যাত্রা: ট্রেনে ওঠার আগে হাওড়া স্টেশনে তেহসিনা, আলফিসা এবং সমা। শনিবার সন্ধ্যায়।
হ্যাটট্রিক চাই! হ্যাটট্রিক! চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরতে হবে কিন্তু!
শনিবার হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে পাড়ার মেয়েদের উদ্দেশে একের পর এক আবদার ছুড়ে দিচ্ছেন রাজাবাজারের শাহিনা জাভেদ, মহম্মদ দানিশেরা। ট্রেন ছাড়তেই কান্না জড়ানো গলায় সাকিনা বেগম বললেন, ‘‘আমাদের মেয়েরা জিতে ফিরবেই! ওরা এমনিই জিতে গিয়েছে! স্বপ্নের ট্রেন ধরে ফেলেছে ওরা!’’ ফুটবলে ভারত জয় করতে মুম্বই যাচ্ছেন রাজাবাজারের তিন কন্যা।
আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি মুম্বইয়ে শুরু হচ্ছে ‘ন্যাশনাল ইনক্লিউসন কাপ’। দেশের ২৪টি রাজ্য অংশ নিতে চলেছে ওই প্রতিযোগিতায়। আসছে নেপালও। এর মধ্যে ২৩টি মহিলা ফুটবল দল। অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যেকেই অনগ্রসর শ্রেণির। খেলা চলবে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
সেখানে বাংলার মহিলা ফুটবল দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার কথা তেহসিনা বানু, আলফিসা হুসেন এবং সমা পরভিনের। প্রতিযোগিতার জন্য এই ক’দিন আলফিসাদের ফুটবল অনুশীলন চলেছে জোরকদমে। সল্টলেকে দু’বার এবং হাওড়ায় একটি শিবির হয়েছে। সেখানেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মেয়েদের সঙ্গে ট্রায়ালে নির্বাচিত হয়েছেন তেহসিনারা। ২০১৬ সালে হোমলেস বিশ্বকাপে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করা সাদ্দাম হুসেন কোচ তেহসিনাদের। তাঁর অধীনে বেশ কয়েকটি
অনুশীলন ম্যাচও খেলেছেন তাঁরা। সঙ্গে চলেছে ভিন্ রাজ্যে খেলতে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি।
তবে একটা সময়ে এই ফুটবল খেলা নিয়েই প্রবল বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল আলফিসাদের। গত ডিসেম্বর থেকে কার্যত রাজাবাজারের মাঠে নামতেই দেওয়া হয়নি তাঁদের। এক নাবালিকার বিয়ে আটকেছেন সন্দেহে সেই সময়ে হামলা হয়েছিল সমাজকর্মী শাহিনা জাভেদের উপরে। শাহিনার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারই সদস্য তেহসিনারা তাঁর উৎসাহেই ফুটবল খেলা শুরু করেন। সেই সময়ে ভাঙচুর হয় শাহিনার দফতরেও। ফুটবল খেলতে নামলে বা শাহিনার সঙ্গে মিশলে তেহসিনাদের পাড়াছা়ড়া করারও হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। ওই হুমকিতে অবশ্য দমে যাননি তেহসিনারা। এর মধ্যেই জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলার সুযোগ চলে আসে তাঁদের কাছে।
আরও পড়ুন: ‘ওয়ান ডে ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা বিরাট’
ফুটবল খেলতে গিয়ে তার আগেও বিপদে পড়েছেন তেহসিনা, আলফিসারা। ট্রেনে ওঠার আগে তেহসিনা জানালেন, শাহিনা যখন মেয়েদের ফুটবল টিম তৈরির
কাজ শুরু করেন, তখনই খেলার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। সেই সময়ে তিনি তিন বছর বয়সী এক বাচ্চার মা। স্বামী কিছুতেই চাননি তেহসিনা ফুটবল খেলুন। তাঁর কথায়, ‘‘ভোর ছ’টা থেকে রাজাবাজারের মাঠে আমাদের প্র্যাকটিস থাকত। আমি যাতে যেতে না পারি, তার জন্য রোজ সকালে বাচ্চাকে জাগিয়ে দিতেন আমার স্বামী। তাই বেশ কয়েক দিন মাঠে যাওয়াই হয়নি।’’ এখন আর স্বামীর সঙ্গে থাকেন না তেহসিনা। স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে দেখে চিকচিক করে ওঠে তাঁর চোখ। বলেন, ‘‘এক সপ্তাহ থাকব না। মুম্বই যাচ্ছি। তিনি হয়তো জানেনও না। আমার বাচ্চাকে এই ক’দিন মা-ই দেখবে।’’
তার আগে প্রশিক্ষণ শিবিরে দলের সঙ্গে।
আলফিসার সামনে আবার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফুটবল খেলার পোশাক। পরিবারের তরফে বলা হয়েছিল, মেয়ে হয়ে ছোট পোশাক পরে ফুটবল খেলা চলবে না। পরে তাঁর বাবা জানিয়ে দেন, গোটা শরীর ঢাকা পোশাক পরেও তাঁকে ফুটবল খেলতে দেওয়া হবে না। শেষে অনেক চেষ্টার পরে বাবাকে রাজি করাতে পেরেছেন আলফিসা। বললেন, ‘‘প্রথম প্রথম বাবা আমার খেলার জুতো লুকিয়ে রাখতেন। আজ সকালে দেখি, নিজেই জুতো পরিষ্কার করে ব্যাগে ভরে দিয়েছেন।’’
আর সমা? দলের স্ট্রাইকার তিনি। বললেন, ‘‘কোনও বাধা মানিনি এত দিন। গোল করতেই হবে। যাদের সঙ্গেই খেলা পড়ুক, জিতে ফিরবই।’’
মুম্বইমুখী ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পরে শাহিনা বললেন, ‘‘মাঠ পর্যন্ত আসতেই ওদের কতটা লড়াই করতে হয়েছে জানি। ফুটবল খেলার জন্য ওই মেয়েরা এখন রাজ্যের বাইরে রাত কাটাবে! এর থেকে বড় পাওনা আর হয় না।’’
ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার ও নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy