জোড়া গোলের নায়ক দিপান্দা ডিকাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস আক্রমের। রবিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
উনিশশো পঁচাত্তরের দুঃসহ স্মৃতির বদলা হবে ধরে নিয়ে কেউ বসে ছিলেন টিভি-র সামনে। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি নিয়ে কেউ আশঙ্কায় কাঁপছিলেন, রেকর্ডটা না ভেঙে যায়!
রবিবাসরীয় ডার্বিতে আইএফএ শিল্ড ফাইনালের সেই পাঁচ গোলের স্মৃতি শেষ পর্যন্ত ফেরেনি। যুবভারতী আরও একটা ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে শেষ পর্যন্ত। সুযোগ পেয়েও বদলা নিতে পারেনি মোহনবাগান।
ম্যাচ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা পরেও সুব্রত ভট্টাচার্যের গলায় তাই হতাশা, ‘‘কিছুতেই আক্ষেপটা যাচ্ছে না। জীবনে যত সাফল্যই পাই, সেই কলঙ্ক তো রয়েই গিয়েছে গায়ে। যে ভাবে খেলা হচ্ছিল ভাবলাম আজ সেটা মুছে যাবে।’’ গল্ফগ্রিনের বাড়ি থেকে দমদম। সেখানে আবার উদ্বেগের সমাপ্তি। সমরেশ চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘আরে ভাই, খেলা চলতাসিল আর ভাবতাসিলাম আমাগো করা রেকর্ডটা ভাইঙ্গা না যায় জীবদ্দশায়! হয় নাই, কী যে স্বস্তি।’’ তবে সব চেয়ে মজার মন্তব্য অবশ্য এল ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। চার দশক আগে মোহনবাগান গোলে দাঁড়িয়ে ডার্বিতে চার গোল হজমের স্মৃতি এখনও টাটকা প্রাক্তন কিপারের কাছে। বলছিলেন, ‘‘ভাবছিলাম, কলঙ্কের একজন সঙ্গী পাবই আজ। ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার লুইস ব্যারেটো আমার রেকর্ডটা ভেঙে দেবে হয়তো। ছয়-সাত গোল হজম তো ওর বাঁধা ছিল।’’
দুই প্রধানের ফেসবুক, ফ্যানস ক্লাবের পেজে বিতর্কের তুফান উঠেছে। ঠিক কত গোল হতে পারত এ দিন তা নিয়ে। অসংখ্য ছড়া, মজাদার চুটকি আর স্লোগানে ভরে উঠেছে সরস্বতী পুজোর আগের রাতের সোশ্যাল নেটওয়ার্কের জগৎ। যুবভারতী এ দিন পুরো ভর্তি হয়নি। কিন্তু সাড়ে ছেষট্টি হাজারের গ্যালারিতে হাজির তো তিপান্ন হাজার সমর্থক। হবেই বা না কেন? সনি নর্দে, ইউসা কাতসুমিহীন সবুজ-মেরুন সমর্থকরা তো হেরে যাওয়ার ভয়ে মাঠমুখোই হননি। মাঠ ভর্তি ছিল মশালবাহিনীর কলরবে।
কিন্তু কলকাতা ডার্বির মঞ্চ যে বড় নিষ্ঠুর! তা কখনও ফেভারিটকে আছড়ে ফেলে মাটিতে, কখনও মুষড়ে পরা টিমকে আকাশে ওড়ায়। এ দিন তো তাই হল।
খালিদ জামিল বনাম শঙ্করলাল চক্রবর্তীর আই লিগের ফিরতি ডার্বির মঞ্চটা ছিল একেবারেই অন্য রকম। খেতাব যুদ্ধে টিকে থাকতে ইস্টবেঙ্গলের জেতাটা ছিল জরুরি। আর মোহনবাগানের অবস্থা ছিল সব হারিয়ে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা উদভ্রান্ত পথচারীর মতো। সেই লড়াইয়ে খালিদ ফকির হয়ে গিয়েছেন। সূর্যাস্তের ম্লান আলোয় স্টেডিয়ামের পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। আর ধ্রুবতারার মতো বাগান আকাশে জন্ম হয়েছে এক বঙ্গসন্তান কোচের। শঙ্করলাল ম্যাচের পর তো বলেই দিয়েছেন, ‘‘কোচিং জীবনের নতুন একটা মঞ্চ
হয়তো পেলাম।’’
কিন্তু কোন তুকতাকের ছোঁয়ায় ঝলমলে ইস্টবেঙ্গল এ রকম রক্তশূন্য হয়ে গেল? বাঘ থেকে হয়ে গেল বিড়াল? চৌম্বকে যে কারণগুলো উঠে আসছে তা হল ১) শুরুর মিনিটেই ইস্টবেঙ্গলের গোল হজম। ২) তিন মিনিটের মধ্যে টিমের মাঝমাঠের হৃৎপিন্ড আল আমনার চোট পেয়ে বাইরে চলে যাওয়া। আমনা চলে গেলে ‘প্ল্যান বি’ কী হবে সেই পাঠ ছাত্রদের দিতে পারেননি খালিদ। তিন) ইস্টবেঙ্গল কোচের দল নির্বাচনে চূড়ান্ত অস্থিরতা। তাঁর টিমের সেরা সম্পদ গতি জেনেও টিমের সব চেয়ে গতিময় ফুটবলার লালডানমাওয়াইয়া রালতেকেই বসিয়ে রেখেছিলেন তিনি। ৪) রক্ষণ সংগঠনে চূড়ান্ত ব্যর্থতা। মোহনবাগানের আক্রম মোগরাভি আর দিপান্দা ডিকার যুগলবন্দি জায়গা বদল করে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেই ধারণাই ছিল না খালিদের। ডিকা জোড়া গোল করেছেন, আক্রমও করতে পারতেন।
আমনা চলে যাওয়ার পরেই মাঝমাঠের দখল নিয়েছিল বাগান। ক্যামেরন ওয়াটসন আর রেনিয়ার ফার্নান্দেজ মাঝমাঠে ছেলেখেলা করেছেন মহম্মদ রফিক, বাজি আর্মান্দদের নিয়ে। তবে বাগানের সুগন্ধি গোলাপ ছিলেন নিখিল কদম। মহারাষ্ট্রের এই ছেলেটি হ্যাটট্রিকের সুযোগ নষ্ট করলেও তাঁর দৌড়, নিখুঁত পাস আর উইং থেকে তোলা ক্রস— মনে করিয়েছে মানস ভট্টাচার্য, বিদেশ বসুদের। বাগান রক্ষণ ছিল দুর্ভেদ্য দূর্গ। ডুডু-র মতো আনফিট আর উইলিস প্লাজার মতো বোহেমিয়ান স্ট্রাইকার সামলাতে তাই ভুগতে হয়নি কিংগসলেদের। কিপার শিল্টন পাল প্রথম কঠিন বল ধরেন ছেষট্টি মিনিটে। এমন এক তরফা ডার্বি শেষ কবে দেখা গিয়েছে মনে করতে পারছেন না কেউই।
খালিদের চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। কোচ বদলে আর লাভই বা কী? ইস্টবেঙ্গল তো খেতাবের বৃত্ত থেকে প্রায় ছিটকেই গিয়েছে।
মোহনবাগান: শিল্টন পাল, অরিজিৎ বাগুই, কিংশুক দেবনাথ (রানা ঘরামি), কিংগসলে ওবুমেনেমে, রিকি লালমাওয়ামা, নিখিল কদম, ক্যামেরন ওয়াটসন, রেইনার ফর্নান্দেজ (শিল্টন ডি সিলভা), শেখ ফৈয়াজ, আক্রম মোগরাভি (আজহারউদ্দিন মল্লিক), দিপান্দা ডিকা।
ইস্টবেঙ্গল: লুই ব্যারেটো, লালরাম চুলোভা, অর্ণব মণ্ডল (কেভিন লোবো), সালাম রঞ্জন সিংহ, মহম্মদ রফিক, ইউসা কাতসুমি, আল আমনা (বাজি আর্মান্দ), প্রকাশ সরকার (সুরাবুদ্দিন), ডুডু ওমাগবেমি, উইলিস প্লাজা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy