Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পঞ্চাশ রানে জিতে সিরিজে ২-০ এগিয়ে ভারত, এ বার চলো ইনদওর

হলুদ সভ্যতার পতন, উড়ছে নীল পাখিরা

বিস্ময়কর শোনালেও সত্যি। প্রথম দলটা অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয়টা ভারত। প্রথম দলটা এই নিয়ে টানা দশটা ওয়ান ডে ম্যাচে হারল। কে বলবে, শেষ কুড়ি বছর ধরে একদিনের ক্রিকেটে কার্যত একচ্ছত্র শাসন ছিল তাদের।

উৎসব: ইডেনে আগ্রাসী উচ্ছ্বাসের ভঙ্গি ভারতের। আরও একটি উইকেট পতন। কোহালি এবং হার্দিক পাণ্ড্যর উড়ন্ত ‘হাই ফাইভ’। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

উৎসব: ইডেনে আগ্রাসী উচ্ছ্বাসের ভঙ্গি ভারতের। আরও একটি উইকেট পতন। কোহালি এবং হার্দিক পাণ্ড্যর উড়ন্ত ‘হাই ফাইভ’। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:৩২
Share: Save:

একটা দল ইডেনে ঢোকার মুখে তাদের ঘিরে প্রশ্ন— এরা শেষ কবে ওয়ান ডে জিতেছে? অন্য দলটা ইডেনে ঢোকার মুখে তাদের ঘিরে প্রশ্ন— এরা শেষ কবে ওয়ান ডে হেরেছে?

বিস্ময়কর শোনালেও সত্যি। প্রথম দলটা অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয়টা ভারত। প্রথম দলটা এই নিয়ে টানা দশটা ওয়ান ডে ম্যাচে হারল। কে বলবে, শেষ কুড়ি বছর ধরে একদিনের ক্রিকেটে কার্যত একচ্ছত্র শাসন ছিল তাদের। জার্সির রংয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বলা হতো হলুদ সভ্যতা। ২০১৫-তে শেষ বিশ্বকাপও জিতেছে মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া।

কিন্তু আর দু’বছর পরে যে ২০১৯ বিশ্বকাপের আসর বসবে ইংল্যান্ডে, তাতে মনে হয় না একদিন বিশ্ব শাসন করা হলুদ পাখিরা ফেভারিট হিসেবে উড়বে। বরং বৃহস্পতিবারের ইডেনে বসে মনে হচ্ছে, ওয়ান ডে ক্রিকেটের হরপ্পা— ওয়েস্ট ইন্ডিজের আগেই অবলুপ্তি ঘটেছে। এ বার মহেঞ্জোদারো— অস্ট্রেলিয়াও দ্রুতগতিতে পতনের দিকে এগোচ্ছে।

এ দিন যখন একের পর এক উইকেট পড়ছে আর কুলদীপ যাদবের হ্যাটট্রিকের পর শূন্যে উড়ছেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা, তখন টিভি ক্যামেরা ধরল স্টিভ স্মিথ-কে। শূন্য দৃষ্টি। আরও একটা উইকেট পড়ল। স্মিথকে দেখে মনে হল কেঁদেই ফেললেন। একটি সভ্যতার পতন ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে একে?

ইডেনে খেলতে আসা দ্বিতীয় দলটা এই নিয়ে টানা আটটি একদিনের ম্যাচে জিতল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দু’টো ম্যাচ তারা হেরেছে। শ্রীলঙ্কার কাছে গ্রুপ লিগে এবং ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে হেরেছে একটিতে। শ্রীলঙ্কায় পাঁচে পাঁচটিই জিতেছে। এখানে এখনও পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দু’টি ম্যাচের দু’টিতেই অপরাজেয়। শ্রীলঙ্কা সফর থেকে এই নিয়ে টানা টানা এগারো ম্যাচ অপরাজিত কোহালিরা। টেস্ট, ওয়ান ডে আর টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে।

ইডেনে জয়ের আবহে ভারতীয় ড্রেসিংরুমের সামনে অভাবনীয় এক ছবি দেখা গেল। রবি শাস্ত্রী আর বীরেন্দ্র সহবাগ হাত মেলাচ্ছেন। শাস্ত্রী হাসতে হাসতে সহবাগকে কী একটা বললেনও। কে বলবে, এঁরা দু’জনে কোচের পদের জন্য যুযুধান দুই প্রার্থী ছিলেন। কে বলবে, সহবাগ এই সিরিজ শুরুর আগের দিনও বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন এই বলে যে, ‘সেটিং’ ছিল না বলেই তিনি কোচের পদ পাননি। কী বললেন বীরু? ওয়েল ডান কোচ। নাকি বিতর্কিত মন্তব্যের পর ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে গেলেন?

তত ক্ষণে অবশ্য দেখে নেওয়া গিয়েছে, হলুদ সভ্যতার যেমন পতন ঘটছে, তেমনই নতুন এক ক্রিকেট সভ্যতার উত্থান ঘটছে। যার নামকরণ করা যেতে পারে নীল সভ্যতা। হলুদ পোশাকে ক্রিকেট শাসন করেছে অস্ট্রেলিয়া। এ বার নীল জার্সিধারীদের ক্রিকেট দুনিয়ায় রাজ করার সময়। বৃহস্পতিবার রাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশবাল্ব জ্বালিয়ে ক্রিকেটের এই নীল সভ্যতার আগমনী সুর বাজিয়ে দিল ইডেন। সভ্যতার রূপান্তর ঘটে আজ যার হাতে আর মশাল নেই, আছে মোবাইলের ফ্লাশবাল্ব।

ফের অল্প রানের পুঁজি নিয়েও বিরাট কোহালির দল রোলার চালিয়ে দিল অস্ট্রেলিয়ার উপর। যত ক্ষণ স্টিভ স্মিথ ক্রিজে ছিলেন বা শেষের দিকে মার্কাস স্টোইনিসের একাকী লড়াই বাদ দিলে কখনও মনে হয়নি, অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ বের করতে পারবে। ভারত জিতল ৫০ রানে কিন্তু ব্যবধানটা চোখে লাগল অনেক বেশি।

আরও পড়ুন:কপিল, হরভজনের স্মৃতি ফেরালেন কুলদীপ

চেন্নাইয়ের পর কলকাতা। ‘রিস্ট স্পিন’ রহস্যের কোনও কূলকিনারা করতে পারলেন না অতিথিরা। লেগস্পিনার যুজবেন্দ্র চহাল নিলেন ১০ ওভারে ৩৪ রান দিয়ে দুই উইকেট। কুলদীপ উইকেট পাচ্ছিলেন না। হ্যাটট্রিক করে পুষিয়ে দিলেন। শেষ করলেন ১০ ওভারে ৫৪ রানে তিন উইকেট নিয়ে। এ দিনও রিস্ট স্পিনারদের শিকার সংখ্যা পাঁচ। যদিও ভোলা যাবে না ভুবনেশ্বর কুমারের অবদান। ২৫২ রানের স্কোর নিয়ে জিততে গেলে ডেভিড ওয়ার্নারকে আগে তুলতে হতো। সেই কাজটা সেরে ভুবনই আসল ‘ঈশ্বর’। ৬.১ ওভারে ৯ রানে নিলেন ৩ উইকেট।

দু’দলের দুই অধিনায়কের পৃথিবীটাও কত ওলটপালট হয়ে গিয়েছে কয়েক মাসের মধ্যে। বিশ্ব ক্রিকেটের দুই সেরা ব্যাটসম্যান তাঁরা। বিরাট কোহালি এবং স্টিভ স্মিথ। দু’জনেই ইডেনে রান করলেন। কিন্তু একজন বেরোলেন হাসতে হাসতে। অন্য জন গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে। স্মিথের অপসারণের দাবি তুলে দিয়েছেন তাঁর দেশের প্রাক্তনরা। ইডেনের হারের পর না সেটা না আরও জোরাল হয়ে যায়। বোলারদের রাজ করার দিনে সর্বোচ্চ রান করে কোহালি জিতে নিলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার। দুর্দান্ত সব কভার ড্রাইভ মারলেন, দেখিয়ে দিলেন ওয়ান ডে ক্রিকেটে যতই রক অ্যান্ড রোল চলুক, ধ্রুপদী সঙ্গীতেরও জায়গা রয়েছে। শুরুতেই বাহুতে লাগল পেসারের বল। এক বার হাত পর্যন্ত লাগালেন না। পাছে বোলার সাহস পেয়ে যায় যে, সেরা শিকারকে কাবু করে ফেলেছি!

কোহালি করলেন ১০৭ বলে ৯২। স্মিথ ৭৬ বলে ৫৯। এর মধ্যেই আবার ব্যাট করার সময় উইকেটকিপার ম্যাথু ওয়েড এবং স্টোইনিসের সঙ্গে লাগল কোহালির। ক্র্যাম্পে ভুগতে থাকা ওয়েড অস্ট্রেলিয়ার দিককার স্লেজিং মাস্টার। কোহালি বিলক্ষণ জানেন। তাই তাঁকেও ছাড়লেন না।

রাতের ইডেনে বসে একটা দৃশ্য খুব মনে পড়ছে। টসে জিতে কোহালি বললেন, ব্যাট করবেন। অথচ, একটু আগেই কমেন্ট্রিতে ভি ভি এস লক্ষ্মণকে বলতে শোনা গিয়েছে, ইডেনের পিচে পেসারদের জন্য সাহায্য থাকবে। মুভমেন্ট থাকবে। সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজারে তাঁর কলামেও তা-ই লিখেছিলেন। সব অস্ট্রেলীয়রা বোলিং শুরু করার পর দেখা গেল, লক্ষ্মণ-সৌরভরা একদম ঠিকই বলেছিলেন। বল রীতিমতো ‘ফ্লাই’ করছে পিচে। সেখানেও টসে জিতে ব্যাটিং করব? মাচো ক্যাপ্টেন তো একেই বলে! অশ্বিন-জাডেজাকে বসিয়ে কুলদীপ আর চহালকে খেলানোর সাহসও দেখিয়েছেন।

৮ নভেম্বর, ১৯৮৭। এই ইডেনেই বিশ্বকাপ জিতে নতুন অস্ট্রেলিয়ার শুভযাত্রা শুরু হয়েছিল অ্যালান বর্ডারের হাত ধরে। ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭। সেই ইডেনেই হয়তো লেখা থাকল অস্ট্রেলীয় সাম্রাজ্যের পতন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE