Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ফিটনেসই মূল, বিরাটদের সংসারে রোনাল্ডো-মন্ত্র

গুরু গ্রেগের গুণগান করার জন্য ঘটনাটার উল্লেখ করলাম, এমন নয়। বোঝাতে চাইছি, আধুনিক ফিটনেস পরীক্ষা ভারতীয় ক্রিকেটে চালু হয়ে গিয়েছে অনেক দিন ধরেই।

প্রস্তুতি: তাঁর ফিটনেসের প্রশংসা বিশ্ব জুড়ে। কী করে ফিটনেসের চূড়োয় থাকেন িবরাট কোহালি? ভারতীয় ক্যাপ্টেনের শারীরচর্চার ছবি টুইট করল বিসিসিআই।

প্রস্তুতি: তাঁর ফিটনেসের প্রশংসা বিশ্ব জুড়ে। কী করে ফিটনেসের চূড়োয় থাকেন িবরাট কোহালি? ভারতীয় ক্যাপ্টেনের শারীরচর্চার ছবি টুইট করল বিসিসিআই।

চিন্ময় রায়
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৭ ০৪:২৩
Share: Save:

২০০৫ সালের একটি ঘটনা। ভারতীয় দলের শিবির হচ্ছে। আমি তখন জাতীয় অ্যাকাডেমিতে ট্রেনারদের ক্লাস করছি। ভারতীয় দলের বিদেশি কোচকে দেখলাম ট্রেনারের দিকে এগিয়ে এসে বিস্মিত ভাবে প্রশ্ন করছেন, এটা কী হচ্ছে? চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছ কেন এ সব?

বিদেশি সেই কোচের নাম গ্রেগ চ্যাপেল। সেই সময় গুরু গ্রেগ ফিটনেস বাড়ানোর জন্য চালু করেছিলেন ‘বিপ টেস্ট’। এমন নামকরণের কারণ ‘বিপ’ করে একটা শব্দ হতো আর সেটাই ছিল ট্রেনিংয়ের সূচক। শব্দটা হলেই দৌড় শুরু করতে হতো, টার্ন নিতে হতো, তার পর আবার ‘বিপ’ শুনে দৌড়াও। নিয়ম অনুযায়ী, ‘বিপ’ শব্দটা হওয়ার মধ্যে নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু গ্রেগ সে দিন লক্ষ্য করেছিলেন যে, কয়েক জন ক্রিকেটার ‘বিপ’ মিস করেও পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। সেই কারণেই ট্রেনারকে ডেকে ধমক দিয়ে কড়া হতে বলেন।

গুরু গ্রেগের গুণগান করার জন্য ঘটনাটার উল্লেখ করলাম, এমন নয়। বোঝাতে চাইছি, আধুনিক ফিটনেস পরীক্ষা ভারতীয় ক্রিকেটে চালু হয়ে গিয়েছে অনেক দিন ধরেই। কিন্তু সেটা এত দিন ছিল ভারতীয় মানের। এতদিনে আন্তর্জাতিক মানের ফিটনেস পদ্ধতি আনা হল।

ভারতীয় দলের ট্রেনার হিসেবে শঙ্কর ভাসু দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এই অত্যাধুনিক ট্রেনিং পদ্ধতি চালু হয়েছে। যদিও ‘ইও ইও টেস্ট’ ভারতীয় ক্রিকেটে প্রথম এসেছিল ২০০৮ সালে ট্রেনার পল চ্যাপম্যানের হাত ধরে। কিন্তু সেটা ছিল ‘লেভেল ওয়ান’ পরীক্ষা। এখন ভারতীয় ক্রিকেটারদের যেটা পাশ করতে হচ্ছে, সেটা ‘ইও ইও লেভেল টু’। অনেক বেশি কঠিন।

আরও পড়ুন: কিট নিয়ে সমস্যায় বিরাটরা

প্রধানত ‘ইও ইও’ প্রক্রিয়াটা হচ্ছে, খেলোয়াড়দের অক্সিজেন ধারণের ক্ষমতা মাপা। সেটার উপরেই নির্ভর করে এক জন খেলোয়াড় মাঠে কতটা এনার্জি দেখাতে পারবে। ২০ মিটারের দূরত্বে দু’দিকে দু’টো চাকতি থাকে। স্টার্টিং পয়েন্টে ‘বিপ’ শব্দ হলেই শুরু করতে হবে। অন্য প্রান্তে পৌঁছতে হবে পরের ‘বিপ’ হওয়ার মধ্যে। তার পর টার্ন নিয়ে স্টার্টিং পয়েন্টে ফিরতে হবে তৃতীয় ‘বিপ’ হওয়ার আগে। যাওয়া এবং আসার জন্য ৭-৭ করে ১৪ সেকেন্ড পাওয়া যাবে। এই একটা ল্যাপ সম্পূর্ণ করে ৫ মিটারের একটা ‘’ পাওয়া যাবে। সেই ৫ মিটারের মধ্যে ১০ সেকেন্ডের জন্য হেঁটে শ্বাস পুনরুদ্ধার করার সুযোগ থাকে। তার পরেই শুরু হয়ে যাবে দ্বিতীয় লেভেল।

একাগ্র: ফিটনেস নিয়ে কোনও আপস নয় ধোনিদের। ফাইল চিত্র

এ রকম করে যে খেলোয়াড় যত বার এই ২০ মিটার করে দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে, তার ফিটনেস মান তত ভাল। তবে কোনও কোনও লেভেলে একাধিক ল্যাপও দিতে হয়। আরও একটা ব্যাপার। পরীক্ষা যত এগোবে, তত ২০ মিটার দূরত্ব পেরনোর জন্য ধার্য সময় কমতে থাকবে। প্রথম ল্যাপে যদি ৭ সেকেন্ড সময় পেয়ে থাকো, তা হলে চতুর্থ বা পঞ্চম ল্যাপের সময় সেটা কমে আসবে ৫ সেকেন্ডে।

ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে এই মূহূর্তে ‘ইও ইও টেস্ট’-এ দু’জন শীর্ষে। বিরাট কোহালি এবং মণীশ পাণ্ডে। ওরা দু’জনেই ১৯ লেভেলের উপরে যেতে পারে। যেটা ভারতীয় মান অনুযায়ী, অসাধারণ! অতীতে ‘বিপ টেস্ট’-এর সময় মহম্মদ কাইফ ছিল সেরা। মণীশ বা কোহালি আরও অনেক এগিয়ে গিয়েছে। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। এক জন গড়পরতা আন্তর্জাতিক ফুটবলার ২২ লেভেল পর্যন্ত ‘ইও ইও টেস্ট’ করতে পারে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো থেকে ইউসেইন বোল্ট— প্রত্যেকে ফিট থাকার জন্য এই ট্রেনিং করে। সেখানে ১৯ লেভেল বেশ ভাল।

তবে ‘ইও ইও টেস্ট’-ই একমাত্র প্রক্রিয়া নয়। কোহালিদের ফিটনেস চার্টে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রয়েছে। যার নাম ‘অলিম্পিক লিফ্‌ট’। এখনকার টি-টোয়েন্টি যুগে শিল্পের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে শক্তি। জোরে বল মারার ব্যাপার অনেক বেশি করে এসে পড়েছে। পাওয়ারহিটারের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। আর সেই কারণে ক্রিকেটারদের মধ্যে ওয়েট ট্রেনিংয়ের গুরুত্বও বেড়ে গিয়েছে। কোহালি এ ব্যাপারেও ভারতীয়দের মধ্যে পথিকৃৎ। জোরে মারতে গেলে শরীরের জোর বাড়াতে হবে, ওজন তুলে শক্তিশালী হতে হবে— এটা বিরাট প্রথম উপলব্ধি করেছিল বছর চারেক আগে আইপিএল খেলতে গিয়ে। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরেই তখন ট্রেনার হিসেবে ছিল এই শঙ্কর ভাসু। ওর দেওয়া ‘অলিম্পিক লিফ্‌ট’-এর চার্ট অনুসরণ করে ওজন তোলা শুরু করল বিরাট। আর তাতে কী ফল হয়েছে, সে তো দেখাই যাচ্ছে। বিরাটের দেখাদেখি এখন অন্যরাও একই জিনিস করছে।

ভারতীয় দলে ‘ইও ইও টেস্ট’-কে এখন ফিটনেস মান নির্ধারণের মাপকাঠি করে দেওয়া হয়েছে। বলে দেওয়া হয়েছে, জাতীয় দলে সুযোগ পেতে হলে ১৬.৫ লেভেল পর্যন্ত যেতেই হবে। সংবাদমাধ্যমের খবর, যুবরাজ সিংহ এবং সুরেশ রায়না নাকি এই পরীক্ষাতেই আটকে গিয়েছে। এটা সত্যি হলে আমি অন্তত অবাক হব না। যুবির ফিটনেস মান অনেকটাই পড়ে গিয়েছে। রায়না বেশ মোটা হয়ে গিয়েছে। আর ‘ইও ইও টেস্ট’ এমনই এক হার্ডল, যা পেরতে গেলে শারীরিক সক্ষমতার চূড়োয় থাকতে হবে।

এখানেই সব চেয়ে বড় ধাঁধার নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েও ধোনি এই পরীক্ষায় পাশ করার সক্ষম। অথচ কোহালির মতো হাড় ভাঙা ট্রেনিংই কখনও করেনি ধোনি। ওর ফিটনেস প্রক্রিয়া মানে ফুটবল খেলা বা সারা মাঠে দৌড়নো। খুব বেশি হলে সাইক্লিং করতে জিমে ঢোকে। প্রশ্ন হচ্ছে, ধোনি কী করে এত ফিট থাকে? সত্যিই এটা একটা রহস্য। মনে হয় জন্মগত ভাবেই ভীষণ শক্তিশালী হওয়াটা ধোনির ক্ষেত্রে অ্যাডভ্যান্টেজ। ওর শরীরের নীচের অংশ অসম্ভব শক্তিশালী। অন্যদের যেটা জিমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থেকে করতে হয়েছে, সেটা ধোনির এমনিই রয়েছে। সেই কারণেই ভীষণ ক্ষিপ্র ও। দারুণ জোরে দৌড়তে পারে। রানিং বিটুইন দ্য উইকেট্‌স প্রতিযোগিতা হলে এখনও কেউ ধোনিকে হারাতে পারবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE