যুযুধান: শিলিগুড়িতে ইলিশ হাতে ইস্টবেঙ্গলের দুই অস্ত্র প্লাজা ও আমনা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক ।
কাঞ্চনজঙ্ঘার মোটা ঘাসের উপর দিয়ে বল নিয়ে দৌড়োনোর সময় মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিল। বারবার দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন আনসুমানা ক্রোমা। অনুশীলনের শেষে ভক্তদের সঙ্গে সেলফি তোলার ফাঁকে বললেন, ‘‘এই ঘাসে বল স্লো হয়ে যাবে। কামোকে বলছি বেশি ক্ষণ পায়ে বল রাখা যাবে না।’’
কিছু ক্ষণ আগে এই মাঠে অনুশীলন করে বেরোনোর সময় আল আমনার গলাতেও বিস্ময়। ‘‘মাঠের ঘাসটা যেন কী রকম। কৃত্রিম ঘাস না হলেও কী রকম একটা প্লাস্টিকের মতো। বৃষ্টি হলে কিন্তু সমস্যা হবে।’’
আরও পড়ুন: প্লাজার চাই ইলিশ, নাচবেন ক্রোমা
ক্রোমা বা কামো অথবা আমনা কেউ কখনও খেলেননি শিলিগুড়ির এই স্টে়ডিয়ামে। অথচ আজ, রবিবাসরীয় ডার্বিতে এঁরাই দুই কোচের স্ট্র্যাটেজির প্রধান তাস। দু’ভাগ হয়ে যাওয়া বাঙালির চিরকালীন যুদ্ধ জেতার আশার সলতে।
ডার্বিতে খেতাবের ফয়সলা হয়েছিল চোদ্দো বছর আগে। ২০০৩-এর প্লে-অফে টাইব্রেকারে জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। এ বার আবার সেই ছবি হাজির। তবে অন্য মোড়কে। ম্যাচটা ড্র হলে গোল পার্থক্যে চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হওয়ার সুযোগ থাকবে। সেই ১৯৯৪-’৯৫ এর মতো।
পাহাড়ি রাজনীতির আঁচে উত্তপ্ত শহরে এ বার কী হবে?
ক্যাচলাইন যা বেরোচ্ছে, লড়াইটা আসলে লাল-হলুদের মাঝমাঠ বনাম সবুজ-মেরুনের জোড়া স্ট্রাইকারের। এই যুদ্ধে যে জিতবে দুর্গাপুজোর ঢাক নিয়ে চতুর্থীর রাতে হিলকার্ট রোডে তাদের সমর্থকরাই মেতে উঠবেন উৎসবে।
ইস্টবেঙ্গলের টর্পেডো যদি হন এই ম্যাচে আল আমনা-মহম্মদ রফিকের মাঝমাঠের সাপ্লাই লাইন, তা হলে গঙ্গাপাড়ের ক্লাবের ‘বোমারু বিমান’ কা-ক্রো জুটির গোলের মধ্যে থাকা। অন্তত একান্তে কথা বললে সেটাই জানাচ্ছেন দুই কোচ ও প্রাক্তনরা।
প্রতিবছরই বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে গোটা তিনেক ডার্বি। পাড়ায় পাড়ায় পুজোর থিমের বদলের মতোই তাতে নানা ভাবনার রং লাগে। শিল্পীরা রাত-দিন জেগে করেন নতুন নতুন সৃষ্টি। সেটা ভাল বা মন্দ যা-ই হোক। শিল্পী কে তা নিয়েই হয় আলোচনা।
এ বারের ডার্বিটা যেন থিমের ফটোকপি। হয়তো হোসে ব্যারেটো, সনি নর্দে, ওকোলি ওডাফা বা র্যান্টি মার্টিন্স এমনকী এডে চিডি-র মাপের বিদেশিও নেই দু’দলে। নেই স্বদেশী তারকারাও।
কিন্তু তাতেও এটা ডার্বি-পুজো তো! তাই আবেগ, উত্তেজনা, স্লোগান-যুদ্ধ, ইলিশ-চিংড়ি সবই হাজির। হাজির খালিদ জামিল এবং শঙ্করলাল চক্রবর্তীর স্ট্র্যাটেজিও। যেখানে ক্লোজ ডোর ট্রেনিংয়ের মতো হাস্যকর ব্যাপারও দেখা গেল।
রক্ষণ বনাম রক্ষণ ধরলে লড়াইটা সমান-সমান। আট ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান রক্ষণ হজম করেছে পাঁচটি করে গোল। দুই কোচের কপালে তাই চিন্তার বলিরেখা।
মোহনবাগান কোচ যেমন স্বীকার করে নেন, ‘‘গোল খেলে চলবে না। গোল না খেলে আমাদের গোল আসবেই।’’ বঙ্গসন্তান কোচের ভাবনায় ভাসে তাঁর জোড়া স্ট্রাইকার কামো-ক্রোমার সৌজন্যে শেষ আটে ম্যাচে বারো গোল করার দৃশ্য।
তার কিছু ক্ষণ আগে খালিদ জামিলের গলায় আবার অন্য কথা, ‘‘পজিটিভ রেজাল্ট চাই। সেটা আমনা-রফিকদের বলে দিয়েছি।’’ ডার্বির আগে হ্যাটট্রিক করা প্লাজা নন, অতি সতর্ক খালিদের মুখে মুখে শুধুই মাঝমাঠের সেরা অস্ত্র আমনা-রফিকের কথা।
মোহনবাগানের প্রধান ভরসা (বাঁ দিক থেকে) কিংগসলে, কামো, ক্রোমা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
শনিবার সাত সকালে হোটেল থেকে একাই অটো করে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে চলে এসেছিলেন লাল-হলুদ কোচ। হাতে অনুশীলনের কিছু সরঞ্জাম। তখন দরজা খোলেনি স্টেডিয়ামে। টিমের অর্ধেক ফুটবলার হোটেলে ঘুমোচ্ছেন। অনুশীলন শুরু হওয়ার এক ঘন্টা আগে কেয়ারটেকারকে ডেকে দরজা খুলিয়ে মাঠে কয়েক চক্কর মেরে নিলেন খালিদ। প্রার্থনা করলেন হাঁটু মুড়ে বসে। সবাই বলে এটা তাঁর তুকতাক। আইজলেও নাকি এ রকম করতেন। শুধু খালিদ কেন, শঙ্করলালের শিবিরও পিছিয়ে নেই। ডার্বির ‘গোল্ডেন বয়’ আজহারউদ্দিন মল্লিককে খেলানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা চলছে। আজাহার থাকা মানেই তো শিলিগুড়িতে জয়। রাতের খবর, মাঝমাঠে শিল্টন ডি’সিলভার সঙ্গে আজহার শুরু করছেন আজ।
দুই প্রধানেই খোলামেলা মনোভাব উধাও। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা। খালিদের টিমে তাঁর প্রভাব বেশি। কথা বললেই, দশ হাজার টাকা জরিমানা চালু করে দিয়েছেন তিনি। ভয়ে বা ভক্তিতেই হোক, ফুটবলাররা জড়সড়। টিমের সঙ্গে তিন প্রাক্তন তারকা মনোরঞ্জন-ভাস্কর-তুষারকে পাঠিয়েছেন কর্তারা। কোচকে পরামর্শ দিতে। কিন্তু ড্রেসিংরুমেই তাঁদের প্রবেশ নিষেধ। পুরো টিমকে অনুশীলনের পর ড্রেসিংরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন আই লিগ চ্যাম্পিয়ন কোচ। প্রাক্তনরা গিয়ে বসলেন বাসে। খোলামেলা মুক্ত মনের শঙ্করলালের অনুশীলনেও মরসুমে প্রথমবার মিডিয়ার প্রবেশ নিষেধ পনেরো মিনিটের পর। পরে জানা গেল, গ্যালারিতে এক গেরুয়াধারী স্বঘোষিত জ্যোতিষীকে দেখেই নাকি ক্লোজ ডোরের সিদ্ধান্ত। কলকাতা থেকে সে নাকি ‘অভিশাপ’ দিতে এসেছেন কা-ক্রো-কে। মজা লাগে এসব শুনে। আবার মনে হয় এটাই তো এই ম্যাচের মাহাত্ম্য।
বাঙালির আবেগের ম্যাচে চল্লিশ শতাংশ বঙ্গসন্তান। পাহাড়ি ছেলেদের রমরমা। যাঁদের মুখ দেখলে বোঝা যায় না চাপে আছেন না, নিশ্চিন্তে। ডার্বির উত্তাপ তাঁদের স্পর্শ করে না। খেলেননি তো কোন দিন। অর্ণব মণ্ডল, শিল্টন পাল, কিংশুক দেবনাথ, মহম্মদ রফিক, সামাদ আলি মল্লিক, আজহারউদ্দিনরা জানেন এই ম্যাচের গুরুত্ব। সে জন্যই মোহনবাগান অধিনায়ক কিংশুক দেবনাথের মুখ থেকে বেরোয়, ‘‘আমরাই জিতব। চাপটা ওদের বেশি। কারণ ড্র এবং জয় দুটো রাস্তা আছে ওদের সামনে। আমাদের তো জিততেই হবে।’’ খালিদ তাঁর অধিনায়ক অর্ণব মণ্ডলকে মিডিয়ার সামনেই আসতেই দেননি। ফোনও সুইচড অফ। ফলে জানা যায়নি কোচ তাঁকে কোনও দায়িত্ব দিয়েছেন কি না? কিংশুক প্রকাশ্যেই বললেন, ‘‘সবাইকে বলছি একশো ভাগ দাও। আমরা জিতব।’’
খালিদ এবং শঙ্করলাল দু’জনের কাছেই এটা বেঁচে থাকার যুদ্ধ। জীবনে প্রথমবার সম্মুখসমরে তাঁরা আমনা-ক্রোমাদের মতোই। ফলে সবাই সতর্ক। অতি সতর্কও বলা যায়। খেলার মধ্যেও তার প্রভাব পড়বে বলেই মনে হয়।
রবিবারে কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে ডার্বি
ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান (শিলিগুড়ি, বিকেল ৫-০০)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy