Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
ভরা সবুজে বিরাট-দর্শন হল না, শিরোনামে ইডেনের বাইশ গজ

‘গতির তুফান উঠেছে, কিন্তু বিনোদন কই’

বৃষ্টিতে টেস্ট শুরু করা যাবে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। যা-ও বা শুরু হল, দেখলাম ঘাসের পিচে শুধু বল ছুটছে, লাফাচ্ছে, বাঁক খাচ্ছে।

আউট: শ্রীলঙ্কার সুরঙ্গা লাকমলের বলে এলবিডব্লিউ বিরাট কোহালি। কোনও রান করার আগেই। বৃহস্পতিবার ইডেনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

আউট: শ্রীলঙ্কার সুরঙ্গা লাকমলের বলে এলবিডব্লিউ বিরাট কোহালি। কোনও রান করার আগেই। বৃহস্পতিবার ইডেনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

অশোক মলহোত্র
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৭ ০৪:০৬
Share: Save:

আমি জানি না, ইডেনে সবুজ পিচ করার সিদ্ধান্তটা কার। তবে যারই হোক, ক্রিকেট-দর্শকরা কেউ উৎফুল্ল হবে বলে মনে হয় না।

প্রথম দিনের খেলা আমি বাড়িতে টিভি-র সামনে বসেই দেখছিলাম। মাঝেমধ্যে গুলিয়ে যাচ্ছিল, ম্যাচটা কি ইডেনে হচ্ছে? নাকি বিরাট কোহালি-দের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শুরু হয়ে গিয়েছে?

বৃষ্টিতে টেস্ট শুরু করা যাবে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। যা-ও বা শুরু হল, দেখলাম ঘাসের পিচে শুধু বল ছুটছে, লাফাচ্ছে, বাঁক খাচ্ছে। একে তো অবাক করে দেওয়া সবুজ পিচ। তার উপর স্যাঁতসেতে আবহাওয়া। বৃষ্টি এসে মাঝেমধ্যেই খেলা থামিয়ে দিচ্ছে। ব্যাটসম্যানের থিতু হওয়ার উপায়ই নেই, ক্রিজে দাঁড়িয়ে রান করা অনেক দূরের কথা।

আরও পড়ুন: ঘূর্ণির দুর্গে গতির তেজ

ভারতে নিজে ক্রিকেট খেলেছি দু’দশকের উপর। তার পর কোচ হিসেবে দেখেছি আরও অন্তত একটা দশক। কখনও এতটা সবুজ পিচে খেলা হতে দেখিনি। ফাস্ট পিচ কিন্তু দেখেছি। আমদাবাদে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সাড়ে তিন দিনে ডেল স্টেইনদের সামনে হেরে গিয়েছিল ভারত। অনিল কুম্বলে ছিল অধিনায়ক। অনিল সঙ্গত কারণেই মেনে নিতে পারেনি দেশের মাঠে বিদেশি ঘরানার পিচ।

নাগপুরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সবুজ পিচ উপহার দিয়েছিলেন এখনকার আইসিসি প্রধান শশাঙ্ক মনোহর। যা নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তখন ভারত অধিনায়ক। বলা হয়েছিল, তখনকার বোর্ড প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়ার বিরুদ্ধাচারণ করতেই সবুজ পিচ বানিয়েছিলেন বিরোধী আসনে থাকা মনোহর। ক্রিকেট হয়নি নাগপুরে। হয়েছিল ক্রিকেট রাজনীতি। আর তার মাশুল দিতে হয়েছিল ভারতীয় দলকে। টেস্ট শুরুর আগে সৌরভ জানিয়েছিল, চোট লেগেছে। রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে ভারত হেরে যায় অস্ট্রেলিয়ার কাছে।

কখনও অতিরিক্ত সাহসী হয়ে, কখনও অহেতুক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে বা ক্রিকেট রাজনীতির খপ্পরে পড়ে। যে কারণেই হোক, যত বার প্রাণবন্ত পিচ তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে, তা ব্যুমেরাং হয়েছে। প্রত্যেক বারই বিদেশি দলের কাছে হেরেছে ভারত। সেই কারণেই আমার প্রশ্ন, এমন পিচ আমাদের দেশে করার অর্থই বা কী?

আমি কখনও কোনও ভারত অধিনায়ককে দেখিনি যে পিচে ঘাস রাখতে বলছে। কপিল দেব আমার বিশেষ বন্ধু। দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। কিন্তু নিজে জোরে বোলার হয়েও টিমের কথা ভেবে কখনও ঘাসের পিচ চাইত না। সুনীল গাওস্কর নিজে সব ধরনের উইকেটে ব্যাটিং মাস্টার ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজে সবুজ পিচে গিয়ে হোল্ডিং, রবার্টস, মার্শালদের খেলে রান করেছে। তবু ক্যাপ্টেন হিসেবে চাইত না ভারত দেশের মাঠে সবুজ পিচে খেলুক। সৌরভ যখন অধিনায়ক, তখন অনেকটা সময় আমি নির্বাচক ছিলাম। কখনও কোনও দলের বিরুদ্ধে ও ঘাস চেয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। সৌরভের আগে আজহারউদ্দিনের সময় পুরোপুরি স্পিনারদের উইকেট হয়েছে।

হঠাৎ করে ইডেন কেন তার নিজস্ব চরিত্র ত্যাগ করে সাবাইনা পার্ক হয়ে উঠতে চাইছে, সেটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। আর এটা তো শুধু এই টেস্ট বলেই নয়, কয়েকটা ম্যাচ ধরেই দেখছি ঘাস রাখার প্রবণতা। আমার মনে হয়, সবুজ-প্রেম ছেড়ে ভাল উইকেট তৈরির দিকে মন দেওয়া উচিত সিএবি কর্তাদের। ইডেনের পিচে কিন্তু বেশ কয়েকটা ম্যাচেই অসমান বাউন্স দেখা গিয়েছে। এই টেস্টের প্রথম দিনে খুব সামান্যই খেলা হয়েছে। তাতেও কিন্তু কয়েকটি বল এলোমেলো লাফিয়েছে।

ভারতে ক্রিকেটটা তো সবুজ পিচের জন্য বিখ্যাত নয়। এখানকার লড়াইটাই তো স্পিনিং উইকেটের সঙ্গে। দক্ষিণ আফ্রিকা বা অস্ট্রেলিয়া যদি বাউন্স বা গতির পরীক্ষা নেয়, ভারতে মাপা হবে ব্যাটসম্যানের স্পিন খেলার দক্ষতা। এতে অসুবিধেটা কোথায়? স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়া দল ভারতকে ‘লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’ আখ্যা দিয়েছিল স্পিনের দেশকে জয় করার শপথ নেবে বলে, গতিসম্পন্ন পিচের জন্য নয়।

ইডেনে সবচেয়ে বিখ্যাত যে টেস্ট ম্যাচ সেই ২০০১-এর ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া, তাতে কী রকম পিচ ছিল? সেই ঐতিহাসিক টেস্টে মোটেও ঘাসের পিচ করতে হয়নি ম্যাচকে আকর্ষণীয় করে তুলতে। সেই টেস্টে সারা দিন ধরে ভি ভি এস লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড় ব্যাট করার পরেও টেস্টের ফয়সালা হয়েছিল। যেমন ভাল ব্যাটিং দেখা গিয়েছিল, তেমনই পেস বোলাররাও ভাল করেছিল, আবার হরভজন সিংহও ভেল্কি দেখিয়েছিল। এটাই তো টেস্ট ক্রিকেটের আকর্ষণ। কিন্তু এ যা পিচ, এখানে তো ভাল ব্যাটসম্যানদেরও থিতু হওয়া কঠিন! টেস্টের মজা নেওয়ার আগেই না শেষ হয়ে যায়!

এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের রমরমা। লোকে পাওয়ারহিটিং আর চার-ছক্কা দেখতে ছুটছে। টেস্ট ক্রিকেট মাছি তাড়াচ্ছে। এরকম পিচ হলে আরওই লোক হবে না। ইডেনে যদি কুড়ি হাজার দর্শক এই টেস্ট দেখতে আসেন, তাঁরা বিরাট কোহালির ব্যাটিং দেখতে আসবেন নাকি সুরঙ্গা লাকমলের বোলিং? দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যখন ভারত খেলতে যাবে, দেখা যাবে। তার জন্য এখন কেন সবুজ পিচ বানাতে হবে?

মাঠে লোক আসে বল আর ব্যাটের সম লড়াইয়ের টানে। ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর বল ছুটছে দেখার জন্য নয়। ইডেনের এই সবুজ পিচে গতির তুফান উঠতে পারে কিন্তু ক্রিকেট বিনোদন কোথায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE