এল নিনো, এল নিনো, এল নিনো।
ভারতীয় বর্ষার উপরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উষ্ণ বাতাসের সম্ভাব্য আগ্রাসন নিয়ে কত না জল্পনা! বাস্তবে দেখা গেল, বর্ষা সে সবের তোয়াক্কাই করেনি! অন্তত এখনও। জুন মাসটায় তো সে রীতিমতো মেজাজে চার-ছক্কা হাঁকিয়ে টি-টোয়েন্টির মেজাজে ব্যাট করেছে।
দক্ষিণবঙ্গে এ বার বর্ষা ঢুকেছে নির্দিষ্ট সময়ের এগারো দিন বাদে। তবে ১৯ জুন থেকে পরের কয়েকটা দিন এতটাই বৃষ্টি হয়েছে যে, ঘাটতি পুষিয়ে পরিস্থিতি এখন ‘স্বাভাবিক।’ জুনের বৃষ্টিপাতের নিরিখে পূর্বের তুলনায় পশ্চিম ভারতের পাল্লা ভারী হলেও অসম-মেঘালয় বহু দিন বাদে ফের অতি বৃষ্টি পেয়েছে। দেশের সবচেয়ে বর্ষণমুখর এলাকার খেতাবের লড়াইয়ে ফিরে এসেছে মেঘালয়ের মৌসিমরাম।
এপ্রিল ও মে মাসে মৌসম ভবন দু’-দুবার সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করেছিল, এল নিনোর প্রকোপে সারা দেশে ঘাটতি বৃষ্টি হবে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর কেরল প্রবেশে দেরি করায় ভয়টা আরও চেপে বসে। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকও রাজ্যগুলোকে হুঁশিয়ার করে দেয়। মাঠে নেমে হিসেবটা উল্টে দিয়েছে বর্ষা। ১ জুন থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের যে পরিসংখ্যান মৌসম ভবন দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ওই সময়ের মধ্যে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৪% বেশি বৃষ্টি হয়েছে। মৌসম ভবনের হিসেবে, অতি বৃষ্টি। উপরন্তু দেশকে মোট যে ৩৬টি অঞ্চলে (সাব ডিভিশন) মৌসম ভবন ভাগ করেছে, তার ১৬টিতেই অতি বৃষ্টি হয়েছে জুনে। ‘‘গত দশ বছরে জুন মাসে এমন বৃষ্টি দেখা যায়নি।’’— মন্তব্য এক মৌসম-কর্তার।
বর্ষা এ বার এতটাই সক্রিয় যে, শুধু উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশ ও জম্মু-কাশ্মীর বাদ দিলে দেশের সর্বত্র এখন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আওতায়। পশ্চিম রাজস্থানে তো সে দু’সপ্তাহ ‘বিফোর টাইমে’ ঢুকে পড়েছে! এক আবহবিদের কথায়, ‘‘অসমে বছরের এই সময়টায় বন্যা নতুন কিছু নয়। কিন্তু কে ভেবেছিল, জুনের অতি বৃষ্টিতে গুজরাতের গির অরণ্য লাগোয়া অঞ্চল ভেসে যাবে?’’
এ বার তা-ই হয়েছে। তা হলে এল নিনোর ‘জুজু’ ওঁরা কেন দেখিয়েছিলেন? কেন্দ্রীয় ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রী হর্ষবর্ধনই বা কেন খরার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন? মৌসম ভবন কি বায়ুপ্রবাহের গতি ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি? আবহবিদদের দাবি, প্রকৃতির মন-মর্জি সব সময় আগাম আঁচ করা যায় না। ওঁদের ব্যাখ্যা: জুনের মাঝামাঝি থেকে আরবসাগর ও বঙ্গোপসাগরে যে পরের পর এমন ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ-অক্ষরেখা, ঘূর্ণাবর্ত ইত্যাদি তৈরি হবে, এবং তাদের প্রভাব এত দিন ধরে থাকবে, সেটা আগে বোঝা যায়নি। ‘‘তাই জুনে আমাদের পূর্বাভাস মেলেনি।’’— বলছেন এক আবহবিদ। জুলাইয়ে কী হবে?
বস্তুত দেশের চাষ-আবাদ কতটা হবে, কেমন হবে, তা মূলত নির্ভর করে জুলাইয়ের বৃষ্টির উপরেই। বীজতলা থেকে মাঠে ধানের চারা রোয়ার এটাই আদর্শ সময়। এল নিনো কি জুলাইয়ে হামলা চালাবে?
আবহবিদদের একাংশের মতে, সে সম্ভাবনা বিলক্ষণ আছে। এক বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ, ‘‘এই মুহূর্তে এল নিনো ঘাপটি মেরে আছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার শক্তি বাড়ছে। আরবসাগর- বঙ্গোপসাগীয় অঞ্চলে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণাবর্তের পরিস্থিতি সব সময়ে থাকবে না। তখনই সে ছোবল মারতে পারে।’’
তবে এল নিনো আঘাত হানলেও জুনের ব্যাপক বৃষ্টির দরুণ তার তীব্রতা অতটা হবে না বলে আবহবিদেরা আশাবাদী। আবার জুনের মতো অতি বৃষ্টি জুলাইয়ে হলেও বিপদ কম নয়। ‘‘তেলঙ্গানা, অসম, গুজরাতে জুনেই বন্যা হয়েছে। জুলাইয়ে বেশি বৃষ্টি হলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না।’’— বলছেন এক আবহবিদ।
অর্থাৎ, বৃষ্টির মাঠেও ভারসাম্যের ইনিংস দরকার। প্রকৃতি কতটা সমঝদার হয়, সেটাই এখন দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy