সরানো হচ্ছে ম্যাঙ্গালোর এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত কামরা। রবিবার কোচির কাছে। ছবি: পি টি আই
বাংলার সর্ডিহা স্টেশনে ছ’বছর আগেকার জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের বিপর্যয় ফের ঘটতে যাচ্ছিল কেরলের কারুকুট্টি স্টেশনে। কোনও ক্রমে রক্ষা পেল ম্যাঙ্গালোর এক্সপ্রেস। বেঁচে গেল মুখোমুখি চলে আসা চেন্নাই-তিরুঅনন্তপুরম এক্সপ্রেসও। জোড়া ট্রেনের যাত্রীরা তাতে স্বস্তি যতটুকু পাচ্ছেন, উদ্বেগ তার থেকে বহু গুণ বেশি। কারণ, রেলের নজরদারি-সহ পরিকাঠামোর দুরবস্থা আবার বেআব্রু হয়ে গিয়েছে শনিবার শেষ রাতে কেরলের ওই ভয়াবহ ঘটনায়।
অর্ধযুগ আগে-পরের দু’টি ঘটনাতেই নজরদারির ঘাটতি প্রকট। জ্ঞানেশ্বরীর ক্ষেত্রে দেখভালের ত্রুটিটা ছিল ষোলো আনা। আর ম্যাঙ্গালোর এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রে নজরদারিটা খণ্ডিত। অর্থাৎ পুরোপুরি দেখভাল না-হলেও আংশিক সতর্কতা ছিল বলে কান ঘেঁষে চলে গিয়েছে বিপদ। প্রশ্ন উঠছে, জ্ঞানেশ্বরীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরেও রেলে নজরদারি ও পরিকাঠামোর এই দুর্দশা কেন?
দু’-একটি নয়, পরপর ১২টি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে মাঝপথে আটকে পড়ে ম্যাঙ্গালোর এক্সপ্রেস। উল্টো দিক থেকে ওই লাইন দিয়ে আসছিল চেন্নাই-তিরুঅনন্তপুরম এক্সপ্রেস। শেষ পর্যন্ত সেই ট্রেন ঘটনাস্থলের ৩০০ মিটার দূরে থেমে যাওয়ায় মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো গিয়েছে। রক্ষা পান দুই এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। শনিবার গভীর রাতে ঘটনাটি ঘটে কোচি থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে কারুকুট্টি স্টেশনের কাছে।
কারুকুট্টির এই দুর্ঘটনায় যাত্রীদের কেউ হতাহত না-হলেও আমযাত্রী এবং রেলকর্তাদের মনে পড়ে যাচ্ছে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার কথা। মাওবাদীরা লাইনের ফিশপ্লেট খুলে দেওয়ায় ২০১০ সালের ২৮ মে গভীর রাতে খড়্গপুর-টাটানগর মেন লাইনের খেমাশুলি ও সর্ডিহা স্টেশনের মাঝখানে লাইনচ্যুত হয় জ্ঞানেশ্বরী। লাইন থেকে চাকা পড়ে যাওয়ায় ট্রেন নেমে যায় পাশের লাইনে। তখনও লাইনচ্যুত কামরার যাত্রীরা অক্ষতই ছিলেন। কিন্তু ৩-৪ মিনিটের মধ্যেই পাশের লাইনে উল্টো দিক থেকে ছুটে আসে একটি মালগাড়ি। আর তার ধাক্কাতেই পড়ে থাকা লাইনচ্যুত জ্ঞানেশ্বরীর ১৪৮ জন যাত্রী বেঘোরে প্রাণ হারান।
জ্ঞানেশ্বরীর ক্ষেত্রে রেলের তরফে নজরদারিতে দু’দফা ঘাটতির অভিযোগ উঠেছিল।
• লাইনের ফিশপ্লেট যে খোলা, নজরদারেরা সেই ব্যাপারে আগাম সতর্ক করে দিতে পারেননি। পারলে বেলাইনই হতো না জ্ঞানেশ্বরী।
• জ্ঞানেশ্বরী যে লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনে পড়ে আছে, সেই বিষয়ে মালগাড়ির চালক-গার্ডকে যথাসময়ে সচেতন করে দেওয়া হয়নি। পরিণাম ব্যাপক প্রাণহানি।
ম্যাঙ্গালোর এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রে ত্রুটি-গাফিলতিটা অর্ধেক বলে মনে করছে রেল মহলের একাংশ। তারা বলছে, তিরুচিরাপল্লির কাছে লাইনে যে ফাটল আছে, সেটা ম্যাঙ্গালোর এক্সপ্রেসকে জানানো হয়নি। তাই শনিবার রাত ৩টে নাগাদ তার ১২টি কামরা বেলাইন হয়ে যায়। তার পরে ওই লাইনে আসা তিরুঅনন্তপুরম এক্সপ্রেসের চালক ও গার্ডকে কোনও মতে সতর্ক করতে পারায় দ্বিতীয় বার জ্ঞানেশ্বরীর মতো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
রেল সূত্রের খবর, প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই লাইনে ফাটল ছিল। কিন্তু ঠিক সময়ে সেটি নজরে না-আসায় তার উপর দিয়ে ছুটতে থাকে ট্রেন এবং অচিরেই বেলাইন হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। গাফিলতি কার, তা খুঁজে বার করতে দক্ষিণ রেলের তরফে তদম্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় লাইন মেরামত করে কামরাগুলিকে ফের লাইনে তোলা হয়। তার পরে আবার শুরু হয় আবার ট্রেন চলাচল। এই দুর্ঘটনার জেরে শনিবার গভীর রাত থেকে তিরুচিরাপল্লি-এর্নাকুলাম রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল দীর্ঘ ক্ষণ। বেশ কিছু মেল, এক্সপ্রেস ও প্যাসেঞ্জার ট্রেন বাতিল করা হয়। আটকে পড়া যাত্রীদের জন্য বিশেষ বাস, খাবার এবং জলের ব্যবস্থা করেছিল রেল।
কিন্তু তাতে নজরদারির ঘাটতি এবং পরিকাঠামোর অভাবের অভিযোগ চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। রেলকর্তাদের অনেকে অবশ্য বলছেন, জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনায় মালগাড়ির চালককে সতর্ক করা যায়নি বলে একই ট্রেনে দ্বিতীয় বার দুর্ঘটনা ঘটে। এখন রেলে যাত্রী-নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তাই শনিবার চেন্নাই-তিরুঅনন্তপুরম এক্সপ্রেসকে মাঝপথে থামানো সম্ভব হয়। তাতেই এড়ানো গিয়েছে বড়সড় দুর্ঘটনা।
সুরক্ষা বন্দোবস্তের কিছুটা উন্নতি যে হয়েছে, সেটাই বোঝাতে চাইছেন ওই রেলকর্তারা। কিন্তু যাত্রীরা পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা কবে পাবেন, রেলের তরফে তার জবাব দেওয়ার কেউ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy