Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Science news

ক্লোনিং গবেষণায় এ বার চিনা বিপ্লব

প্রথম ‘নন-হিউম্যান প্রাইমেট’ ক্লোনিং করলেন চিনের একদল জীববিজ্ঞানী। আগামী দিনে জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে এই আবিস্কারের গুরুত্ব কী? কী বললেন বিজ্ঞানীরা?

‘সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার’ পদ্ধতিতে জন্ম হয়েছে ঝং ঝং এবং হুয়া হুয়া নামে এই দু’টি বাঁদর শিশুর।

‘সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার’ পদ্ধতিতে জন্ম হয়েছে ঝং ঝং এবং হুয়া হুয়া নামে এই দু’টি বাঁদর শিশুর।

চৈতালী চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৮ ১০:৩৫
Share: Save:

ছোট্ট দু’টি বাঁদরছানার জন্ম হয়েছে চিনে। আর তাতেই সাড়া পড়ে গিয়েছে বিশ্বজুড়ে।

বাঁদরদের নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে, যদি এই প্রশ্ন মনে জাগে, তা হলে প্রথমেই বলে রাখা ভাল, এরা কিন্তু নেহাতই অতি সাধারণ বাঁদর নয়। দীর্ঘদিনের চিন্তা-ভাবনা, কাটাছেঁড়া, তর্ক-বিতর্কের বেড়াজাল পেরিয়ে বিজ্ঞানীদেরই হাত ধরে জন্ম হয়েছে এই বাঁদর শিশুদের। এরা দেখতেও হুবহু এক। চোখ, কান, নাক, চালচলন- কোথাও এতটুকু ফারাক নেই। ঠিক যেন একটি, অন্যটির ‘জেরক্স কপি’। আদর করে তাদের নাম রাখা হয়েছে ‘ঝং ঝং’ এবং ‘হুয়া হুয়া’।

সেই আবিষ্কারের খবর গত ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘দ্য সেল’-এ।

এখন যদি প্রশ্ন করা হয় ‘ঝং ঝং’ আর ‘হুয়া হুয়া’ কি যমজ? উত্তর হবে- হ্যাঁ। তবে এরা একে অপরের ‘অনুরূপ প্রতিলিপি’। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘ক্লোন’।

চিনের সাংহাই প্রদেশের ‘চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সাইন্সেস ইনস্টিটিউট’-এর নিউরোসায়েন্স বিভাগের একদল জীববিজ্ঞানীর দীর্ঘ দিনের গবেষণার ফসল এই দু’টি প্রাণী। ‘ক্লোনিং’ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছে এদের। একই ধরনের জিনগত বৈশিষ্ট্যের দু’টি প্রাণী। যাদের দেহকোষগুলিও অবিকল একই রকমের (ফিনোটাইপ)।

এই আবিষ্কারকে ‘যুগান্তকারী এবং অভিনব’ বলে দাবি করেছেন সাংহাই প্রদেশের ‘চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর নিউরোসায়েন্স বিভাগের প্রধান মু-মিং পু।

জীববিজ্ঞানে ‘ক্লোনিং’ অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগে অন্তত ২০টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর ‘ক্লোন’ করা হয়েছে। কিন্তু তাও এই গবেষণাকে যুগান্তকারী বলছেন বিজ্ঞানীরা, তার মূল কারণ হল, এর আগে ভেড়া, কুকুর, ইঁদুর,গিনিপিগ জাতীয় প্রাণীর ‘ক্লোন’ তৈরি করা হয়েছিল। এই প্রথম ‘নন-হিউম্যান প্রাইমেট’ বা মানুষের ঠিক আগের পূর্বসূরীর উপর সফল ভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। দিল্লির ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’ (আইআইটি)-র ‘টিসু ইঞ্জিনিয়ার’ অধ্যাপক সৌরভ ঘোষ বলছেন, ‘’এই গবেষণা পরবর্তী কালে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ে এবং জীববিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কারের দরজা খুলে দেবে।’’

মোহালির ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ (আইআইএসইআর)-এর জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স বিভাগের প্রধান মৈনাক সেনগুপ্ত এবং বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’ (এনসিবিএস)-এর সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট স্বাগতা ঘোষ এই বিষয়ে সহমত পোষণ করেছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘নন-হিউম্যান প্রাইমেট ক্লোনিং গবেষণার সাফল্য পরবর্তী কালে ক্লোনিং নিয়ে আরও নতুন কিছু ভাবনার জায়গা তৈরি করবে। জীববিজ্ঞানের জন্য এই গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ’’

কী ভাবে জন্ম হল ‘ঝং ঝং’ এবং ‘হুয়া হুয়া’র

ক্লোনিংয়ের একটি বিশেষ পদ্ধতি হল ‘সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার’ বা এসসিএনটি। এই পদ্ধতিতেই জন্ম হয়েছে ‘ঝং ঝং’ এবং ‘হুয়া হুয়া’র। বলা বাহুল্য এটাই ক্লোনিংয়ের মূল পদ্ধতি।

পুরুষ হোক বা স্ত্রী, যে প্রাণীর ক্লোন তৈরি করতে হবে, প্রথমে তার সোমাটিক সেল (দেহকোষ) সংগ্রহ করেন বিজ্ঞানীরা। দেহকোষ থেকে নিউক্লিয়াসটি আলাদা করে রাখা হয়। এই ক্ষেত্রে চিনের বিজ্ঞানীরা একটি স্ত্রী ম্যাকাকা বাঁদরের ভ্রুণের কোষ সংগ্রহ করে তার থেকে নিউক্লিয়াসটি আলাদা করে রেখেছিলেন।

এ বার দ্বিতীয় একটি পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী ম্যাকাকা বাঁদরের ডিম্বকোষ (জনন কোষ) সংগ্রহ করে নিউক্লিয়াসটি ফেলে দেন।

আলাদা করে সরিয়ে রাখা দেহকোষের নিউক্লিয়াসটি নিয়ে নিউক্লিয়াসবিহীন ডিম্বকোষের মধ্যে সেটিকে বসিয়ে দেওয়া হয়। লেসার রশ্মির মাধ্যমে।

চিনের গবেষণাগারে ‘ঝং ঝং’ এবং ‘হুয়া হুয়া’। দেখুন ভিডিও:

কৃত্রিম নিষেক (দু’টি জননকোষ অর্থাত্ শুক্রাণু এবং ডিম্বানুর মিলন, এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম নিষেক ঘটানো হয়) প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক ভাবে কোষ টুকরো হয়ে ভ্রুণ তৈরি হওয়ার পর সেটি তৃতীয় আর একটি পূর্ণবয়স্ক ম্যাকাকা বাঁদরের গর্ভে প্রতিস্থাপিত করা হয়। তৃতীয় এই বাঁদরটি বা ‘সারোগেট মাদার’-এর থেকে যে সন্তানের জন্ম হয় তাকে হুবহু দেখতে হয় প্রথম বাঁদরটির মতো। যেহেতু, ডিম্বকোষের নিউক্লিয়াসটি ফেলে দেওয়া হয়, তাই সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় বাঁদরটির বৈশিষ্ট্য আসার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না।

‘চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর বিজ্ঞানীরা এই ‘সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার পদ্ধতি’তে গবেষণাগারে প্রথমে ১০৯টি অপরিণত ভ্রুণ তৈরি করেন। যেগুলির মধ্যে ৭৯টি ভ্রুণ বেঁচে থাকে, বাকিগুলি মরে যায়। এই ৭৯টি ভ্রুণ ২১টি ‘সারোগেট মাদার’-এর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই ২১টি বাঁদরের মধ্যে মাত্র ৪টি গর্ভবতী হয়, যার মধ্যে আবার ২টির গর্ভপাত (মিসক্যারেজ) হয়ে যায়। বাকি দু’টির থেকে জন্ম হয় ‘ঝং ঝং’ আর‘হুয়া হুয়া’র।

‘সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার পদ্ধতি’তে যে সব সময় সাফল্য আসে তেমনটা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভ্রুণ পরিণত হওয়ার আগেই মাতৃগর্ভে সেটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে বা, সন্তানের জন্ম হলেও তার মধ্যে নানা রকম জটিলতা দেখা গিয়েছে।

এ ক্ষেত্রে সাফল্যের কারণ কী? গবেষকরা কি কোনও বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন?

অধ্যাপক সৌরভ ঘোষ জানিয়েছেন, ‘সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার পদ্ধতি’তে ডিম্বকোষ থেকে নিউক্লিয়াস বের করার সময় বিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ ধরনের ‘ডাই’ বা মার্কার ব্যবহার করেন। সেই মার্কার দিয়ে ক্রোমোজোমকে এমন ভাবে চিহ্নিত করা হয় যাতে সেটি আলট্রা-ভায়োলেট রে’ বা অতিবেগুনি রশ্মিতে দেখা যায়। অনেক সময় এই ‘ডাই’ এবং আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি ডিমের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা তৈরি করে দেয় যা পরবর্তী কালে সন্তানের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে যায় বা ভ্রুণ তৈরির সময় জটিলতা সৃষ্টি করে। চিনের বিজ্ঞানীরা ‘ডাই’ বা আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি কোনওটাই ব্যবহার করেননি।

জিনতত্ত্ববিদ ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় এ ক্ষেত্রে সাফল্যের আরও একটি কারণের উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মায়ের ডিম্বকোষ বিভাজিত হয়ে ভ্রণকোষ তৈরি করে। অর্থাত্ তাদের মধ্যে একই ডিএনএ বা জিনগত বৈশিষ্ট্য থাকে। কিন্তু তাও দেখা যায় সন্তান শারীরিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তার মায়ের থেকে আলাদা। কারণ, দেহের মধ্যে এক জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলে, যার নাম ‘এপিজেনেটিক্স’। এই পদ্ধতি কয়েকটি জিনকে তার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে দেয়। আবার কিছু কিছু জিনকে এ ব্যাপারে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। কিন্তু, এই গবেষণায় যেহেতু ক্লোন বা অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরি করতে হবে, তাই বিজ্ঞানীরা ‘এপিজেনেটিক্স’-এর পরিবর্তনটাকেই রুখে দিয়েছিলেন। যাতে একই রকম দেখতে এবং একই বৈশিষ্ট্যের দুটি প্রাণীর জন্ম হয়।

বিজ্ঞানীদের মতে, ভবিষ্যতে এই গবেষণার মান যত উন্নত হবে, আরও বেশি সংখ্যক ক্লোন তৈরি করা সম্ভব হবে যাদের মধ্যে একই দেহজ এবং জিনগত বৈশিষ্ট্য থাকবে।

চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স (সাংহাই ব্র্যাঞ্চ)-এর নিউরোসায়েন্স বিভাগের প্রধান মু-মিং পু এবং তাঁর টিম এই গবেষণার কাজ চালিয়েছেন।

এর আগে কোন কোন প্রাণীর ‘ক্লোন’ তৈরি করা হয়েছিল?

‘ক্লোনিং’-এর সূচনা হয় ১৯০০ সালে জার্মান এমব্রিয়োলজিস্ট হানস স্পেম্যানের হাত ধরে। তিনি ক্লোনিং পদ্ধতিতে একটি স্যালামান্ডারের (উভচর প্রাণী) ভ্রুণ তৈরি করেন। ১৯৫২ সালে আমেরিকার বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রিগস এবং থোমাস জে কিং একটি ব্যাঙের ক্লোন তৈরি করেন। ১৯৫৮ ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জন বার্ট্রান্ড গর্ডনও ব্যাঙের উপর পরীক্ষা চালান।

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিয়ে ক্লোনিং গবেষণার কাজ শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে। ১৯৯৬ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানি প্রথম ভেড়ার ক্লোন তৈরি করে। আমেরিকান গায়িকা ডলি পার্টনের নামে যার নাম দেওযা হয় ‘ডলি’ । ২৭৭ বারের চেষ্টায় জন্ম হয় ডলির।

১৯৯৬ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানি প্রথম ভেড়ার
ক্লোন তৈরি করে। আমেরিকান গায়িকা ডলি পার্টনের নামে যার নাম দেওযা হয় ‘ডলি’ ।

এর পর নানা সময় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের (কুকুর, বিড়াল, হরিণ, খরগোশ, গিনিপিগ) ক্লোন তৈরি করেছেন। তবে কোনও গবেষণাই দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য পায়নি। সবক’টি ক্ষেত্রেই ক্লোনজাত প্রাণীর মধ্যে কোনও না কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা গিয়েছে। ‘ডলি’ও বেশি দিন বাঁচেনি। মাত্র সাড়ে ছ’বছর বয়সে (ভেড়ার স্বাভাবিক আয়ু ১১-১২ বছর) আর্থ্রারাইটিস এবং ফুসফুসের ক্যানসারে তার মৃত্যু হয়। ১৯৯৮ সালে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস থমসন ক্লোনিংয়ের সাহায্যে মানব ভ্রুণের কোষ তৈরি করেন। তবে সেই গবেষণা সফলতা পায়নি। সেই সময় মানব ক্লোনিং নিয়ে বিশ্ব জুড়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। মানব ক্লোনিং উচিত না অনুচিত সেই নিয়ে তাবড় বিজ্ঞানীমহলেও চলছে নানা তর্ক-বিতর্ক।

২০০৭ সালে আমেরিকার ‘ওরিগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি’র বিজ্ঞানী শ্যুখরাট মিতালিপভ প্রথম ‘সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার পদ্ধতি’তে ‘নন-হিউম্যান প্রাইমেট’ ম্যাকাকা বাঁদরকে নিয়ে ‘ক্লোনিং’ শুরু করেন। তবে সে ক্ষেত্রেও প্রাথমিক পর্যায়ের ভ্রুণ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এ বার তাতে সার্বিক সাফল্য পেলেন চিনের বিজ্ঞানীরা।

এই পরীক্ষার ভবিষ্যত কী?

এই আবিষ্কারের একটি যুগান্তকারী সম্ভাবনা হল বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের উন্নতি। বাঁদর যেহেতু মানুষের পূর্বসূরী, তাই তাদের উপর কোনও ওষুধের ক্লিনিকাল ট্রায়াল যদি সফল হয়, তা হলে সেটা মানবদেহে কী ভাবে কাজ করতে পারে, তার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স বিভাগের প্রধান মৈনাক সেনগুপ্ত বলছেন, ‘’একই জিনগত বৈশিষ্ট্যের যদি অসংখ্য এই রকম ক্লোন তৈরি করা যায়, তাহলে তাদের উপরেই নানা ওষুধের মান পরীক্ষা করা যাবে। মানুষের উপর প্রয়োগের আগে বাঁদরদের উপর পরীক্ষা করেই বোঝা যাবে কোন ওষুধের কার্যকারিতা কী, প্রয়োগের ফলে তা দেহে কী কী পরিবর্তন আনছে এবং ভবিষ্যতে কোন দুরারোগ্য ব্যধির চিকিত্সার কাজে প্রয়োগ করা যেতে পারে।’’

একই মত বিজ্ঞানী ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরভ ঘোষ ও স্বাগতা ঘোষেও। তাঁরা জানিয়েছেন ম্যাকাকাদের দেহগত বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে নানা রকম ‘রিজেনারেটিভ মেডিসিন’ চিকিত্সা পদ্ধতির প্রয়োগ এ বার সহজেই করা যাবে।

এনসিবিএস-এর সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট স্বাগতা ঘোষ বলছেন, ‘‘ম্যাকাকা বাঁদর এবং মানুষের মধ্যে জিনগত সাদৃশ্য রয়েছে। তাই এই পদ্ধতিতে অনেক বেশি ক্লোন (ক্লোন মডেল) তৈরি করে তাদের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা করা অনেক সহজ হবে।’’

জিনতত্ত্ববিদ ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘জিন ম্যানিপুলেশনের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে এই আবিষ্কারের মাধ্যমে। জিনগত অস্বাভাবিকতা (জেনেটিক মিউটেশন) এবং তার ফলে তৈরি হওয়া নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধি কেন হয় এবং তার প্রতিকার কী কী, সেই বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে। ফলে, অ্যালজাইমার’স,ডায়াবিটিসের মতো রোগ নিরাময় অনেক সহজ হয়ে যাবে।’’

এই গবেষণার ফলে সুবিধা হতে পারে ‘জিন এডিটিং’-এও। মানবদেহে ‘জিন এডিটিং’ বা ত্রুটিপূর্ণ জিনের সংশোধন পদ্ধতি নিয়ে অনেক নতুন তথ্য বিজ্ঞানীদের হাতে আসবে। ‘জিন এডিটিং’ পদ্ধতিতে প্রাণীর দেহ থেকে ত্রুটিপূর্ণ বা রোগ তৈরি করতে পারে এমন জিন সরিয়ে ফেলা এ বার সম্ভব হতে পারে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ক্রিসপার’। বংশপরম্পরার চলে আসা কোনও রোগ এই প্রক্রিয়ায় নিরাময় করা সম্ভব।

গবেষণার সুফল নিয়ে বিজ্ঞানীরা যা বলেছেন তার নির্যাস:

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এখন মানুষের দেহ এই রকম ক্রুটিপূর্ণ জিন নিয়ে বাঁদরের দেহে ইনজেক্ট করে যদি তার ক্লোন তৈরি করা যায় তা হলে বাঁদরটির দেহেও একই রকম রোগ বাসা বাধবে যা মানুষের দেহে হয়। এ বার সেই বাঁদরটিকেই ‘মডেল’ হিসেবে নিয়ে তার উপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে রোগের কারণ এবং তার প্রতিকারের পথ আবিষ্কার করা অনেক সহজ হবে। ড্রাগ রিসার্চের নতুন দিগন্তও খুলে যাবে এই গবেষণায়।

বাঁদরের পর কি এ বার মানুষের পালা?

‘মানব ক্লোনিং’ নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের। বিজ্ঞানীদের দাবি বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণে মানব ক্লোনিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পক্রিয়া, এই গবেষণা সফল হলে প্রজননগত বহুরকম ত্রুটি দূর করা সম্ভব হবে। কিন্তু, গবেষকদের এই মতে বাধ সাধে বিভিন্ন দেশের বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। নৈতিকতার খাতিরে অনেক বিজ্ঞানীদের মধ্যেও দেখা দেয় সংশয়। মানুষের ক্লোন তৈরি করা উচিত্ না উচিত্ নয় এই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মাঝেই শোনা যায় বাহামাসের একটি সংস্থা ‘ক্লোনেড’ ৩১ বছর বয়সী এক মহিলার ত্বকের কোষ থেকে ‘ইভ’ নামে একটি শিশুকল্যার ক্লোন তৈরি করেছেন। সময়টা ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর। বাস্তবে ক্লোনিং পদ্ধতিতেই ইভের জন্ম হয়েছিল কি না সেই খবরের সত্যতা আজও প্রমাণিত হয়নি। এর পর ২০০৪-০৫ সালে হ্যাং উ-সাক নামে একজন কোরিয়ান বিজ্ঞানী দাবি করেন তিনি সফল ভাবে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে মানব ভ্রুণ তৈরি করেছেন। তবে এই গবেষণার সত্যতাও প্রমাণিত হয়নি। ২০০৮ সালে ক্যালিফর্নিয়ার ‘স্টিমাজেন’ নামে একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানির গবেষক অ্যান্ড্রু ফ্রেঞ্চ এবং স্যামুয়েল উড পাঁচটি পরিণত মানব ভ্রুণ তৈরি করেন। কিন্তু, পরে নানা বিতর্কের মুখোমুখি হয়ে ভ্রুণগুলি তাঁরা নষ্ট করে দিয়েছিলেন।

মানব ক্লোনিং নিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিও তখন দ্বিধাবিভক্ত। একদলের দাবি, এই পক্রিয়া খোদার উপর খোদকারি ছাড়া আর কিছুই নয়। এরই মধ্যে আবার অন্য এক দল ক্লোনিংয়ের সপক্ষেও কথা বলেন।

দ্বিমত দেখা যায় বিজ্ঞানীদের মধ্যেও। একদল দাবি করে মানব ক্লোনিং শুরু হলে বিতর্ক ওরও বাড়বে। বাধা আসবে সমাজের নানা দিক থেকে। আবার ভিন্ন মতও দেখা যায় বিজ্ঞানীদের মধ্যে। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চের জন্য এতদিন ইঁদুর, গিনিপিগ, খরগোশ জাতীয় প্রাণির উপর নানা অত্যাচার চলত। বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বার্থে একাধারে চলত প্রাণিহত্যা। কিন্তু, ক্লোনিংয়ের গবেষণা সফল হলে এই প্রাণী নিধনে ইতি পড়বে। তবে, মানব ক্লোনিং নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে। এই তর্কের শেষ কোথায় সেই নিয়ে এখনও ধন্দে বিজ্ঞানীরা।

সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার পদ্ধতিতেই ‘ঝং ঝং’ ও ‘হুয়া হুয়া’র ‘ক্লোন’ তৈরি করা হয়েছে। কী ভাবে হয় সেই পদ্ধতি? দেখুন ভিডিও:

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে মানব ক্লোনিং নিষিদ্ধ। ইংল্যান্ড, চিন, সুইডেন, সিঙ্গাপুর এবং ইসরায়েলে পুরোপুরি নিষিদ্ধ না হলেও শুধুমাত্র গবেষণার কাজে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা যেতে পারে।

এখন ‘ঝং ঝং’ এবং ‘হুয়া হুয়া’র গবেষণার সাফল্যের পর এই পদ্ধতি মানব ক্লোনিংয়ের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়ে ইন্দ্রনীলবাবু বলেছেন, ‘‘এই পরীক্ষা এখনও অনেক দুর্বল। মানুষের উপর তার প্রয়োগ সম্ভব নয়।’’

সৌরভ ও ইন্দ্রনীল এর পিছনে দু’টি কারণ দেখিয়েছেন

প্রথমত, ১২৭টি ডিম্বকোষ থেকে মাত্র দু’টি সুস্থ ম্যাকাকা বাঁদরের জন্ম হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ভ্রুণ কোষ থেকে নিউক্লিয়াসটিকে সরিয়ে নিয়ে ক্লোনিং করেছিলেন। পরিণত এবং প্রাপ্তবয়স্ক দেহকোষ থেকে নিউক্লিয়াস সরিয়ে নিয়ে পরীক্ষা চালানোর পদ্ধতি অনেক জটিল। সে ক্ষেত্রে গর্ভের মধ্যে ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশি।

গভীর অন্ধকারে মশাল জ্বালিয়ে চলার যে পথ বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছিলেন ক্লোনিং-এর মাধ্যমে, সেই পথে আশার আরও একটি বাতি জ্বালাল এই গবেষণা।

গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।

ভিডিও সৌজন্যে: ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়।​

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE