Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাসের তালাশে সোনারুন্দি

একটাই উপায়, পালাতে হবে। পালানোতেই সাময়িক স্বস্তি। টাকা নিয়ে একঘেয়ে কচকচানি আর একই নেতাদের নাগাড়ে মুণ্ডপাত করতে করতে রণক্লান্ত।

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৭ ০১:৫৭
Share: Save:

একটাই উপায়, পালাতে হবে। পালানোতেই সাময়িক স্বস্তি। টাকা নিয়ে একঘেয়ে কচকচানি আর একই নেতাদের নাগাড়ে মুণ্ডপাত করতে করতে রণক্লান্ত।

গন্তব্য বর্ধমানের কেতুগ্রাম। বেলডাঙা থেকে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। সঙ্গে অনুগত ছাত্র ওয়াসিম। দেখব, নবাব সিরাজের সহ-সেনাপতি মীরমদনের সমাধি, নবাবি ফৌজের হাতিশালা দাদপুর ও পিলখানা অঞ্চল, বাবলা নদী, অট্রহাস এবং অবশ্যই সোনারুন্দি রাজবাড়ি। সফরের মূল আকর্ষণ সেটাই।

ভাগিরথী পেরোলাম নারকেলবাড়ি ঘাটে। এ ঘাটেই একবার পারাপারের সময় যাত্রীভর্তি একটি টাটা সুমো তলিয়ে গিয়েছিল। গিয়েছিল আটটি প্রাণ।

নদী পারাপারের আগে দেখে নিয়েছিলাম মীরমদনের কবর। পলাশীর যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মীরজাফর লড়াই করতে অস্বীকৃত হলে, মীরমদন তাঁর নিয়ন্ত্রিত বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আহত, ক্ষতবিক্ষত সেই অনুগত বীর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরার পথে, এখানেই মারা যান। মৃত্যু হয় তাঁর ঘোড়াটিরও।

মধ্যবাংলার মাঠেঘাটে সবুজের অভাব নেই। সঙ্গে মিঠে সোনারোদ আর আপাত ঠান্ডা বাতাস। মোটরবাইকে মিল্কি, ঘোল্লা পেরিয়ে বাবলা নদীর দিকে যেতে যেতে দেখলাম প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তার ধারেও ডিজিটাল ইন্ডিয়া হাজির। মোটা কেবল পোঁতার কাজ চলছে। বাবলা নদীর তীরে বাবলা গ্রাম। এই গ্রামেরই আবুল বরকত বাংলাদেশের মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। সে সময় তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

সালার থেকে পাঁচুন্দির পথে মসৃণ রাস্তার পাশেই একটি খেঁজুর গুড়ের আখড়া চোখে পড়ল। গুড়ের কারখানা। টাটকা, খাঁটি, সুস্বাদু গুড় মাত্র ৭৫ টাকা কিলো। ছোট বাজারটাকে ছাড়িয়ে ভাঙা দরজার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করলাম বনয়ারিবাদ বা সোনারুন্দি রাজবাড়ি চত্বরে। এ হল বর্ধমানের রাজাদের বাড়ি। দেখেই বোঝা যায়, ভগ্নপ্রায় প্রাসাদটি পড়ে রয়েছে অযত্নে। অবহেলায় পড়ে দু’টি কামানও। কেন যে সংরক্ষণ করা হয় না? মনটা ভারী হয়ে ওঠে এমন অসংখ্য প্রশ্নে। বাড়ি সংরক্ষণ করা সম্ভব না হলেও, কামান দু’টিকে অন্তত কোনও মিউজিয়ামে রাখাই যেত। দিনের পর দিন ওখানে ও ভাবেই পড়ে রয়েছে।

বছর চারেক আগেও শুনেছিলাম, এখনও শুনলাম ছোট রাণীমা নাকি এখানেই বাস করেন। সেবারও তাঁর হদিস পাইনি, এ বারও পেলাম না।

রাজবাড়ি সংলগ্ন দীঘিটির মাছগুলি দিব্যি আছে। এক সময় নাকি এখানে সোনার নথ পড়া মাছের দেখা মিলত। এখানে এ মাছ নাকি কেউ ছাড়েনি, কেউ ধরেও না। লোকমুখে নানা গল্প শোনা যায়— কোনও এক সময় কেউ এক জন মাছ ধরতে গিয়েছিল। তার পর মুখে রক্ত উঠে মারা যায় সে। দর্শনার্থীদের দেওয়া বিস্কুট ও মুড়ি খেয়ে তারা রীতিমতো নধর হয়েছে। আপনি ভয় না পেলে, তারা দিব্য আপনার হাত থেকে বিস্কুট খেয়ে যাবে।

সোনারুন্দি থেকে কিছুটা গেলেই বর্ধমানের নিরোল গ্রামের কাছাকাছি রয়েছে ওষ্ঠহাস। দেবীর একান্ন সতীপীঠের একটি। শোনা যায় ওখানে দেবীর ঠোঁট বা ওষ্ঠ পড়েছিল। পরে ওষ্ঠহাস কালক্রমে আমাদের উচ্চারণ দোষে হয়ে গেছে অট্রহাস।

তবে এ সফরে সব চেয়ে মন ছুঁয়ে সোনারুন্দি রাজবাড়ি। ইতিহাসের প্রমাণ স্বরূপ এখনও পড়ে রয়েছে সুনসান রাজদালান। তবে নেই অনেক কিছুই। নেই রাজ পরিবারের কলরব, নেই কোনও হাঁকডাক, সৈনিক, পাইক, বরকন্দাজ। অশীতিপর বৃদ্ধের মতো ও-বাড়িরও যেন এই ডিজিটাল যুগে আর প্রয়োজন নেই। মৃত্যু ঘটেছে অনেক দিনই, এখন শুধু কালের গর্ভে বিলীন হওয়ার অপেক্ষা। সে হারিয়ে যাওয়ার বাস্তবতা মনে পড়তেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মনে হল আমিও যেন ওই রাজপরিবারের কোনও সন্তান। প্রিয়জনের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও অসহায় !!

জাহির রায়হান, সার্কাস ময়দান, বেলডাঙা, মুর্শিদাবাদ। ছবি: লেখক

কী ভাবে যাবেন?

হাওড়া-আজিমগঞ্জ সেকশনের সালার স্টেশনে নামুন, সেখান থেকে টুকটুক বা বাসও আছে, কাটোয়াগামী গঙ্গাটিকুরি নেমেও যাওয়া যায়, কিন্তূ যানবাহনের একটু সমস্যা হবে।

পুনশ্চ: সর্বভুক হলে সালারের নাঁদ রুটি (সম্ভবত ‘নান’-এর অপভ্রংশ) ও শিক কাবাব খেয়ে দেখতে ভুলবেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE