Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাবা ভ্যানচালক, ছেলের গোলে ইতালির যুব দলকে হারাল ভারত!

এ যেন গলি থেকে রাজপথে উত্তরণের কাহিনি! পেশায় ভ্যানচালক ব্যান্ডেলের হরেন সরকারের দিন প্রতি রোজগার দেড়শো টাকা। যে অর্থে সংসার প্রায় চলে না। পরিবারে বাড়তি অর্থের জন্য তাই স্ত্রী অলকা সরকারকে বিড়ি বাঁধতে হয় রোজ পঁচিশ টাকা মজুরিতে!

আবির্ভাব: ইতালিতে উদয় নতুন প্রতিভা অভিজিৎ সরকারের।

আবির্ভাব: ইতালিতে উদয় নতুন প্রতিভা অভিজিৎ সরকারের।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৭ ০৩:১৮
Share: Save:

এ যেন গলি থেকে রাজপথে উত্তরণের কাহিনি!

পেশায় ভ্যানচালক ব্যান্ডেলের হরেন সরকারের দিন প্রতি রোজগার দেড়শো টাকা। যে অর্থে সংসার প্রায় চলে না। পরিবারে বাড়তি অর্থের জন্য তাই স্ত্রী অলকা সরকারকে বিড়ি বাঁধতে হয় রোজ পঁচিশ টাকা মজুরিতে!

শুক্রবার ইতালিতে এই হরেন-অলকার সন্তান অভিজিৎ সরকার-ই গড়েছেন ইতিহাস। ভারতের অনূর্ধ্ব-১৭ যুব বিশ্বকাপের দল প্রস্তুতি ম্যাচে ইতালির যুব দলকে হারিয়ে গোটা দেশে চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছে। সেই ঐতিহাসিক ২-০ জয়ের ম্যাচে একটা গোল এই বঙ্গসন্তানের। অভিষেক বচ্চন থেকে ক্রীড়ামন্ত্রী বিজয় গয়াল যাঁর সাফল্যে টুইট করেছেন সেই আলোকিত নায়কের বাড়িতেই যেন অন্ধকার। সেই অভাব-অনটনের আঁধার থেকেই বেরিয়ে আসে খুশির রোশনাই। যখন অলকা মুখে পরম তৃপ্তির হাসি নিয়ে বলে ওঠেন, ‘‘গোটা কলোনি আজ সকালে আমাদের বাড়িতে এসে ভিড় করেছিল। ইতালি যাওয়ার আগে ফোনে ছেলেটা বলেছিল কিছু একটা করবেই। সেটা করে দেখিয়েছে।’’

সুদূর ইতালির অ্যারিজো থেকে ব্যান্ডেলের হেমন্ত বসু কলোনির বাড়িতে হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলটা এসেছিল শুক্রবার ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ন’টায়। দাদার ছেলে তিলক শীলের স্মার্টফোন কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে গৃহকর্ত্রী অলকা সরকার প্রথম দেখতে পান তাঁর একমাত্র ছেলে অভি (অভিজিৎ সরকার) আনন্দে লাফাচ্ছে। কারণ জানতে চাইলে ছেলেই তাঁর মাকে বলে, ‘‘আজ তোমাকে একটা দারুণ উপহার দেব। আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত।’’ এর পরেই অভিজিৎ বলে, ‘‘ইতালির যুব দলের বিরুদ্ধে আমরা ২-০ জিতেছি। একটা গোল আমার। কোচ নর্টন স্যার খেলা শেষ হওয়ার পর বললেন, এই প্রথম ইতালির কোনও দলকে হারাল আমাদের দেশের কোনও দল। বাড়ি ফিরলে রুই মাছের কালিয়া রেঁধে খাওয়াতে হবে এর জন্য...।’’

শনিবার সকাল থেকেই কলোনির সেই কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফুট ঘরে আসছে একের পর এক ফোন। ছেলে বিদেশে সাফল্য পেলেও সরকার দম্পতির জীবনযাত্রায় যদিও বদল ঘটেনি। পরিবারে খুশির হাওয়া বইছে— এই পর্যন্তই। এ দিনও বাড়ি থেকে ভোর চারটেয় ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে বাজারে ঘুরেছেন হরেন। স্ত্রী অলকাও দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বসে গিয়েছেন বিড়ি বাঁধতে। কলোনির বাসিন্দারা এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের জীবনযাত্রা পাল্টায়নি। তবে রঙিন হয়ে উঠেছে স্বপ্ন। ‘‘বিশ্বকাপে ভারতের প্রথম দলে থাকতেই হবে অভি-কে। তা হলেই জীবনের সব অভাব, কষ্ট দূর হবে,’’ বলছেন অভিজিতের মা অলকা দেবী।

শনিবার বিকেলে কেওটা মিলিটারি কলোনির এই পাড়ায় পা দিয়ে দেখা গেল গোটা মহল্লা অভিজিৎ-দের ইতালি বধের সাফল্যে আলোড়িত। পাড়ার রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের মোড়ে আড্ডা বা খেলার মাঠ সর্বত্রই আলোচনা এই তরুণ ফুটবলারকে নিয়ে। ছেলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ভক্ত। বাড়িতে একটাই ঘর। সেখানে ঢুকে দেখা গেল ছোট্ট জায়গাটার মধ্যেই রোনাল্ডোর বড় পোস্টার টাঙানো। রয়েছে সচিন তেন্ডুলকরের পোস্টারও। আর বিছানার পাশে বালিশ রাখার জায়গায় একটা লাল-সাদা বল। বাড়ি এলে যে বলটা নিয়ে শুতে যান অভিজিৎ। হরেনবাবু বলছিলেন, ‘‘সত্তরের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো কলকাতায় চার বছর আগে বিশ্বকাপ নিয়ে এসেছিলেন। তখন ছেলে ঢুকেছে অনূর্ধ্ব সতেরো দলে। কার্লোস ছেলেকে এই বলটি উপহার দেন।’’ যোগ করলেন, ‘‘এই বলটা নিয়ে রোজ শুতে যায় অভি। এই বলটা ওর বালিশের সঙ্গেই থাকে।’’

পাড়ার ফুটবল মাঠে অশোক মণ্ডলের কোচিং ক্যাম্পে পাঁচ বছর বয়সে ফুটবলে হাতেখড়ি। যিনি আবার অভিজিতের জীবনে কোনির ‘খিদ্দা’-র মতোই। প্রথম দিকে অভিজিতের জার্সি-বুট এবং অন্যান্য সরঞ্জামের খরচ তিনিই সামলেছেন। ইতালিতে ছাত্রের নজির গড়ার খবর পেয়ে শনিবার বিকেলে এসেছিলেন হরেনবাবুর কাছে। অভিজিতের শুরুর দিনগুলো সম্পর্কে বলতে গিয়ে বুজে আসে শিক্ষকের গলা। বলেন, ‘‘ছেলেটার সাহস আর শৃঙ্খলা দেখার মতো। প্রথমে স্টপারে খেলাতাম। তার পর একটু বড় হতে দেখলাম বল ধরে খেলতে পারে। দু’পায়েই ডজ আছে। গতি ভাল। তাই এক দিন ওকে আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার করে দিয়েছিলাম। এখনও সেই পজিশনেই খেলে। পা’টা ওর মাটিতেই থাকে। বাড়ি এলে এক বার দেখা করবেই।’’

পাড়ার কোচিং ক্যাম্প থেকে সল্টলেকের ফ্রেন্ডস অব দ্য স্টেডিয়ামের হয়ে নার্সারি লিগ। তার পর জুনিয়র বাংলা দলের হয়ে খেলতে গিয়েই জাতীয় স্পটারদের নজরে পড়ে গিয়েছিল হানি সিংহের ভক্ত। সেখান থেকেই সোজা ভারতীয় দলের ক্যাম্পে। গত চার বছর ধরে গোয়াতে অনূর্ধ্ব-১৭ ভারতীয় দলের শিবিরে রয়েছে অভিজিৎ।

গোয়ার সেই শিবিরে অভিজিৎ-কে কয়েক দিন কোচিং করিয়েছেন আইএফএ-র টেকনিক্যাল অফিসার গৌতম ঘোষ। তিনিও বলছেন, ‘‘ছেলেটার সাহস আছে। খুব হাসিখুশি। পরিশ্রমে ফাঁকি দেয় না। আগের কোচ নিকোলাই অ্যাডামের জমানায় দ্বিতীয় টিমে থাকত। নতুন কোচ লুইস নর্টন দে মাতোস এসেই ওকে প্রথম দলে রাখছে। আশা করি বিশ্বকাপের দলেও শুরু থেকে খেলবে।’’

বাংলার মাটি থেকে আবার ফুটবলের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে ব্যান্ডেলের বিস্ময় বালক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

FIFA U-17 World Cup India vs Italy Football
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE