দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: মায়ানমারে রুপো জিতে দ্বিবীজ। নিজস্ব চিত্র
চার বছর বয়সে লিফটে হাত আটকে গিয়ে কনুইয়ের নীচ থেকে বাদ পড়েছিল। কিন্তু সেই দুর্ঘটনা টলাতে পারেনি তাঁকে। দু’দশক পরে তিনিই অসংখ্য মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, প্রেরণা জোগাচ্ছেন, শারীরিক প্রতিকূলতাকে জয় করতে বাড়িয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের হাত। তিনি ভারতের প্যারা সাইক্লিস্ট —দ্বিবীজ শাহ।
সদ্যসমাপ্ত মায়ানমারে এশিয়ান প্যারা সাইক্লিং চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দ্বিতীয় বার রুপো জিতেছেন দ্বিবীজ। জন্মসূত্রে কলকাতার ছেলে তিনি। কর্মসূত্রে এখন থাকেন বেঙ্গালুরুতে। তাঁর পরিবার অবশ্য থাকে ভবানীপুরেই। চার বছর বয়সের সেই দুঃসহ ঘটনার পরে দ্বিবীজ ঠিক করে নিয়েছিলেন আর যাই হোক জীবনযুদ্ধে হার মানবেন না।
ছোটবেলা থেকেই তাই খেলাধুলোর উপর তাঁর অদম্য টান শারীরিক প্রতিকূলতার বাধায় কখনও থেমে থাকেনি। শুরু হয়েছিল ক্রিকেট দিয়ে। চার বছর বয়স থেকে এক হাতেই বোলিং, ব্যাটিংয়ে পাল্লা দিয়েছেন শারীরিক ভাবে সক্ষম খেলোয়াড়দের সঙ্গে। প্রথমে স্কুলের দলের হয়ে, পরে অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট দলে বাংলার প্রতিনিধিত্বও করেছেন তিনি। তবে পড়াশোনার জন্য এর পরে ক্রিকেট কেরিয়ার খুব বেশি আর এগোয়নি। ‘‘কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে পুণেতে চলে যাই উচ্চশিক্ষার জন্য। সেখানেও ক্রিকেট খেলেছি। তবে বেঙ্গালুরুতে চাকরি পাওয়ার পরে ক্রিকেটে আর সময় দিতে পারতাম না। প্র্যাক্টিস করতে পারতাম না,’’ বেঙ্গালুরু থেকে শুক্রবার ফোনে বলছিলেন দ্বিবীজ।
এর পরেই শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়। সাইক্লিং। শুরুটা হয়েছিল বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে। কয়েক মাস এক হাত নিয়েই বেঙ্গালুরুর ব্যস্ত রাস্তায় সাইকেল চালানোয় দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। দ্বিবীজ বলছিলেন, ‘‘বেঙ্গালুরুতে বাড়ি থেকে অফিস যেতে প্রচুর সময় লাগত। রাস্তায় জ্যাম লেগেই থাকে। তাই ভাবলাম সাইকেল চালিয়ে অফিস গেলে কেমন হয়! সময়ও কম লাগবে। শরীরও ভাল থাকবে।’’ সেটা যদিও সহজ ছিল না। ‘‘প্রথম প্রথম অসুবিধে হতো। ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারতাম না এক হাতে। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই ব্যাপারটা রপ্ত করে ফেলি। এর পরেই মাথায় এল প্রতিযোগিতায় নামার কথা। খেলাধুলো নিয়ে আমার চিরকালই খুব ঝোঁক। তাই খোঁজ করতে শুরু করি সাইক্লিং প্রতিযোগিতার। ভারতীয় প্যারা সাইক্লিং দলের ট্রায়ালে নাম পাঠাই। সুযোগও পেয়ে যাই ভারতীয় দলে।’’
গত বছর বাহরিনে এশিয়ান প্যারা সাইক্লিং দলে সুযোগ পেয়ে রুপো জয় দ্বিবীজের চোখে নতুন এক স্বপ্নও তৈরি করে দিয়েছে— দেশকে অলিম্পিক্স পদক এনে দেওয়ার। ২০২০ প্যারা অলিম্পিক্সের জন্য তাই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন তিনি। যে পথে তাঁর আত্মবিশ্বাস আরও মজবুত করে দিয়েছে সদ্য জেতা এশিয়ান প্যারা সাইক্লিংয়ের দ্বিতীয় পদক।
দ্বিবীজের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে সাহায্য করছেন আদিত্য মেহতা। ভারতে প্যারা সাইক্লিং দলের কোচ আদিত্যবাবুর সড়ক দু’ঘটনায় পা বাদ পড়েছিল। সেই ঘটনায় না দমে তিনি জীবনের নতুন এক লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিলেন। প্রতিকূলতাকে কখনও বাধা না হতে দেওয়ার। দেশের প্রথম এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন সাইক্লিস্ট তিনি। আদিত্য মেহতা ফাউন্ডেশন গড়ে তিনি ভারতকে ২০২০ প্যারা অলিম্পিক্সে পদক জেতার লক্ষ্যে এগোতে সাহায্য করছেন। তাঁর লক্ষ্য দ্বিবীজের মতো ১০০ জন চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলিট তৈরি করা, যাঁরা ২০২০ প্যারা অলিম্পিক্সে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন।
শুধু অফিস, পরিবার, সাইক্লিং-ই নয়, দ্বিবীজ শারীরিক প্রতিকূলতাকে জয় করার মন্ত্রও শেখান ‘মোটিভেশনাল টক’-এর মাধ্যমে। তাঁর প্রেরণার উৎস কী?
প্রশ্ন শুনেই ২৬ বছর বয়সি সাইক্লিস্টের গলাটা হঠাৎ উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে থাকে। ‘‘জানেন মাঝেমধ্যে হতাশা যে আসে না, তা নয়। অনেক সময় যেটা চাইছি পারি না, ব্যর্থ হই। তখন একটা দৃশ্য কল্পনা করলেই এক মুহূর্তে সব হতাশা উড়ে যায়।’’
কী দৃশ্য?
‘‘জাতীয় সংগীত বাজছে। সোনার পদক গলায় অলিম্পিক্সের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে আছি আমি।’’
এর থেকে বড় প্রেরণা আর কী হতে পারে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy