Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
উল্টো পথের পথিক

ঘাটতির লক্ষ্মণরেখা মানলেও অঙ্ক মিলল কই

রাজকোষ ঘাটতি লাগামের বাইরে যেতে দিলেন না। এবং তা করতে গিয়ে তাঁকে কোপ মারতে হল খরচে। একে আয় বাড়েনি। তার উপর সাহস দেখানো যায়নি সে ভাবে ভর্তুকি ছাঁটাইয়ে। আর এই সব কিছুর ফসল হিসেবেই সংস্কারমুখী সাহসী বাজেটের অঙ্ক মেলাতে হিমসিম খেলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

রাজকোষ ঘাটতি লাগামের বাইরে যেতে দিলেন না। এবং তা করতে গিয়ে তাঁকে কোপ মারতে হল খরচে। একে আয় বাড়েনি। তার উপর সাহস দেখানো যায়নি সে ভাবে ভর্তুকি ছাঁটাইয়ে। আর এই সব কিছুর ফসল হিসেবেই সংস্কারমুখী সাহসী বাজেটের অঙ্ক মেলাতে হিমসিম খেলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর অর্থমন্ত্রীর বাজেটকে ‘প্রগতিশীল, ইতিবাচক, বাস্তববাদী ও বিচক্ষণ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু সমালোচকদের প্রশ্ন, বাজেট সে ভাবে সাহসী হতে পারল কই? প্রশ্ন উঠেছে, বাজেটে আয়-ব্যয়ের হিসেবে শেষমেশ কতখানি বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পেরেছেন জেটলি?

চলতি অর্থবর্ষে কর আদায় বিশেষ হয়নি। মাঝ বছরের অর্থনৈতিক পর্যালোচনাতেই দেখা গিয়েছিল, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হওয়ার আশঙ্কা। তা সত্ত্বেও জেটলি রাজকোষ ঘাটতিকে ৪.১ শতাংশে বেঁধে রাখার চ্যালেঞ্জ থেকে সরেননি। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই খরচ ছাঁটাই করতে হয়েছে তাঁকে।

অথচ খরচ কমানোর বেশি পথও তাঁর সামনে খোলা ছিল না। বেতন-পেনশন বাবদ পরিকল্পনা বহির্ভূত ব্যয় কমানো সম্ভব নয়। তাই কোপ পরিকল্পনা ব্যয়ে। দেখা যাচ্ছে, গত বাজেটে ওই খাতে ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করার কথা বলা হয়েছিল। সেখানে গ্রামোন্নয়ন, স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে এ বার খরচ ছাঁটাই হয়েছে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। সব মিলিয়ে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা কম বরাদ্দ করেছেন জেটলি। অথচ পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে এক লক্ষ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ করতে হয়েছে তাঁকে।

এই অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি ৪.১ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বেঁধে রাখতে পারলেও রাজস্ব ঘাটতি সে ভাবে কমাতে পারেননি জেটলি। ২.৯% থেকে কমিয়ে আগামী বছর তা ২.৮% করার লক্ষ্য নিয়েছেন। তা-ও এই দুই ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে তাঁকে সহায়তা করেছে নতুন হিসেবে বেড়ে যাওয়া জিডিপি (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন)।

আর্থিক শৃঙ্খলা আইন অনুযায়ী, আগামী অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি ৩.৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা ছিল। পরের বছর ৩ শতাংশে। কিন্তু জেটলি এ দিন জানিয়েছেন, নতুন বছরে (২০১৫-’১৬) ৩.৯%, তার পরের বছর (২০১৬-’১৭) ৩.৫% এবং তৃতীয় বছরে (২০১৭-’১৮) ঘাটতি ৩ শতাংশে কমিয়ে আনবেন। তাঁর যুক্তি, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে রাজ্যের হাতে বেশি অর্থ তুলে দিতে হয়েছে। তার উপর বৃদ্ধির হার বাড়াতে রয়েছে পরিকাঠামোয় বিপুল সরকারি লগ্নির বাধ্যবাধকতা। ফলে সরকারের হাতে টাকা রাখতে চেয়েছেন তিনি। সেই কারণেই একটু বেশি সময় রেখেছেন রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে। কিন্তু এই বাবদ হাতে আসা বাড়তি টাকা শিল্পের প্রয়োজনে খরচ করার সাহস দেখাননি তিনি। উৎসাহ ভাতা বা বাড়তি সুবিধা দেননি শিল্পকে। বরং মন দিয়েছেন সামাজিক প্রকল্পগুলিতে।

প্রশ্ন উঠেছে, পরিকল্পনা খাতেই যদি অর্থ বরাদ্দ কমে, তবে কী ভাবে বৃদ্ধির হার বাড়বে? যেখানে পরিকাঠামো বা সম্পদ গড়তে সরকারি বিনিয়োগ আসে ওই টাকা থেকে। জেটলির যুক্তি, রাজ্যগুলির হাতে যাওয়া বাড়তি অর্থ উন্নয়নে ব্যয় হবে। ফলে বাড়বে বৃদ্ধির হার। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, পেট্রোল-ডিজেলের উপর বসানো বাড়তি শুল্ক থেকে পাওয়া টাকাও মূলত কাজে লাগানো হবে পরিকাঠামো গড়তে। পরিকাঠামো তৈরিতে ৭০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হলে অর্থনীতির চাকায় পুরোদস্তুর গতি ফিরবে বলে দাবি করেছেন তিনি।

রাজস্ব আদায় বাড়ানোর নতুন রাস্তা খুঁজে বার করতে পারেননি জেটলি। এই অর্থবর্ষে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৯ হাজার কোটি টাকা আয় কম হতে চলেছে। আগামী বছরও তাই মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয়ের লক্ষ্য স্থির

করেছেন তিনি। যার বেশির ভাগটাই আসবে কোটিপতিদের আয়করের উপর বাড়তি ২% সারচার্জ বসিয়ে।

ভর্তুকির ক্ষেত্রেও খুব বেশি রাশ টানতে পারেননি। বাজেটের হিসেব বলছে, আগামী অর্থবর্ষে ভর্তুকির বহর কমবে মাত্র ২৬ হাজার কোটি টাকা। যার বেশিরভাগটাই তেলের দাম কমার সুফল। কারণ, খাদ্য বা সারের পিছনে ভর্তুকির বহরে বিশেষ হেরফের হয়নি। জেটলি জানিয়েছেন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, আধার নম্বর ও মোবাইল মারফত নগদ ভর্তুকি পৌঁছে দিয়ে ভর্তুকির অপচয় বন্ধ করতে চান তিনি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ থেকেও আগামী বছর ঘরে তুলতে চান ৬৯,৫০০ কোটি।

জেটলি জানিয়েছেন, বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর সামনে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ ছিল। কৃষিতে আয় বাড়ানো, পরিকাঠামোয় লগ্নি আনা, কারখানায় উৎপাদন বাড়ানো, রাজ্যকে বাড়তি অর্থ জোগাতে গিয়ে নিজের টাকা কমে যাওয়ার সমস্যা যোঝা এবং রাজকোষ ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এর মধ্যে সম্ভবত সবথেকে গুরুত্ব পেয়েছে পরিকাঠামো। কিন্তু সেখানেও বাজপেয়ী জমানার ধাঁচে বড় মাপের সড়ক বা রেল প্রকল্পের ঘোষণা শোনা যায়নি। তহবিল তৈরি করে, করছাড়ের সুবিধাযুক্ত বন্ড চালু করে পরিকাঠামোয় বাড়তি অর্থ জোগানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। বাস্তবে তার ফল কেমন মিলবে, সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পকে সফল করতে নানা রকম সুবিধার কথা ঘোষণা করেছেন জেটলি। কারখানার জন্য দক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর জোগান নিশ্চিত করতে টাকা ঢেলেছেন ‘স্কিলিং ইন্ডিয়া’র পিছনেও।

জেটলির দাবি, তাঁর বাজেটে বৈপ্লবিক ভাবে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পথ সুগম করার কথা বলা হয়েছে। এখন নতুন শিল্প শুরু করতে ছাড়পত্র জোগাড় করতে অনেক সময় লাগে। তার বদলে তিনি একটি আইনি কাঠামো তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যা ভাঙলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। শিল্পমহলের দাবি মেনে ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) চালুর কথাও ঘোষণা করেছেন তিনি। এই চেষ্টা প্রশংসাযোগ্য হলেও অঙ্ক ঠিকমতো না-মেলানোর গ্লানি তাঁকে এই বাজেটেও তাড়া করল বলে মনে করছেন অনেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

central budget 2015
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE