল রাতেই ন্যাশনাল রিমোট সেন্সর সেন্টার থেকে ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। ফলে শামিম আহমেদ রাতেই সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করেন। ফলে আজ ভোর থেকে দল বেঁধে কাজে নেমে পড়া সম্ভব হয়েছে।
জেলাশাসকের ডাকা জরুরি সভায় সাংসদ সুস্মিতা দেব এবং পুরপ্রধান নীহারেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুরও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা দুর্গতদের ত্রাণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে জেলাশাসককে অনুরোধ করেন। জেলাশাসক বিশ্বনাথন জানান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে বিভাগীয় কর্মীদের মাঠে নামানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পরই তিনি সরকারের কাছে অর্থমঞ্জুরির জন্য লিখবেন। তাঁরা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে জল সরবরাহ দ্রুত শুরু করার কথাও বলেন। যতদিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, ততদিন বিকল্প ব্যবস্থাও ভাবতে অনুরোধ করেন। সভায় উপস্থিত বিভাগীয় কর্তারা জানান, দয়াপুর, পানগ্রাম-সহ বেশ ক’টি গ্রামীণ প্রকল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে গ্রামবাসীদের ব্লিচিং পাউডার, ফিটকিরি দেওয়া হবে। বাড়ির জল বিশুদ্ধকরণের পরামর্শ দেওয়া হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy