Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Science News

ব্রহ্মাণ্ডের ভোরের প্রথম আলোর হদিশ মিলল

১৩৭০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহা-বিস্ফোরণের পর জন্মানো প্রথম তারাদের ‘হারিয়ে যাওয়া’ আলোর হদিশ মিলল শেষমেশ। বহু যুগের অক্লান্ত সন্ধানের পর।

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় বসানো সেই টেলিস্কোপ। যার চোখে ধরা পড়ল ব্রহ্মাণ্ডের ভোরের সেই আলো।

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় বসানো সেই টেলিস্কোপ। যার চোখে ধরা পড়ল ব্রহ্মাণ্ডের ভোরের সেই আলো।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৮ ১৬:২৪
Share: Save:

ব্রহ্মাণ্ডের ভোরের (কসমিক ডন) প্রথম আলো দেখতে পেলেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রথম।

১৩৭০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহা-বিস্ফোরণের পর জন্মানো প্রথম তারাদের ‘হারিয়ে যাওয়া’ আলোর হদিশ মিলল শেষমেশ। বহু যুগের অক্লান্ত সন্ধানের পর।

ব্রহ্মাণ্ডের ভোর থেকে যে তারাদের আলো দেখতে পাওয়া গিয়েছে, সেই তারাদের জন্ম হয়েছিল বিগ ব্যাং-এর ১৮ কোটি বছর পরেই। আজ থেকে ১৩৫২ কোটি বছর আগে। সেটাই ছিল এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম আলো!

প্রথম প্রজন্মের সেই তারারা অবশ্য আজ আর নেই। সেই তারাদের মৃত্যু হয়েছে কতশত কোটি বছর আগে। তাদের শরীরের দেহাবশেষ থেকে তৈরি হয়েছে তার পরের প্রজন্ম ও তারও পরের প্রজন্মের তারারা। তৈরি হয়েছে গ্যালাক্সি, গ্যালাক্সির ঝাঁক, মহা-গ্যালাক্সি ও মহা-গ্যালাক্সিদের ঝাঁকগুলি।

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মার্চিসন রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরিতে একটি বিশেষ ধরনের রেডিও টেলিস্কোপের (যার নাম- ইডিজিইএস বা ‘এজেস’) মাধ্যমে সেই আলো দেখতে পেয়েছেন গবেষকরা। গবেষকদলের নেতৃত্বে রয়েছেন আমেরিকার অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জুড বাওম্যান। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ। ২৮ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়।

আরও পড়ুন- চাঁদে মোবাইল টাওয়ার বসাচ্ছে ভোডাফোন!​

আরও পড়ুন- সূর্যের ‘রাক্ষস’দের বহু আগেই চিনে ফেলার পথ দেখালেন বাঙালি​

পদার্থবিদরা এখনও পর্যন্ত যা জানতে পেরেছেন তাতে ১৩৭০ কোটি বছর আগে সেই মহা-বিস্ফোরণের পরেই সবকিছু জমাট অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সেই অন্ধকার ভেদ করে কোনও কিছুই বেরিয়ে আসতে পারছিল না। এমনকী, আলোর কণা ফোটনও সেই সময় জমাট বাঁধা অন্ধকারে আটকে গিয়েছিল। এই অবস্থাটা চলেছিল বিগ ব্যাং-এর পরের ৩ লক্ষ ৭০ হাজার বছর ধরে। তখন স্যুপের মতো একটা থকথকে অবস্থার জন্ম হয়েছিল। কোনও পদার্থের জন্ম তখন সম্ভব ছিল না। এটাকে বলা হয়, ব্রহ্মাণ্ডের ডার্ক এজেস বা মহা-অন্ধকার অবস্থা।

ওই থকথকে স্যুপ থেকেই তৈরি হয়েছিল আধান বা চার্জহীন ‘শ্রীনিরপেক্ষ’ হাইড্রোজেন পরমাণু। আধানহীন বলে সেই হাইড্রোজেন পরমাণুদের পক্ষে পদার্থ তৈরি করা সম্ভব ছিল না। যার কোনও ব্যাপারে কোনও আসক্তি নেই, তার কাছে কি কেউ ঘেঁষে? আর অন্য কেউ কাছে না ঘেঁষলে যেমন কোনও দল বা গোষ্ঠী বা সমাজ তৈরি হয় না, তেমনই আধানহীন হাইড্রোজেন পরমাণুর পক্ষে কোনও পদার্থের জন্ম দেওয়া তখন সম্ভব ছিল না। সেই হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি তখন ‘ভাইরাস’-এর মতো সংখ্যায় বেড়ে উঠে গোটা ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। গুচ্ছ গুচ্ছ ভাবে। দলে দলে। তার পর জোরালো মহাকর্ষীয় বল (গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স) তাদের নানা দিক থেকে টেনেটুনে ধরে-বেঁধে এনে জোট বাঁধিয়েছিল। তাদের বাধ্য করেছিল অন্যান্য পদার্থের জন্ম দিতে। আর তারই পথ থরে প্রথম প্রজন্মের তারাদের জন্ম হয়েছিল।

আর বেলুনের মতো আচমকা হু হু করে চার পাশে ফুলে উঠতে শুরু করেছিল গোটা ব্রহ্মাণ্ড।

‘জ্বালানি’ কম থাকায় প্রথম প্রজন্মের সেই তারারা বেশি দিন বাঁচেনি। তাদের আলোও তেমন জোরালো হতে পারেনি। তাই প্রায় ১৩৫২ কোটি বছর পর এই পৃথিবীতে বসানো কোনও টেলিস্কোপ দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের সেই প্রথম আলোর হদিশ পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। একে তো সেই আলো ততটা জোরালো ছিল না। তার পর সেই তারারাও মরে গিয়েছে। ফলে, সেই তারাদের থেকে আলো পাওয়ারও নেই কোনও সম্ভাবনা। তার চেয়েও বড় কথা, তার পর পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় ১৩৫২ কোটি বছর। ফলে সেই আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে।

এই গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?

অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও এই গবেষকদলের অন্যতম সদস্য ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘গবেষকরা সেই আলোর পিছনে ছুটেছিলেন একটু অন্য পথে। যে পথে আগে কেউ ছোটেননি! তাঁরা চোখ রেখেছিলেন হাইড্রোজেন পরমাণুগুলির উপর।’’

বিগ ব্যাং-এর পর গোটা ব্রহ্মাণ্ডে যে অদৃশ্য বিকিরণ ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এখনও রয়েছে (যাকে বলে, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি), তারই মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই ‘আদ্যিকাল’-এর ‘শ্রীনিরপেক্ষ’ হাইড্রোজেন পরমাণুরা। তারা কিছুটা বিকিরণের পাশাপাশি প্রথম প্রজন্মের তারাদের আলোও কিছুটা শুষে নিয়েছিল।

ধ্রবজ্যোতি বলছেন, ‘‘সেই হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি থেকে বেরিয়ে আসা আলোকতরঙ্গ বিশ্লেষণ করেই ব্রহ্মাণ্ডের ভোরের প্রথম আলোর হদিশ পেয়েছেন গবেষকরা।’’

তবে এখানেই শেষ নয়। মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর অধ্যাপক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী দেবেন্দ্র ওঝার বক্তব্য, ‘‘ব্রহ্মাণ্ডের অন্যান্য অংশে সিএমবি-র মধ্যে থাকা হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি থেকে বেরিয়ে আসা আলোকতরঙ্গ বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে আগামী দিনে আরও বেশি সুনিশ্চিত হতে হবে।’’

‘ডার্ক ম্যাটার’ রহস্যভেদেও পথ দেখাতে পারে এই গবেষণা

যে পদার্থ দিয়ে আমাদের আশপাশের সবকিছু তৈরি, সেই সাধারণ পদার্থ (অর্ডিনারি ম্যাটার) সামান্যই রয়েছে গোটা ব্রহ্মাণ্ডে। প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে অদৃশ্য পদার্থ বা ডার্ক ম্যাটার আর অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি।

ধ্রুবজ্যোতির দাবি, ‘‘যে তরঙ্গের আলোর হদিশ মিলেছে, তাতে বলা যায়, বিগ ব্যাং-এর পরের সেই সময়ে ব্রহ্মাণ্ড যতটা গরম ছিল বলে আমাদের ধারণা ছিল এত দিন, তা এ বার বদলাতে হবে। কারণ, আমরা প্রমাণ পেয়েছি, ব্রহ্মাণ্ডের ওই সময়ের তাপমাত্রা আমাদের ধারণার চেয়ে অনেকটাই কম ছিল। এটাই পরোক্ষে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব প্রমাণ করছে।’’

ছবি ও গ্রাফিক্স তথ্য সৌজন্যে: অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE