Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পায়ে সেই বোমার টুকরো নিয়েই কামাল লাকমলের

বৃহস্পতিবার ইডেনে যেন আটান্ন বছর আগের ফিরোজ শাহ কোটলার ছবি ফিরিয়ে আনলেন সনৎ জয়সূর্যের শহর থেকে উঠে আসা এই পেসার।

নায়ক: ভারতের ঘাতক সুরঙ্গা লাকমল। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

নায়ক: ভারতের ঘাতক সুরঙ্গা লাকমল। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

রাজীব ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:৫৬
Share: Save:

এমন একটা স্পেল কখনও স্বপ্নেও ভেবেছিলেন সুরঙ্গা লাকমল?

৬-৬-০-৩।

বৃহস্পতিবার ইডেনে যেন আটান্ন বছর আগের ফিরোজ শাহ কোটলার ছবি ফিরিয়ে আনলেন সনৎ জয়সূর্যের শহর থেকে উঠে আসা এই পেসার। ১৯৫৯-এর ডিসেম্বরে কোটলায় অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি লেগ স্পিনার রিচি বেনো এ রকমই ভয়ঙ্কর এক স্পেল করেছিলেন জিএস রামচাঁদের ভারতের বিরুদ্ধে। ৩.৪-৩-০-৩। এ দিন ইডেনে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় ও ঘাসের উইকেটে ভারতীয় টপ অর্ডারে ধস নামিয়ে ৩০ বছর বয়সি পেসার সেই দিনটার কথাই মনে করিয়ে দিলেন যেন।

দিনের প্রথম বলটাই অফ স্টাম্পে পড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কে এল রাহুলের ব্যাট ছুঁয়ে জমা হয়ে যায় সোজা উইকেট কিপার নিরোশন ডিকওয়েলার গ্লাভসে।

শিখর ধবনের বিরুদ্ধে তাঁর তৃতীয় বল। অফ স্টাম্পের বাইরের গুড লেংথ বলটাতে ড্রাইভ করতে গিয়ে ব্যাটের ভিতরের কানা দিয়ে স্টাম্পের দিকে টেনে নেন দিল্লির ওপেনার।

পেসারদের আদর্শ পরিবেশে পরপর দু’টো উইকেট পেয়ে প্রায় রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো মরিয়া হয়ে ওঠেন লাকমল। এ বার তাঁর টার্গেট বিরাট কোহালি। অফ স্টাম্প থেকে হঠাৎ ভিতরে ঢুকে আসা বলটা কোহালির প্যাডে গিয়ে ধাক্কা মারে। জোরালো আবেদন। আম্পায়ার আউট দেন। কোহালি রিভিউ নিলেন, কিন্তু লাভ হল না। যাকে বলে ‘প্লাম্ব এলবিডব্লিউ’।

নায়ককে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা। ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও সবুজ উইকেটে আগুন ঝরিয়ে সারা ইডেনে উত্তাপ ছড়িয়ে দিলেন চামিন্ডা ব্যাসের যোগ্য উত্তরসূরি, যাঁকে ঘষামাজা করে এই জায়গায় নিয়ে আসায় ব্যাসের অবদান কম নয়।

আরও পড়ুন: গতির তুফান উঠেছে, কিন্তু বিনোদন কই

দিনের শেষে এই স্বপ্নের স্পেল নিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন তারকা পেসার ও বোলিং কোচ রুমেশ রত্নায়েকে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘জানি না এটাই সেরা কি না। তবে আমার দেখা অন্যতম সেরা স্পেল তো অবশ্যই। উইকেট থেকে সাহায্য পেয়ে ছেলেটা জ্বলে উঠল।’’

ছ’ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা। তবু একটা সময় শরীরে যথেষ্ট শক্তির অভাবে লম্বা স্পেল করতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠতেন সুরঙ্গা। লম্বা স্পেল করলেই তাঁর অসুস্থ হয়ে পড়াটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কলম্বোর বাইরে বিভিন্ন জেলা শহর থেকে উঠে আসা পেসারদের পুষ্টির সমস্যা অবশ্য বরাবরেরই। তাই কলম্বোর অ্যাকাডেমিতে এনে দুর্বল শরীরের বোলারদের আগে শারীরিক ভাবে তৈরি করে তার পরে তাদের বোলিং দক্ষতায় ধার দেওয়া হয়। সুরঙ্গার ক্ষেত্রেও সেটাই করেছিলেন ব্যাস। অ্যাকাডেমিতে সুরঙ্গাকে তৈরি করেন তিনি।

কিন্তু ২০০৯-এ লাহৌরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটার পরেও যে মাঠে ফিরতে পারবেন তিনি, এটাই ভাবা যায়নি। শ্রীলঙ্কার টিম বাসে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হানায় যে বোমা বিস্ফোরণ হয়, তার টুকরো সুরঙ্গার বাঁ পায়ে গেঁথে যায়। সেই বোমার টুকরো এখনও বার করা যায়নি তাঁর পা থেকে। বোমার টুকরো পায়ে নিয়েই এখনও রান-আপ নিয়ে বোলিং করেন তিনি। বৃহস্পতিবার ইডেনেও যার ব্যতিক্রম হয়নি।

সেই দুর্ঘটনার পরে এক সাক্ষাৎকারে সুরঙ্গা বলেছিলেন, ‘‘সে দিন মনে হয়েছিল আর বাঁচব না। ভগবান বুদ্ধ বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। ডাক্তাররা বলেছিলেন, অস্ত্রোপচার করে বোমার টুকরোটা বার করতে গেলে আমাকে দীর্ঘদিন ক্রিকেটের বাইরে থাকতে হবে।’’

আরও পড়ুন: বোলিং অ্যাকশনের জন্য নির্বাসিত হাফিজ

এখনও বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরোতে গেলে তাঁর পায়ের ভিতরে থাকা সেই বোমার টুকরোর খোঁজ পেয়ে মেটাল ডিটেক্টর বেজে ওঠে। তখন নিরাপত্তারক্ষীদের সেই ঘটনার কথা বলে বোঝাতে হয়, কেন পায়ের মধ্যে সেই ভয়ঙ্কর অতীতের চিহ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে তাঁকে।

গদ্দাফির সেই জঙ্গি হানা হয়েছিল যে দলের উপর, সেই দলের একমাত্র সুরঙ্গাই ভারত সফরে আসা এই দলে রয়েছেন। আর এক সদস্য চামারা কপুগেদারা এখনও খেললেও এই দলে নেই। ২০১৪ সালে পায়ে বোমার টুকরো নিয়েই দুবাইয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন যে ভাবে, তেমনই বৃহস্পতিবার ইডেনে আরও ধারালো পারফরম্যান্স দেখালেন রাহুল, ধবন, কোহালিদের আউট করে। এর পর আরও কত চমক দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন, কে জানে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE