Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কোহালি ক্লাসিকের পরে জবাব দিচ্ছেন ডিভিলিয়ার্স

কোহালি এ দিন ঠিক সেই সংখ্যাটাই ধরলেন অনেকটা একই রকম পরিস্থিতি থেকে দলকে টেনে তুলে। লারার মতো তিনি এখনও দলকে জিতিয়ে উঠতে পারেননি।

মুহূর্ত: ২১তম টেস্ট সেঞ্চুরি করে কোহালি। সোমবার সেঞ্চুরিয়নে। ছবি: রয়টার্স।

মুহূর্ত: ২১তম টেস্ট সেঞ্চুরি করে কোহালি। সোমবার সেঞ্চুরিয়নে। ছবি: রয়টার্স।

সুমিত ঘোষ
সেঞ্চুরিয়ন শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:০০
Share: Save:

বিশ্ব ক্রিকেটের দুই সেরা ব্যাটসম্যান। চুম্বকে তাঁদের দ্বৈরথের উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেঞ্চুরিয়ন টেস্টের ভাগ্য। দুই নক্ষত্রের ছোঁয়ায় ক্রিকেটই সুন্দর হয়ে উঠল সোমবার।

একেবারেই অবাক হওয়ার নেই যে, দিনের শেষে ক্রিকেটারেরা যখন টিম বাসে করে হোটেলের দিকে রওনা হচ্ছেন, দু’জনের জন্য দাঁড়িয়ে প্রচুর ক্রিকেট ভক্ত। ভিড়ের মধ্যে থেকে দু’টো নাম ধরে গর্জন উঠছে। ‘কোহালি, কোহালি’। ‘এ বি, এ বি’।

প্রথমে দিনের নায়কের আসন ছিনিয়ে নিলেন বিরাট কোহালি। রাজসিক ভঙ্গিতে একার কাঁধে ভারতকে তিনি ম্যাচে ফিরিয়ে আনলেন। রবিবার যখন ব্যাট করতে নেমেছিলেন ভারত অধিনায়ক, খটখটে রোদ্দুরের মধ্যেই টিমের মাথার উপর কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল। পর-পর দু’বলে দুই উইকেট হারিয়ে ভারত তখন ২৮-২। রাহুল দ্রাবিড়-উত্তর যুগে ‘নতুন দেওয়াল’ চেতেশ্বর পূজারা প্রথমে বলে রান আউট হয়ে গেলেন। মনে হয়েছিল হিমশৈলে ধাক্কা লেগে গিয়েছে। টাইটানিক ডুবতে শুরু করবে এক্ষুনি। রবিবারেই না সিরিজের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। সেঞ্চুরিয়নেও ব্যাটিং ধস নামা মানে তো সিরিজেই আর আশা রইল না।

সেখান থেকে পাল্টা লড়াই শুরু করে এ দিন যখন দলের শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মর্নি মর্কেলের বলে বিগ হিটের খোঁজে যেতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে ধরা পড়লেন কোহালি, ডাঙা দেখা যাচ্ছে। মাত্র ২৮ রানে পিছিয়ে থেকে প্রথম ইনিংস শেষ করল ভারত। দলের মোট স্কোর ৩০৭। কোহালি একাই ১৫৩। অর্থাৎ, পঞ্চাশ শতাংশ রান এসেছে শুধু তাঁরই ব্যাট থেকে।

১৫৩ সংখ্যাটা আবার ক্রিকেট ব্যাটিংয়ের জন্য খুবই মোহময়ী একটা সংখ্যা। ব্রায়ান লারার মহাকাব্যিক সেই ইনিংস অনেকের মনে পড়ে যায় এই সংখ্যাটার কথা উঠলেই। ১৯৯৯ সালে বার্বেডোজে অবিশ্বাস্য ভাবে টেলএন্ডারদের নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টেস্ট জিতিয়ে দিয়েছিলেন লারা। সেই ইনিংসে তিনি করেছিলেন ১৫৩ নট আউট। ক্রিকেটে কোনও কোনও সংখ্যা ঐতিহাসিক হিসেবে থেকে যায়। যেমন ডন ব্র্যা়ডম্যানের ব্যাটিং গড় ৯৯.৯৪। অথবা সচিন তেন্ডুলকরের ১০০ সেঞ্চুরি। বিশ্বকাপে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিল দেবের ১৭৫ নট আউট। তেমনই থেকে গিয়েছে লারার ১৫৩।

কোহালি এ দিন ঠিক সেই সংখ্যাটাই ধরলেন অনেকটা একই রকম পরিস্থিতি থেকে দলকে টেনে তুলে। লারার মতো তিনি এখনও দলকে জিতিয়ে উঠতে পারেননি। বরং বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি এসে খেলা থামিয়ে দেওয়ার সময় দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংসে তুলে ফেলেছে ৯০-২। সব মিলিয়ে এগিয়ে গিয়েছে ১১৮ রানে। একটা যশপ্রীত বুমরার জোড়া আঘাতে তারা ৩ রানে ২ উইকেট হারিয়েছিল। সেখান থেকে হাফ সেঞ্চুরি করে কোহালির মতোই দলকে টানছেন এ বি ডিভিলিয়ার্স। ম্যাচ তাই এখনও পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। বলা যেতে পারে, কিছুটা এগিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা কারণ শেষ ইনিংসে এখানে ভারতকে ব্যাট করতে হবে।

হাফ সেঞ্চুরি করে কোহালির মতোই দলকে টানছেন এ বি ডিভিলিয়ার্স।

তবু কোহালির ইনিংসের সঙ্গে লারার সেই মহাকাব্যের মিল রয়েছে। ক্যারিবিয়ান প্রিন্সের মতোই একাকী লড়ে গেলেন ভারতীয় কিংগ। বাকিদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর মুরলী বিজয়ের ৪৬। কুড়ি পেরিয়েছেন মাত্র দু’জন। নব্বইয়ের দশকে একটা সময় ছিল যখন বিদেশে ক্রিকেট ম্যাচ মানে ছিল সচিন তেন্ডুলকর বনাম সেই দেশ। সেঞ্চুরিয়নে তেমনই হয়ে দাঁড়িয়েছিল কোহালি বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা। পঞ্চাশ, একশো, দেড়শো— একা ভারতীয় ইনিংসকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন তিনি। শেষ দু’বছরে অভাবনীয় তাঁর ‘কনভার্শন রেট’। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেই সেঞ্চুরি এবং বড় স্কোরের ওয়ারান্টি কার্ড থাকছে। একটা পরিসংখ্যান এ দিন টুইটারে দেখা গেল যে, নব্বইয়ে পৌঁছনোর পরে ১৬বার সেঞ্চুরি করেছেন কোহালি। দেখা যাচ্ছে সুনীল গাওস্করের ‘কনভার্শন রেট’-ও একই।

সকালে হার্দিক পাণ্ড্য বাগানে বেড়াতে বেরনোর ভঙ্গিতে রান আউট না হলে ভারত হয়তো প্রথম ইনিংসের স্কোরে এগিয়েও যেতে পারত। ক্রিজের সামনে গিয়েও ব্যাটই নামালেন না হার্দিক। ভার্নন ফিল্যান্ডারের থ্রো উইকেট ভেঙে দিল। জায়ান্ট স্ক্রিনে যখন দেখাচ্ছে হার্দিকের পা শূন্যে ঝুলছে, হতাশায় কোহালি ব্যাট আছড়ে মারলেন প্যাডে। এর পর অনেক বারই যা তাঁকে করতে দেখা যাবে।

অশ্বিন আসতেই বডিলাইন শুরু করে দিল দক্ষিণ আফ্রিকা। কাগিসো রাবাডার ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিবেগে টর্নেডো আছড়ে পড়ল ভারতীয় স্পিনারের হাতে। শুশ্রুষা নিতে হল ফিজিও ডেকে। পরের ওভারেই রাবাডাকে তিনটে বাউন্ডারি মেরে যোগ্য জবাব দিলেন অশ্বিন। তিনি ভালই সহায়তা দিয়ে গেলেন অধিনায়ককে। দু’জন মিলে সপ্তম উইকেটে যোগ করলেন ৭১ রান। এর মধ্যে অশ্বিনের অবদান ৫৪ বলে ৩৮।

অন্য দিকে সেই অনমনীয় কোহালি। নব্বই থেকে সেঞ্চুরিতে পৌঁছলেন রাজসিক সব শট খেলে। এর মধ্যে নব্বই থেকে চুরানব্বইয়ে পৌঁছে দিল যে কভার ড্রাইভ, তা দেখে সম্ভ্রমের চোখে হাততালি দিতে দেখলাম দক্ষিণ আফ্রিকান দর্শকদেরও। সেঞ্চুরি করলেন ১৪৬ বলে। শাসকের ভঙ্গিতে মারা দশটি বাউন্ডারি ছিল তাতে। পুরো ইনিংস ২১৭ বলে ১৫৩। বাউন্ডারি ১৫টি। কিন্তু সব চেয়ে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার স্ট্রাইক রেট— ৭০.৫০। যা দেখে মাইকেল হোল্ডিংও প্রভাবিত। বলে ফেললেন, ‘‘পিচটা আমাকে অবাক করেছে ঠিকই। তবু বলব, কোহালি একমাত্র ব্যাটসম্যান যে কি না বোলারদের শাসন করে রানটা করল। অন্যরা ওভারে ২ রান করে করছিল। কোহালি করছিল সাড়ে তিন, চার করে। সেই কারণে দর্শকরা ওর ব্যাটিং উপভোগ করেছে।’’

সেঞ্চুরি পূর্ণ করে বেশ আগ্রাসী ভঙ্গিতে সেলিব্রেশনও করতে দেখা গেল ভারত অধিনায়ককে! যা হালফিলে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও বাজছিল। বীরেন্দ্র সহবাগ থেকে শুরু করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশ— সেই বাজনা বাড়িয়েই চলেছিল কেপ টাউনে হারের পর। সেঞ্চুরিটা করার পরে তাই পুরনো সেই লাফটা দিতে দেখা গেল। ‘চেস্ট থাম্পিং’-ও করে বোঝাতে চাইলেন, তিনি শক্তিশালী, হার না মানা এক পুরুষ। টেস্টের একুশতম সেঞ্চুরি। নিজে চোখ বোলাতে গিয়ে খুশি হবেন দেখে যে, এর মধ্যে দেশের মাঠে দশটি সেঞ্চুরি। বেশিটা (১১) বিদেশের মাঠে। ক্রিকেটের সেই আদি অনন্তকালের শর্ত— তুমি কত বড় ব্যাটসম্যান প্রমাণ হবে বিদেশের স্কোর দিয়ে।

দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফ্যাফ ডুপ্লেসি নানা কৌশল প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন। বডিলাইন ফিরিয়ে এনেছিলেন। শেষের দিকে রান আটকানোর জন্য সকলকে বাউন্ডারি লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তবু রান করে যাচ্ছিলেন কোহালি। এমনকী, ইশান্ত শর্মা-কে নিয়েও খেলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নয় উইকেট পড়ে যাওয়ার পরে রান করার একমাত্র উপায় ছিল বড় শট খেলা। সেটা করতে গিয়েই ধরা পড়লেন বাউন্ডারি লাইনে এ বিডিভিলিয়ার্সের হাতে।

বিরাট-রেকর্ড

• বিরাট কোহালির ২১তম টেস্ট সেঞ্চুরি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দ্বিতীয়। প্রথমটি জোহানেসবার্গে ২০১৩-য়।

• বিরাটের ২১টি টেস্ট সেঞ্চুরির মধ্যে ১০টি ঘরের মাঠে। বাকি ১১টি বিদেশে।

• টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে ১৫০-এর বেশি রানের ইনিংস কোহালি খেলেছেন আটটি। যা আর শুধু ডন ব্র্যাডম্যানেরই আছে।

• টেস্টে ৫০ রানকে ১০০-য় পরিণত করার শতকরা হিসেবে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের (৬৯) পরেই কোহালি (৫৮.৩)। তাঁর পরেই স্টিভ স্মিথ (৫০)।

• ২০১১-র পর থেকে দেশের বাইরে তাঁর টেস্ট সেঞ্চুরির সংখ্যা ১১। স্টিভ স্মিথের (১০) চেয়ে বিদেশে একটি সেঞ্চুরি বেশি তাঁর।

• বিদেশে ভারতীয় অধিনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টেস্ট সেঞ্চুরি কোহালির (২২ ইনিংসে ৭ সেঞ্চুরি)। এই তালিকায় তাঁর পরে রয়েছেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন (৪১-এ ৫), সচিন ২১-এ ৪) ও রাহুল দ্রাবিড় (৩০-এ ৪)।

• দক্ষিণ আফ্রিকায় কোহালি দ্বিতীয় ভারতীয় অধিনায়ক, যিনি টেস্টে সেঞ্চুরি করলেন। অন্যজন সচিন তেন্ডুলকর (১৬৯, কেপ টাউন, ১৯৯৭)।

• টেস্টে ২১ সেঞ্চুরিতে পৌঁছতে কোহালি নিলেন ১০৯ ইনিংস। সচিন তেন্ডুলকরকে (১১০) এই ব্যাপারে পিছনে ফেলে দিলেন তিনি। রইলেন ডন ব্র্যাডম্যান (৫৬), সুনীল গাওস্কর (৯৮), স্টিভ স্মিথের (১০৫) পরে।

• দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্টে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সবচেয়ে বেশি রানের ব্যক্তিগত ইনিংসের তালিকায় এটি তৃতীয়। সচিনের ১৬৯ (কেপ টাউন, ১৯৯৭) ও ১৫৫-র (ব্লুমফন্টেন, ২০১১) পরে ও চেতেশ্বর পূজারার ১৫৩-র (জোহানেসবার্গ, ২০১৩) সঙ্গে।

• ক্যাপ্টেন হিসেবে ২৪ তম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি কোহালির। রিকি পন্টিং (৪১), গ্রেম স্মিথের (৩৩) তিনি।

• অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলা চারটি করে সিরিজের প্রতিটিতেই সেঞ্চুরি করা একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান বিরাট কোহালি।

শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়ে ফিরে আসছেন কোহালি— দিনের সেরা ছবিটা দেখা গেল। দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সবাই এসে অভিনন্দন জানিয়ে হাত মিলিয়ে গেলেন। সেরা মুহূর্তটা লাগল ফিল্যান্ডার যখন দৌড়ে আসছিলেন। কোহালি দাঁড়ালেন। ফিল্যান্ডার এসে হাত মেলালেন। গত টেস্টের নায়ক দক্ষিণ আফ্রিকান মিডিয়াম পেসার। কোহালির উইকেট নিয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন ভারতের আশা। এখানে কোহালি স্কোরলাইন ১-১ করলেন। কিন্তু ক্রিকেটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই সৌজন্যে কোনও ঘাটতি তৈরি করতে পারেনি।

সিরিজ ১-১ হবে কি না, সেটা নির্ভর করছে সেরা দুই তারকার উপরেই। কোহালি ক্লাসিকের জবাব দিতে শুরু করে ডিভিলিয়ার্স ৭৮ বলে ৫০ ব্যাটিং। মঙ্গলবার তাঁকে যদি তাড়াতাড়ি না ফেরানো যায়, ম্যাচ থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে ভারত। খারাপ হতে থাকা সেঞ্চুরিয়ন উইকেটে শেষ ইনিংসে আড়াইশো রানের বেশি তাড়া করতে গেলেও খুব সহজ কাজ হবে না। ম্যাচ জিততে গেলে সেই কোহালিয়ানাই ভরসা।

লারার সেই ম্যাজিক সংখ্যা ১৫৩-তে পৌঁছে তাই কাজ শেষ হয়নি কোহালির। সিরিজ বাঁচিয়ে রাখতে গেলে ব্যাট হাতে আবার সেই মূর্তিমান লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে হবে বাইশ গজে। সেঞ্চুরিয়নে যে ম্যাচটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে কোহালি বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE