Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Science News

ব্রহ্মাণ্ডের জন্মবৃত্তান্ত খুঁজতে বাঙালি বিজ্ঞানীরা খনিতে

ব্রহ্মাণ্ডের অতলান্ত অন্ধকার ফুঁড়ে ফেলতে ভারতীয় কণাপদার্থবিজ্ঞানীরা নামতে চলেছেন আসানসোলের কাছে ঝাড়খণ্ডের যদুগোড়ায়, দেশের ইউরেনিয়াম কর্পোরেশনের (ইউসিআইএল) খনিতে। যার গভীরতা আধ কিলোমিটারেরও বেশি।

সেই ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞান গবেষণাগার। কসমিক মিউওন কাউন্টার। ঝাড়খণ্ডের যদুগোড়ায় ইউরেনিয়াম খনিতে। সৌজন্যে: সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স।

সেই ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞান গবেষণাগার। কসমিক মিউওন কাউন্টার। ঝাড়খণ্ডের যদুগোড়ায় ইউরেনিয়াম খনিতে। সৌজন্যে: সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০৪
Share: Save:

ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্যের জাল কাটতে এ বার জমাট অন্ধকার খনিগর্ভে নামছেন বিজ্ঞানীরা!

কোলার গোন্ড ফিল্ড (কেজিএফ) পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ২৫ বছর পর, ভারতে এই প্রথম।

ব্রহ্মাণ্ডের অতলান্ত অন্ধকার ফুঁড়ে ফেলতে ভারতীয় কণাপদার্থবিজ্ঞানীরা নামতে চলেছেন ঘাটশিলার কাছে ঝাড়খণ্ডের যদুগোড়ায়, দেশের ইউরেনিয়াম কর্পোরেশনের (ইউসিআইএল) খনিতে। যার গভীরতা আধ কিলোমিটারেরও বেশি।

সল্টলেকের সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (এসআইএনপি)-এর উদ্যোগে ২৫ বছর পর ভারতে এই প্রথম চালু হচ্ছে ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞান গবেষণাগার, ইউরেনিয়াম খনির ৫৫০ মিটার গভীরতায়। আজ, শনিবার যদুগোড়ায় সেই ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞান গবেষণাগারের উদ্বোধন করছেন কেন্দ্রীয় পরমাণু শক্তি মন্ত্রকের সচিব ও পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান শেখর বসু।


ইউরেনিয়াম খনির আধ কিলোমিটারেরও বেশি গভীরতায় ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞান গবেষণাগারে ঢোকার পথ। ঝাড়খণ্ডের যদুগোড়ায়।

এসআইএনপি-র অধিকর্তা অজিত মোহান্তির কথায়, ‘‘পরিবেশ আন্দোলনের জেরে ২৫ বছর আগে কোলার গোল্ড ফিল্ড পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই কোনও ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞান গবেষণাগার ছিল না এ দেশে। অথচ, নানা ধরনের বিকিরণের ছোবল বাঁচিয়ে কারা কারা এই ব্রহ্মাণ্ডের অন্যতম প্রধান ‘কারিগর’ ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য বস্তু, সেটা জানার খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারা কারা সেই অদৃশ্য বস্তু, কেমনই বা তাদের আচরণ, চালচলন, তা না জানতে পারলে এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্যের জট খোলা খুব মুশকিল। এই গবেষণাগার ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সামনে সেই রাস্তা খুলে দিল।’’

আরও পড়ুন- ভুতুড়ে কণার কীর্তি আবিষ্কার, ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্যে নতুন আলো

আরও পড়ুন- পৃথিবীতে এক দিন আর কোনও গ্রহণই হবে না!

ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য বস্তু কী জিনিস?

বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের পর থেকে এখনও পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু তৈরি হয়েছে, হচ্ছে বা হবে, তার মূল কারিগর তিনটি জিনিস। ডার্ক এনার্জি বা অদৃশ্য শক্তি, ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য বস্তু আর অর্ডিনারি ম্যাটার বা সাধারণ পদার্থ। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ডার্ক এনার্জি। এই ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের প্রায় ৭০ শতাংশ। এই অদৃশ্য শক্তিই ব্রহ্মাণ্ডকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে যাচ্ছে। তার ফুলে, ফেঁপে ওঠার গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে উত্তরোত্তর। আর ফোলাতে ফোলাতে বেলুন যে ভাবে ফেটে যায়, তেমনই এই অদৃশ্য শক্তির জন্য এই ব্রহ্মাণ্ডেরও দশা হবে ওই ফেটে যাওয়া বেলুনের মতোই।


এসআইএনপি’র অধিকর্তা অজিত মহান্তি (বাঁ দিক থেকে), প্রকল্পের কোঅর্ডিনেটর অধ্যাপক সত্যজিৎ সাহা ও অধ্যাপক নবকুমার মণ্ডল

যার জন্ম কী ভাবে হল, কোথা থেকে হল, তার জন্মের পিছনে কলকাঠি নাড়ল কে, তা এখনও জেনে বা বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি বিজ্ঞানীদের। ব্রহ্মাণ্ডের বাকি ৩০ শতাংশ ভরের জন্য দায়ী আর দু’টি জিনিস। একটি- ডার্ক ম্যাটার। অন্যটি- সাধারণ পদার্থ বা অর্ডিনারি ম্যাটার। মানুষ, অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, এই সব কিছু যা দিয়ে গড়া, তাদের মোট ভর এই ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের মাত্র ৫ শতাংশ। ব্রহ্মাণ্ডের আর বাকি ২৫ শতাংশ ওজনের জন্য দায়ী ডার্ক ম্যাটার।

আরও পড়ুন- পৃথিবীর দিকে অক্টোবরেই ছুটে আসছে এই গ্রহাণু

কোলার গোল্ড ফিল্ডের ভূগর্ভে গবেষণায় যিনি কাটিয়েছেন জীবনের অন্তত দু’টো দশক, এসআইএনপি’র সেই রাজা রামান্না ডিসটিঙ্গুইজ্‌ড ফেলো অধ্যাপক নবকুমার মণ্ডলের বক্তব্য, সেই ডার্ক ম্যাটার কারা কারা তা জানার কাজটা অনেকটাই সহজ হয়ে যায় সেই পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণাটা ভূগর্ভে করা সম্ভব হলে। কারণ, ভূপৃষ্ঠে বা মহাকাশে সেই ডার্ক ম্যাটার যে ‘সিগন্যাল’ দেয়, তা বুঝে ওঠা খুব মুশকিল হয়। যেহেতু তার সঙ্গে মিলেমিশে থাকে আরও নানা রকমের ‘সিগন্যাল’। ভূগর্ভে গেলে সেই অবাঞ্ছিত ‘সিগন্যাল’গুলি হয় থাকে না বা তা অনেকটাই কমে যায়। তখন ডার্ক ম্যাটারের ‘সিগন্যাল’ পাওয়ার কাজটা সহজ হয়ে উঠতে পারে। তবে প্রাথমিক ভাবে এখন বিভিন্ন যন্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হবে ওই ভূগর্ভস্থ গবেষণাগারে। দেখা হবে সেই সব যন্ত্র অন্য ‘সিগন্যাল’গুলিকে কতটা বাদ দিতে পারছে যাতে আগামী দিনে ডার্ক ম্যাটারের ‘সিগন্যাল’ চিনতে কোনও ভুল না হয়ে যায়।


যদুগোড়ায় সেই ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞান গবেষণাগারের সাইট ম্যাপ


যদুগোড়ায় সেই ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞান গবেষণাগারের সাইট ম্যাপ

সেই লক্ষ্যেই ‘ইস্পাত নগরী’ জামশেদপুরের ২০ কিলোমিটার দূরে যদুগোড়ার ইউরেনিয়াম খনির আধ কিলোমিটারেরও বেশি গভীরে নামতে চলেছেন এ বার বাঙালি বিজ্ঞানীরা। আর সেই প্রকল্পে জড়িত রয়েছেন ভুবনেশ্বরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (নাইসার), মুম্বইয়ের ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার (বার্ক) ও টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর বিজ্ঞানীরাও।

এই প্রকল্প থেকে কী উপকার হতে পারে আমজনতার?

প্রকল্পের কোঅর্ডিনেটর, সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অধ্যাপক সত্যজিৎ সাহা বলছেন, ‘‘ এই প্রকল্পের মাধ্যমে ক্যানসার চিকিৎসায় এখন যে পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফির (পিইটি বা ‘পেট’) ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়, তার সিগন্যাল চেনার প্রযুক্তি অনেকটাই উন্নত করে তোলা সম্ভব হতে পারে।’’

কী ভাবে?

সত্যজিৎবাবু জানাচ্ছেন, গামা রশ্মি ধরার জন্য যে ধরনের দৃশ্যমান আলো নির্গতকারী কেলাস ব্যবহার করা হয়, দেখা গিয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি কেলাসকে কম তাপমাত্রায় নিয়ে গেলে নির্গত আলোর পরিমাণ বেড়ে যায়। ‘পেট’ প্রযুক্তিতে এই ধরনের কেলাস ব্যবহার করলে ‘পেট’-এর ছবি আরও নিখুঁত হতে পারে। এই কেলাসগুলি বানিয়েছেন ‘বার্ক’-এর বিজ্ঞানীরা। সিরিয়াম যোগ করা গ্যাডোলিনিয়াম গ্যালিয়াম অ্যালুমিনিয়াম গার্নেট নামে একটি কেলাসকে (জিজিএজি-সিরিয়াম) অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়া হলে তা অনেক বেশি আলোর প্রতিফলন ঘটাতে পারে। ‘পেট’ প্রযুক্তিতে ওই কেলাস ব্যবহার করা হলে ক্যানসার রোগ নির্ণয়ে তা আরও বেশি সহায়ক ও নিখুঁত হয়ে উঠবে।

ছবি ও ডায়াগ্রাম সৌজন্যে: সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, সল্টলেক

ছবি ও ডায়াগ্রাম সৌজন্যে: সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, সল্টলেক

(এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশের সময় লেখা হয়েছিল আসানসোলের কাছে যদুগোড়া। হবে ঘাটশিলার কাছে যদুগোড়া। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য দুঃখিত। ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পাঠকদের ধন্যবাদ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE