Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
কলকাতা প্রিমিয়ার লিগ // ইস্টবেঙ্গল ৫ : পিয়ারলেস ১

সুরাবুদ্দিনের হ্যাটট্রিকে রোশনাই

বজবজের যে ছেলেটি এ দিন খালিদ জামিলের টিমে রোদ এনে দিলেন, সেই সুরাবুদ্দিনের জীবনেও তো এত দিন ছেয়েছিল আলো-আঁধারি। মোহনবাগানের অনূর্ধ্ব ১৯ ফুটবলার হিসাবে খেলার পর মহমেডানে খেলেছেন।

উৎসব: হ্যাটট্রিকের পরে উচ্ছ্বাস সুরাবুদ্দিনের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

উৎসব: হ্যাটট্রিকের পরে উচ্ছ্বাস সুরাবুদ্দিনের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০৫:০১
Share: Save:

শনিবারের ময়দানি বিকেলের সঙ্গে সুরাবুদ্দিন মল্লিকের জীবনের কী অদ্ভুত মিল!

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ওপর থেকে লাল-হলুদ গ্যালারির ওপর মাঝে মধ্যে ছেয়ে ফেলছিল কালো মেঘ। ঝেঁপে আসছিল আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পরেই আবার বেরিয়ে পড়ছিল আদিগন্ত নীল আকাশ। রোদ্দুরও।

বজবজের যে ছেলেটি এ দিন খালিদ জামিলের টিমে রোদ এনে দিলেন, সেই সুরাবুদ্দিনের জীবনেও তো এত দিন ছেয়েছিল আলো-আঁধারি। মোহনবাগানের অনূর্ধ্ব ১৯ ফুটবলার হিসাবে খেলার পর মহমেডানে খেলেছেন। তার পর তিনি নাম লিখিয়েছিলেন টালিগঞ্জ অগ্রগামীতে। মাঝে ওএনজিসি-র হয়ে আই লিগও খেলছেন। গোল করেছেন অনেক। করিয়েছেনও। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুরাবুদ্দিনকে বাতিল করে দিয়েছিল বড় ক্লাবেরা। ভাগ্য ফেরাতে তাই তিনি চলে গিয়েছিলেন গোয়ায়। চার্চিল ব্রাদার্সে। সেখানেই পুনর্জন্ম। আই লিগে দারুণ খেলে নজরে পড়ার পরে ফের নিজের শহরে ফেরা। এবং কী আশ্চর্য ইস্টবেঙ্গলে এসেও প্রথম একাদশে জায়গা নেই তাঁর। রিজার্ভ বেঞ্চে শুধুই অপেক্ষায় থাকা।

আরও পড়ুন: ইস্টবেঙ্গলের স্বপ্ন এখন চুলোভা

অপেক্ষা এ দিনও করছিলেন সুরাবুদ্দিন। বিরতিতে ম্যাচ ১-১। পিয়ারলেসের ভূখন্ড থেকে ধেয়ে আসছে একের পর এক আক্রমণ। লাল-হলুদের ক্রস পিস ছুঁয়ে বল গোল লাইন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে মশাল বাহিনী। গ্যালারিতে দীর্ঘশ্বাস।

আর ঠিক তখনই পরপর দু’টো পরিবর্তন করলেন খালিদ জামিল। গ্যাব্রিয়েল ফার্নান্ডেজ আর সুরাবুদ্দিনকে নামিয়ে দিলেন ইস্টবেঙ্গল কোচ। এই জোড়া পরবর্তনেই সব ওলট পালট। যা সুনামির চেহারা নিল সব মিলিয়ে ছয় মিনিট। ৭০ থেকে ৭৬। ১-১ থেকে ৪-১ হয়ে গেল ওই সময়ই। এবং সবথেকে যেটা চমকে দেওয়ার তা হল, তিনটি গোলের মালিকই ওই দুই পরিবর্ত ফুটবলার। সুরাবুদ্দিন শেষ গোলটা করে যখন হ্যাটট্রিকের মুকুট পড়লেন তখন ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গড়িয়েছে। হাঁটু মুড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সেলিব্রেশন করার সময় বছর পঁচিশের ছেলেটির মুখে যেন ঠিকরে পড়ছিল হাজার হাজার ওয়াটের আলো।

‘‘স্বপ্ন ছিল ইস্টবেঙ্গলে খেলা। সেখানে জীবনের প্রথম হ্যাটট্রিকটা পেলাম,’’ বলার সময় খালিদের টিমের মিডিওর গলায় আবেগ আর উচ্ছ্বাস মিলে মিশে একাকার। পেটানো এবং একটু ভারি চেহারা। ‘‘টালিগঞ্জের হয়ে গত দু’মরসুম ভাল খেলার পরেও কেউ নেয়নি আমাকে। অভিমান করে গোয়ায় চলে গিয়েছিলাম। এ ভাবে হ্যাটট্রিক পেয়ে যাব ভাবিনি। জীবনের সেরা দিন আজ।’’ তাঁর নয় বছরের ফুটবল জীবনে কখনও এ ভাবে ঘিরে ধরেনি সমর্থক। সংবাদমাধ্যমও। তৃপ্ত লাগছিল সুরাবুদ্দিনকে।

বড় ক্লাবের জার্সিতে পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসাবে নেমে কলকাতা লিগে হ্যাটট্রিক। লিগের ১১৯ বছরের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা শেষ কবে ঘটেছে মনে করা যাচ্ছে না। এই কৃতিত্ব সুরাবুদ্দিনের জীবন বদলে দিল কিনা সময় বলবে, তবে আটে আট করতে মরিয়া ইস্টবেঙ্গল কিন্তু প্রতি ম্যাচেই বিরতির পর বদলাচ্ছে। এবং সেটা শেষ তিনটি ম্যাচেই প্রমাণিত। তিন ম্যাচে ১১ গোল। পড়শি ক্লাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আবার ইস্টবেঙ্গল লিগ শীর্ষে।

যে তিনটি দলের সঙ্গে খেলল খালিদের টিম, তার মধ্যে পিয়ারলেসই ছিল সবথেকে শক্তিশালী। ফুজা তোপের মতো বিদেশি কোচ, দুই ময়দানের পরিচিত বিদেশি, রহিম নবির মতো ক্লান্তিহীন পাসার। এই টিমের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল শুরু করেছিল ম্যাড়মেড়ে ভাবে। উইলস প্লাজার গোলের খরা কাটানো ছাড়া প্রথমার্ধ ছিল সাদামাঠা। পুরানো চাল ভাতে বাড়ার মিথ অটুট রেখে রহিম নবির গোলে পিয়ারলেস সমতায় ফেরার পরে মনে হচ্ছিল, এ কোন ইস্টবেঙ্গল?

লা লিগা বা ই পি এলের গ্যালারি নিয়মিত টিভিতে দেখার পরে কলকাতা মাঠের চরিত্রেও বদল ঘটেছে। টিম খারাপ খেললে বাছা বাছা গালাগালি উড়ে আসা কমেছে গ্যালারি থেকে। তার বদলে প্রিয় টিমকে তাতাতে শুরু হচ্ছে গান। ওড়ানো হচ্ছে পতাকা। যেমন হয় মাদ্রিদে, ম্যাঞ্চেস্টারে। বেশ ভাল দেখাচ্ছিল টিমের দুঃসময়েও লাল-হলুদের গ্যালারির একাংশকে। যাঁরা হাততালি দিয়ে নাগাড়ে গান গাইছিলেন। এ রকম গানই তো জন্ম দেয় নতুন তারকার। সুরাবুদ্দিন, গ্যাব্রিয়াল, চুলোভা, ব্র্যান্ডনরা তেতে উঠবেন, স্বাভাবিক। সিরিয়া থেকে আসা আল আমনার মতো হাই প্রোফাইল ফুটবলার কাদা, ভারি মাঠেও হৃদয় দিয়ে খেলে দিলেন এ সব দেখে। চোটের ঝুঁকি নিয়েও। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও মাঠ ভর্তি করে এসেছিলেন দর্শক। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ থাকলেও তাঁরা অপেক্ষা করেছেন।

ইন্ডিয়ান সুপার লিগের রমরমার বাজারেও এই ক্যানভাসই কিন্তু কলকাতার ফুটবলকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। মরতে দেয়নি।

ইস্টবেঙ্গল: লুই ব্যারেটো, সামাদ আলি মল্লিক, কার্লাইল মিচেল, গুরবিন্দর সিংহ, লালরাম চুলোভা, প্রকাশ সরকার, আল আমনা, ব্রন্ডন ভানলালরেমডিকা (ইয়ামি লংগোভা), লালডানমাওয়া রালতে (সুরাবুদ্দিন), ভিপি সুহেইর (গ্যাব্রিয়েল ফার্নান্ডেজ), উইলস প্লাজা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

East Bengal CFL CFL 2017 Football
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE