Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘রহস্য-স্পিনার নয়, আমি হতে চাই দক্ষ স্পিনার’

চায়নাম্যান করার ‘অপরাধে’ বাদ পড়েছিলেন দল থেকে, ফাঁস করলেন ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন তারকা কুলদীপ যাদবরবিবার কলকাতা নাইট রাইডার্সের হোটেলে বসে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সময় অন্য এক কুলদীপ যাদব-কে আবিষ্কার করা গেল। চিন্তাধারার গভীরতায় যিনি ক্রমাগত চমক সৃষ্টি করে গেলেন তাঁর চায়নাম্যান বোলিংয়ের মতোই!  

আত্মবিশ্বাসী: নাইটদের হোটেলে কুলদীপ যাদব। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

আত্মবিশ্বাসী: নাইটদের হোটেলে কুলদীপ যাদব। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৮ ০৪:১৪
Share: Save:

ভারতীয় ক্রিকেট আকাশে উদিত নতুন তারা তিনি। কেউ ধরতে পারছে না তাঁর বোলিংয়ের রহস্য। আশ্চর্য! তিনি নিজে রহস্য স্পিনারের তকমা নিয়ে চলতে চান না। হতে চান দক্ষ স্পিনার। রবিবার কলকাতা নাইট রাইডার্সের হোটেলে বসে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সময় অন্য এক কুলদীপ যাদব-কে আবিষ্কার করা গেল। চিন্তাধারার গভীরতায় যিনি ক্রমাগত চমক সৃষ্টি করে গেলেন তাঁর চায়নাম্যান বোলিংয়ের মতোই!

প্রশ্ন: আপনার ক্রিকেট জীবনে আইপিএলের ভূমিকা কতটা?

কুলদীপ যাদব: সালটা ২০১৪। অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপে খেলে ফেরার পরেই আইপিএলের জন্য তুলে নেয় কেকেআর। প্রথম বছরে আইপিএলে খেলার সুযোগ পাইনি। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সুযোগ পেয়ে নজরে পড়েছিলাম। সম্ভবত পাঁচ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়েছিলাম। তার পরেই ভারতের হয়ে খেলার জন্য ডাক পাই (যদিও এয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেই সিরিজে কোনও ম্যাচে খেলেননি)। আমার ক্রিকেট জীবনে তাই খুবই বড় ভূমিকা রয়েছে আইপিএল এবং কলকাতা নাইট রাইডার্সের।

প্র: কেকেআরে শুরুর দিকের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

কুলদীপ: দারুণ। যে দিকে তাকাচ্ছি, কিংবদন্তি আর তারকায় ভর্তি। ওয়াসিম আক্রম। জাক কালিস। গৌতম গম্ভীর। ওঁরা সকলে খুব সাহস দিয়েছিলেন। তখন আমার বয়স ১৯। ওই সময়টাতে সমর্থনের খুব দরকার ছিল। সেটা ওঁরা দিয়েছিলেন।

প্র: ওয়াসিম আক্রমই তো আপনার ছোটবেলার আদর্শ? ওঁর মতো হবেন বলে পেস বল করতেন?

কুলদীপ: (হাসি) কেকেআরে আসার পরে প্রথম যে দিন ওয়াসিম আক্রমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, আমি যেন আনন্দে আকাশে ভাসছিলাম। আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল ফাস্ট বোলার হব। আর স্বপ্ন দেখতাম, ওয়াসিম আক্রমের মতো বল করব। কেকেআর শিবিরে প্রথম বার দেখা হওয়ার দিনে আমি সেই স্বপ্নের কথা ওঁকে বলি। শুনে উনি বললেন, ‘‘ভাল হয়েছে ফাস্ট বোলিং করিসনি। তা হলে আমার সঙ্গে দেখাই হত না।’’

প্র: আক্রমের থেকে বিশেষ কোনও উপদেশ পেয়েছিলেন?

কুলদীপ: অনেক অমূল্য উপদেশ পেয়েছিলাম। আমার ওপর খুব আস্থা ছিল ওয়াসিম ভাইয়ের। খুব উৎসাহ দিতেন। এত বড় এক জন কিংবদন্তি হয়েও প্রিয় বন্ধুর মতো মিশতেন। ম্যাচ পরিস্থিতি খুব ভাল বোঝাতে পারতেন উনি। যে ম্যাচে খেলতাম না, ডাগ-আউটে ওয়াসিম ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসতাম। ডাগ-আউটে বসে আমরা সারাক্ষণ কথা বলতাম। ব্যাটসম্যান যখন মারবে, কী করা উচিত? যে দিন ছন্দ পাচ্ছি না, কী করব? কোন ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে কী ধরনের ফিল্ডিং সাজানো দরকার? সব কিছু বলে দিতেন উনি। ওঁর মতো কিংবদন্তিকে পাশে পেয়েছিলাম বলে খুব দ্রুত পরিণত হয়ে যাই আমি।

প্র: আক্রমের সব চেয়ে মূল্যবান পরামর্শ কোনটা?

কুলদীপ: উনি বলেছিলেন, বোলারকে আক্রমণাত্মক মানসিকতার হতে হয়। সে ফাস্ট বোলারই হোক কী স্পিনার। চিন্তাভাবনায় রক্ষণাত্মক হলে সেই বোলার তার দলের ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারে না। এখনও এটা মনে রেখেছি আমি।

প্র: শুনেছি, অনুশীলনে প্রথম যে দিন পেস বোলিং ছেড়ে স্পিন করান, প্রথম বলটাই হয়ে যায় চায়নাম্যান! তখন নাকি জানতেনও না এই বিশেষ ডেলিভারিটাকে চায়নাম্যান বলে!

কুলদীপ: এগারো বছরের একটা ছেলে চায়নাম্যান কী, তা জানবেই বা কী করে? কোচ বললেন, পেস ছেড়ে স্পিন করো। আমি একদমই করতে চাইনি। এক দিন উনি খুব জোর দিয়ে বললেন, স্পিন করো। অনিচ্ছা নিয়ে করা প্রথম বলটাই ছিল চায়নাম্যান।

প্র: অ্যাকাডেমিতে নিশ্চয়ই খুব হইচই পড়ে গিয়েছিল সে দিন?

কুলদীপ: অনেকে অবাক হয়ে বলেছিলেন, এই বলটা ও কোথা থেকে করে দিল? এর পর আমি আরও কয়েকটা চায়নাম্যান করলাম। স্যর এক জনকে বললেন, এই ছেলেটা বিশেষ প্রতিভা।

প্র: অর্থাৎ বিস্ময় বালক হিসেবে সেই আপনার যাত্রা শুরু?

কুলদীপ: একেবারেই সে রকম কিছু ছিল না। বরং চায়নাম্যান বোলিং করতে গিয়ে শুরুতে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলাম। দল থেকে আমাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার অপরাধ? এমন একটা বল করি, যেটা কেউ করে না। সবাই বলতে থাকল, ধুর, এটা আবার কোনও বল নাকি? ফালতু কিছু হবে। কিন্তু আমি হিম্মত হারাইনি। চায়নাম্যান করে উইকেট তুলতে থাকি। বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় সুযোগ পাওয়ার পরে নতুন রাস্তা খুলে যায় আমার সামনে।

প্র: সাহসই কি স্পিনারের সেরা সম্পদ?

কুলদীপ: একদমই তাই। ভয় পেয়ে ক্রিকেট খেললে কিছুই করা যাবে না। ব্যাটসম্যান চার-ছক্কা মারবেই। ক্রিকেটে বোলারই তো মার খায়। আবার বোলারই তো উইকেট নেয়। ভয় পেয়ে বোলিং করা যায় না। যার বল টার্ন করে না, তাকে আমি কোনও স্পিনারই মনে করি না। যে ফ্লাইট করায় না, সে কিসের স্পিনার?

প্র: অনেকে আপনাকেই বিশ্বের সেরা রহস্য-স্পিনার বলছে।

কুলদীপ: আমি রহস্য-স্পিনার হতে চাই না। কেন জানেন? যে দিন রহস্য ভেদ হয়ে গেল, সে দিন তো আমি শেষ হয়ে গেলাম! আমি চাই দক্ষ স্পিনার হতে। যার মধ্যে গুণগত উৎকর্ষ থাকবে। যার বলে ফ্লাইট থাকবে, টার্ন থাকবে, হাওয়ায় খেলা করবে, বৈচিত্র থাকবে। ক্রিকেটে যাঁরা স্পিনের কিংবদন্তি, তাঁরা কেউ রহস্য স্পিনার ছিলেন না। শেন ওয়ার্ন বল টার্ন করাতেন, ফ্লিপার দিতেন, টপস্পিন দিতেন, গুগলি করাতেন। মুরলীধরন দু’ধরনের বল করতেন। অফস্পিন আর দুসরা। রহস্য-স্পিনার নয়, ওঁরা ছিলেন সুদক্ষ স্পিনার।

প্র: এখন এত বেশি ভিডিয়ো বিশ্লেষণের যুগে স্পিনারের জীবন কি অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছে?

কুলদীপ: ভিডিয়ো বিশ্লেষণ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কাজে দিতে পারে। কারণ, এখানে যে কোনও বোলারকে মাত্র চারটি ওভারই খেলতে হয়। টেস্ট বা ওয়ান ডে-তে ভিডিয়ো বিশেষ কাজে আসবে না। রহস্য বোলারের জন্য ভিডিয়ো সাহায্য করতে পারে, ভাল বোলারকে অকেজো করতে পারবে না। ওয়ার্নের ভিডিয়ো তো ব্যাটসম্যানেরা কত দেখেছে। তাতে কী ওয়ার্নকে থামানো গিয়েছে?

প্র: সামনের বছর বিশ্বকাপ। নতুন স্বপ্ন দেখা কি শুরু হয়ে গিয়েছে?

কুলদীপ: বিশ্বকাপের এখনও দেরি আছে। তার আগে অনেক ক্রিকেট রয়েছে। আইপিএল চলছে, নাইট রাইডার্সের হয়ে ভাল করতে চাই। তার পরে ইংল্যান্ড সফর রয়েছে। ইংল্যান্ডে আমি কখনও খেলিনি। জানি না কেমন উইকেট থাকবে। অবশ্য সেটা নতুন কিছু নয়। কখনও ম্যাচের আগে আমি পিচ দেখি না।

প্র: কুলচা জুটির (কুলদীপ ও চহাল) এই সাফল্যের রহস্য কী?

কুলদীপ: দু’জনেই উইকেট তোলার চেষ্টা করি বলে মানসিকতায় আমরা একই রকম। দু’জনে দু’জনকে চিনি প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। আমরা একে অন্যের সাফল্য খুব উপভোগ করি, একে অন্যকে সব সময় সমর্থন করি। মনে হয় সেটাই আমাদের জুটির সাফল্যের প্রধান কারণ। আমাদের মধ্যে কখনও ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয় না। মাঠের মধ্যে সারাক্ষণ আমরা কথা বলতে থাকি। ও আগে বোলিং শুরু করলে আমাকে এসে বলে, কী করতে হবে। আমি আগে শুরু করলে ওকে গিয়ে বলি, পিচের চরিত্র কেমন। আমাদের বোঝাপড়াটা দারুণ।

প্র: কেকেআরে সুনীল নারাইনের সঙ্গে জুটি? সেটা নিয়ে কী বলবেন?

কুলদীপ: কেকেআরে আমরা তিন জন আছি। সুনীল নারাইন, আমি আর পীযূষ চাওলা। আমার মনে হয়, আইপিএলের সেরা স্পিন বিভাগ আমাদের। প্রচুর কথা বলি আমরা নিজেদের মধ্যে।

প্র: নারাইনের থেকে বিশেষ কিছু শিখেছেন, যেটা খুব কাজে দিচ্ছে?

কুলদীপ: সুনীলের বোলিংয়ের ধরন আমার চেয়ে অনেক আলাদা। ও অফস্পিন করে। সহজে ওকে ধরতে পারে না ব্যাটসম্যান। সুনীলকে দেখে মূল্যবান শিক্ষা হচ্ছে, এমন বোলার হতে হবে যে প্রতিপক্ষের উপর চাপ তৈরি করতে পারবে।

প্র: চায়নাম্যান বোলিং করা কতটা কঠিন? খুবই বিরল শিল্প তো এটা।

কুলদীপ: আমার কাছে এখন আর হয়তো কঠিন লাগে না। তবে শুরুতে প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। অনেক রাত জেগে কাটিয়েছি শুধু চায়নাম্যান বোলিং নিয়ে ভাবতে ভাবতে। ভোরবেলা হতেই দৌড়ে গিয়েছি মাঠে। ভোর পাঁচটায় মাঠে পৌঁছে তিন, সাড়ে তিন ঘণ্টা টানা বল করে যেতাম। কিছুক্ষণের বিশ্রামের পরে দুপুরে আবার দু’টো থেকে পাঁচটা বোলিং। আমি বুঝেছিলাম, চায়নাম্যান বোলার হিসেবে সফল হতে গেলে প্রচুর বল করতে হবে। এখনও মাঠে গিয়ে প্রথমে খালি উইকেটে আমি আধ ঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট বল করে দেখে নিই যে, ছন্দটা হারিয়ে ফেলিনি তো! পরীক্ষার আগে যেমন ‘রিভিশন’ করতে হয়, আমি নিজের বোলিংটাকেও সে ভাবে দেখি। ছন্দটা পেয়েছি। এ বার সেটাকে ধরে রাখতে ‘রিভিশন’ দিয়ে যেতে হবে।

প্র: চায়নাম্যান বোলিংটা করা শিখলেন কাকে দেখে?

কুলদীপ: কখনও কাউকে চায়নাম্যান বোলিং করতে দেখিনি। শেন ওয়ার্নকে দেখেই আমি শেখার চেষ্টা করে গিয়েছি।

প্র: ওয়ার্নের সঙ্গে তো কথাও হয়েছিল আপনার?

কুলদীপ: আমার কাছে স্বপ্ন মনে হয়েছিল ওয়ার্নের সঙ্গে দেখা হওয়াটা। উনি হাতের অবস্থান নিয়ে কয়েকটি পরামর্শ দেন, যা অমূল্য হয়ে থাকবে।

প্র: প্রতিপক্ষ দলে ক্রিস গেলের মতো ব্যাটসম্যান আছে দেখলে আপনি কী ভাবে রণনীতি সাজান?

কুলদীপ: ক্রিস গেল ব্যাট করুক কী এ বি ডিভিলিয়ার্স— আমার মানসিকতায় কোনও তফাত হয় না। গেল তো শুধু ছক্কাই মারবে, আর কী করবে! বিরাট কোহালির মতো কাউকে বল করাটা অনেক বেশি কঠিন। শুনুন, ব্যাটিংয়ে ছক্কা মারাটাই কিন্তু একমাত্র গুণ নয়। যে ব্যাটসম্যান এক রান, দু’রান, চার, ছক্কা সব ধরনের স্কোরিং শট খেলতে পারে, আমার কাছে সে অনেক বেশি বিপজ্জনক। গেলের মতো ব্যাটসম্যান অনেক ডট বলও (যে বলে কোনও রান হয় না) খেলে। বিরাট কোহালি ডট বল খেলবেই না। ও ছন্দে থাকলে প্রত্যেক বলে রান করবে। গেল একটা ছক্কা মেরে পরের তিনটে বল ডট খেলতে পারে। তা হলে চার বলে হল ৬। কোহালি ছন্দে থাকলে চার বলে হবে ৮ বা ১০। কোনও বলে চার মারবে, কোনওটায় দুই রান, পরেরটা হয়তো আবার দু’রান। এটা অনেক বেশি চাপ তৈরি করে বোলারদের ওপর। আমার কাছে তাই ক্রিস গেলের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান বিরাট কোহালি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE