শহরে চ্যাম্পিয়নরা। সোমবার। ছবি: উৎপল সরকার
বাসের পিছনে জ্বলজ্বল করছে লেখাটা— ‘আ ফ্লিট ফিট ফর দ্য কিঙ্গস অব দ্য আইএসএল’।
সোমবার বিকেল পাঁচটা। দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত শপিং মল। ঠিক সামনের বাসটা থেকে একে একে নেমে আসছেন যাঁরা, সবাই চেনে তাঁদের। কারও নাম ইয়ান হিউম। কারও নাম বোরহা ফর্নান্ডেজ। কাউকে আবার লোকে চেনে দেবজিৎ মজুমদার নামে।
রাজা, এঁরা সব রাজা। কিঙ্গস অব আইএসএল!
শীতের পার্ক সার্কাস চত্বর যাঁদের দেখে মুহূর্তে যেন তেতে গেল। শহরের শৈত্যকে হারিয়ে হাজির হয়ে গেল গমগমে গানের সঙ্গে উদ্দাম নাচ। কোচ জোসে মলিনাকে চ্যাংদোলা করে উন্মত্ত লোফালুফি। শপিং মলে ঢোকামাত্র যা শুরু করে দিলেন হিউম-দেবজিতরা। দেবজিৎ মজুমদারকে দেখা গেল মিউজিক সিস্টেমের এটিকে থিম সং ‘আমার বুকে এটিকে’-র সঙ্গে নাচছেন পাগলের মতো। সঙ্গী কে? কে আবার, জুয়েল রাজা! সঞ্জীব গোয়েন্কা, এটিকে কর্ণধার—তাঁকে পর্যন্ত দেখা গেল গানের তালে কোমর দোলাতে! আর তা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছেন কে? না, টিমের অন্য দুই মালিক হর্ষ নেওটিয়া ও উৎসব পারেখ। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে শুধু পাওয়া যায়নি। সিএবি বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে কী? সৌরভ তো পরে সিএবিতে বলে দিলেন, ‘‘গতকালের রাতটা টেরিফিক ছিল। পরের বার কলকাতায় আইএসএল ফাইনাল আনার চেষ্টা হচ্ছে।’’
শপিং মলে ফেরা যাক। ঠাসা ভিড়ে তখন পা ফেলার উপায় নেই। ঘূর্ণায়মান মঞ্চে ঝকঝক করছে আইএসএল ট্রফিটা। আর সেই দৃশ্য লেন্সবন্দি করতে হুড়োহুড়ি আট থেকে আটান্নর। হঠাৎই টিম মালিকের হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নেন ইয়ান হিউম। বলতে থাকেন, ‘‘আমাদের শার্টে এ বার থেকে দু’টো তারা থাকবে।’’ গত বছর কেরল ছেড়ে এটিকে-র ডেরায় উঠেছিলেন হিউম। স্রেফ আইএসএল ট্রফিটা ধরবেন বলে।
আটলেটিকোর অন্যতম মালিক এ বার ডেকে নেন জুয়েলকে। কানে কানে কিছু বললেন। আর তার পরেই শপিং মল কাঁপিয়ে জুয়েলের হুঙ্কার, ‘‘জিতবে কে? এটিকে...।’’ এ বার আর আবেগ সামলাতে পারলেন না এটিকে কোচ। যিনি সোমবার রাত পর্যন্ত কোনও শুভেচ্ছা বার্তা পাননি মাদ্রিদে তাঁর প্রতিবেশি আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের কাছ থেকে। মাইক্রোফোন এ বার তাঁর হাতে। আবেগরুদ্ধ গলায় তিনি বললেন, ‘‘কলকাতা তোমাকে ধন্যবাদ।’’
ভক্তদের হুড়োহুড়ি অবশ্য শুরু হয় টিম এটিকে-র বিমান কলকাতার মাটি ছোঁয়ার পরেই। বিমানবন্দর কর্মীদের সেলফি তোলার ধুম, ফ্যান ক্লাবের উন্মাদনা— কিছুই বাদ যায়নি। আফসোসও ছিল। ভিসা সমস্যায় যে কোচি থেকেই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন মার্কি হেল্ডার পস্টিগা, সামিঘ দ্যুতি, নাতো এবং ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ সেরেনো। যদিও তাতে সেলিব্রেশনের রং ফিকে হয়নি।
ট্রফি হাতে সঞ্জীববাবুও ততক্ষণে হাজির মিডিয়াকে দু’টো জবরদস্ত বক্তব্য পেশ করে ফেলেছেন।
এক, মলিনাই পরের বছর তাঁদের কোচ। যা শুনে এটিকে-র স্প্যানিশ কোচ বলে ওঠেন, ‘‘এখন উৎসবের সময়। ভবিষ্যৎ নিয়ে পরে চিন্তা ভাবনা করা যাবে।’’
আর দুই, একটি শহর থেকে একটি টিম— নীতি মানলে তো কলকাতার একটাই টিম। এটিকে। সঞ্জীববাবুর এই বক্তব্য শুনে মোহনবাগান অর্থসচিব দেবাশিস দত্তর প্রতিক্রিয়া, ‘‘বাঙালির যে রক্তে ফুটবল তা ফের প্রমাণ করল এটিকে। কিন্তু এই রক্তে ফুটবলটা তো গত একশো বছর ধরে ঢুকিয়েছি আমরাই। তাই ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানকে বাদ দিয়ে ভারতীয় ফুটবল হয় না।’’ মোহনবাগানের মতো অবশ্য এত মোলায়েম নয় ইস্টবেঙ্গলের প্রতিক্রিয়া। তাদের অন্যতম শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকার বলেন, ‘‘কলকাতাই যে ফুটবলের মক্কা তা ফের প্রমাণ করল এটিকে। কিন্তু একটা শহর থেকে ক’টা টিম খেলবে আগামী দিনে তা সঞ্জীববাবু ঠিক করবেন না। ওটা ঠিক করবে ফেডারেশন।’’ একটু থেমে তিনি ফের বললেন, ‘‘সঞ্জীববাবু সফল ব্যবসায়ী। সদ্যোজাত শিশু জন্মের পর তিনি যে শিশুসুলভ কথাবার্তা বলবেন, সেটাই স্বাভাবিক। দু’বার চ্যাম্পিয়ন করেছে তো সেই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলাররাই।’’
ততক্ষণে এটিকে ফুটবলারদের নিয়ে বীরপুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। কোচিতে রবিবার সেলিব্রেশন হয়নি সেখানকার মন্ত্রীর প্রয়াণে ‘ড্রাই ডে’ ছিল বলে। কিন্তু কলকাতার সেলিব্রেশন এতটাই জমকালো যে ভিড় সামলাতে হিমশিম পুলিশ। যা দেখে দ্রুত হিউমদের নিয়ে পাঁচতলার রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়েন কর্তারা। এক দিকের লিফট বন্ধ। চলমান সিঁড়িতেও বাউন্সারদের ছড়াছড়ি। তাতে অবশ্য উৎসাহে বিন্দুমাত্র ঘাটতি পড়েনি।
শুধু একটাই যা দুঃখ। উৎসবের মধ্যে চাপা যন্ত্রণা। ইয়ান হিউমের যন্ত্রণা। পেনাল্টি মিসের যন্ত্রণা। যা নিয়ে হিউমকে বলতে শোনা গেল, ‘‘ওই সময় কতটা যন্ত্রণা হচ্ছিল সেটা এক মাত্র আমিই জানি। জিতলে না পারলে নিজেকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারতাম না।’’
কিন্তু আজকের মতো বোধহয় এই যন্ত্রণা, এক শহর এক টিম নিয়ে বিবাদ, ভুলে থাকাই যায়। আছে তো পড়ে আরও তিনশো পঁয়ষট্টি দিন। আজকের মতো থাকুক না ‘আমার বুকে এটিকে!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy