Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

স্মারক বিক্রি করে বাঁচতে চান নইমুদ্দিন

রাজ্য সরকারের দেওয়া ক্রীড়াগুরু, ফেডারেশনের সোনার পদক, মোহনবাগান রত্ন, দু’দিন আগে পাওয়া ইস্টবেঙ্গলের ‘জীবনকৃতি’ সম্মান-সহ অসংখ্য ট্রফি ছড়িয়ে ছিটিয়ে টেবলে।

আশায়: হাতে ধরা অর্জুন থেকে দ্রোণাচার্য পুরস্কার। যে সব এখন বিক্রি করতে চান নইম। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

আশায়: হাতে ধরা অর্জুন থেকে দ্রোণাচার্য পুরস্কার। যে সব এখন বিক্রি করতে চান নইম। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৭ ০৩:৫৫
Share: Save:

রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির হাত থেকে নেওয়া অর্জুন পুরস্কারের স্মারক মুছে চকচকে করেছেন কয়েকদিন আগে।

দেশের একমাত্র ফুটবল দ্রোণাচার্য হিসাবে পাওয়া বিশাল ট্রফি, ফ্রেমে বাঁধানো শংসাপত্রর উপর পড়ে থাকা ঝুল ঝেড়েছেন।

রাজ্য সরকারের দেওয়া ক্রীড়াগুরু, ফেডারেশনের সোনার পদক, মোহনবাগান রত্ন, দু’দিন আগে পাওয়া ইস্টবেঙ্গলের ‘জীবনকৃতি’ সম্মান-সহ অসংখ্য ট্রফি ছড়িয়ে ছিটিয়ে টেবলে।

উনিশশো সত্তরে ব্যাঙ্কক এশিয়াডে জেতা ব্রোঞ্জ পদকটি অবশ্য খুঁজে পাচ্ছেন না। বাড়ি তন্ন তন্ন করেও। তাঁর অধিনায়কত্বে জেতা ওটাই তো এশিয়াড ফুটবলে ভারতের শেষ পদক।

কেন এই খোঁজা, কেনই বা এই ট্রফি-স্মারক মোছামুছি!

‘‘সব বিক্রি করে দিতে চাই। এগুলোর আমার কাছে আর কোনও দাম নেই। বেঁচে থাকার জন্য আমার টাকার দরকার। প্রতি দিনের বাঁচার জন্য। যদি ভাল দামে এগুলো কেউ নেয়, তা হলে হায়দরাবাদ চলে যাব। বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকব। একটা অ্যাকাডেমি করে ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেব,’’ প্রবল বৃষ্টির মধ্যে বৃহস্পতিবার বিকেলে এ কী বলছেন সৈয়দ নইমুদ্দিন? মিলিটারি মেজাজের মানুষ, ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা স্টপারের মুখ থেকে ট্রফি বিক্রি করে বেঁচে থাকার কথা! এটাও কী সম্ভব?

আরও পড়ুন: মঁফিলকে হারিয়ে অঘটন ভামব্রির

‘‘অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি? মানসিক রোগী? সেটা কেউ বলতেই পারে পদক বিক্রির কথা শুনে। কিন্তু বাধ্য হচ্ছি এটা করতে। আমার কোনও আয় নেই। চাকরি ছেড়েছি সতেরো বছর আগে। জমানো টাকা নেই। এশিয়াডে ব্রোঞ্জের জন্য সরকার দিত ছয় হাজার টাকা। এখন পাই তিন হাজার। এর বাইরে একটা টাকাও রোজগার নেই। আমার চল্লিশ বছরের পুরনো নর্মদা কোম্পানির স্কুটার চড়ে এ-দিক ও-দিক যেতেই তো সেটা চলে যায়। ওই স্কুটার কোম্পানিটা উঠে গিয়েছে, জানেন?’’ বলতে বলতেই উঠে পড়েন কলকাতার তিন প্রধানে খেলে বা কোচিং করিয়ে অসংখ্য ট্রফি জেতা নইম। বিমর্ষ মুখে নিয়ে আসেন এক গোছা লটারির টিকিট। কোনওটা সরকারি, কোনওটা বেসরকারি। বিদেশের অনলাইন টিকিটও দেখা গেল। ‘‘বিশ্বাস করবেন না হয়তো, তবুও বলছি, আমি নিয়মিত লটারির টিকিট কিনি। যদি জ্যাকপটটা পাওয়া যায়! যদি কোটি টাকা ওঠে! তা হলে আর ছেলেদের কাছে টাকা চেয়ে চেয়ে বাঁচতে হবে না। লটারি পেলে কেউ তো বলতে পারবে না অন্যায়ভাবে টাকা পেয়েছি। অন্যায় আমার রক্তে নেই।’’ বিস্মিত হয়ে সাফ-কাপ জয়ী জাতীয় কোচের দিকে তাঁকাতেই নইম আরও চমকে দেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান আমাকে এক লাখ টাকা করে দিয়েছিল বলে বাজারের ধার কিছুটা শোধ করেছি। এই ফ্ল্যাটের সার্ভিস চার্জ দিতেই মাসে লাগে দশ হাজার টাকা। কোথায় পাব?’’ বাইপাসের ধারে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। ড্রইংরুমটা চোখ ধাঁধানো। সেখানে বসেই স্মারক বিক্রি করে বেঁচে থাকার কথা বলছেন নইম! বিশ্বাসযোগ্য? কেমন যেন বেমানান লাগছিল? প্রশ্নটা অবশ্য করতে হয়নি। তার আগেই, ‘‘বাম আমলে ফ্ল্যাটটা পেয়েছিলাম কোটায়। তাও কেনার টাকা ছিল না। যুক্তরাস্ট্র থেকে ছেলেরা, মুম্বই থেকে মেয়ে টাকা দিয়েছিল। ওরাই সাজিয়েছে। আমার সঙ্গে তাই ওঁদেরও নাম আছে। এটা বিক্রির কথা ভাবছি, দেখি ওরা রাজি হয় কি না?’’ বলছিলেন ঝলমলে ফুটবল ও কোচিং জীবন নিয়ে সামনে বসে থাকা, তিয়াত্তর ছোঁয়া নইম। ফুটবলার জীবনের নায়োকোচিত চেহারা, ফিটফাট থাকার অভ্যাসটা রয়ে গিয়েছে এখনও। রোদ-চশমটাও সঙ্গী। সেই রাজার মতো মেজাজি নইমকে এ দিন মনে হচ্ছিল অন্য গ্রহের মানুষ! এ তো পঞ্জাবের সংসারপুরে প্রাক্তন হকি তারকাদেরই জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাঁরাও তো অলিম্পিক্সের সোনা, রুপো, ব্রোঞ্জ পদক বিক্রি করে দিয়েছেন অভাবের তাড়নায়। তা বলে নইম-ও!

ফুটবলারদের ‘মিলিটারি শাসন’- এ রাখেন বলে সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আর এখন ডাকে না ক্লাবেরা। বাংলাদেশে দু’তিন মাসের জন্য যান কোচিং করাতে। সেখানেও ঠিকঠাক পারিশ্রমিক জোটে না। বলছিলেন, ‘‘প্রদীপদার (পিকে) মতো একটা পেট্রোল পাম্প চেয়ছিলাম। দেশের একমাত্র অর্জুন-দ্রোণাচার্য বলে তেল কোম্পানিগুলো রাজি ছিল। কিন্তু জমি পেলাম না। দিদির (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়ি গিয়েছি। দেখা করতে পারিনি। মদন মিত্রর কাছে আবেদনের কপি দিয়েছিলাম জমি চেয়ে। কিছু হয়নি। হলে ট্রফি বিক্রি করার কথা অন্তত ভাবতাম না।’’ কিন্তু কে কিনবে আপনার ট্রফি? পাবেন প্রচুর টাকা? ‘‘জানি ভারতে হয়তো এগুলো বিক্রি হবে না। গাল্‌ফ কান্ট্রিতে যদি কেউ কেনে? ওদের তো প্রচুর পয়সা। পঞ্চাশ লাখে কেউ কিনবে না?’’ এই প্রথম বার আশায় যেন চকচক করে ওঠে এক ফুটবল দ্রোণাচার্যের মুখ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE