Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভয়কে জয় করার শাস্ত্রীয় মতে ছুটতে চায় বিরাট বাহিনী

কলকাতায় তাঁবু ফেলা ভারতীয় দলের অন্দরমহলে ঢুঁ মেরে মনে হচ্ছে, রিপ ভ্যান উইঙ্কলের সেই ঘুম ভেঙে উঠে দেখার মতো কত কিছুই যেন অচেনা! ঠিক মনে করা যাচ্ছে না ঘুমোতে যাওয়ার আগে ছিল কি না:

যুগলবন্দি: ভারতীয় ড্রেসিংরুমের সামনে আলোচনায় বিরাট কোহালি ও রবি শাস্ত্রী। বুধবার। ছবি: পিটিআই।

যুগলবন্দি: ভারতীয় ড্রেসিংরুমের সামনে আলোচনায় বিরাট কোহালি ও রবি শাস্ত্রী। বুধবার। ছবি: পিটিআই।

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৪:১২
Share: Save:

বৃষ্টিভেজা ইডেন থেকে বেরনোর সময় ক্লাবহাউসের সামনে অন্তত হাজার খানেক ক্রিকেটভক্ত।

মনে হতে পারে, এর মধ্যে আশ্চর্যের কী আছে? কত কাল ধরেই তো এমন ঘটছে ইডেনের সামনেটায়।

ভারতীয় দল এবং তারকা ক্রিকেটারদের নামে জয়ধ্বনি উঠতে শুরু করল টিম ইন্ডিয়ার ক্রিকেটারেরা বাসে ওঠার সময়।

মনে হতে পারে, এটাই বা নতুন কী? ইডেনে ভারতীয় দল আসা মানে তো এমন জয়ধ্বনি আর গর্জন ওঠা।

মনে হতে পারে, খুবই রুটিন একটা দিন। এবং, সম্পূর্ণ ভুল মনে হবে কারণ, ঘটনাটা আদৌ রুটিন ক্রিকেট সূচি মেনে নয়। বরং দিনটা ছিল রুটিন ভেঙে বেরিয়ে আসার।

কলকাতায় তাঁবু ফেলা ভারতীয় দলের অন্দরমহলে ঢুঁ মেরে মনে হচ্ছে, রিপ ভ্যান উইঙ্কলের সেই ঘুম ভেঙে উঠে দেখার মতো কত কিছুই যেন অচেনা! ঠিক মনে করা যাচ্ছে না ঘুমোতে যাওয়ার আগে ছিল কি না:

বৃষ্টিভেজা ইডেনে আগমন: ভারতীয় দল ইডেনে এসে দেখল, মাঠ ভিজে রয়েছে, ঘটনাটা তা নয়। তারা আগেই জানত, এ দিনও প্র্যাকটিস করা সম্ভব নয়। কারণ এখনকার দিনে স্টেডিয়াম থেকেই ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়, মাঠ পুরো ভিজে রয়েছে, ঢেকে রাখা হয়েছে। অতীতে এরকম ফোন আসা মানে তৎক্ষণাৎ প্র্যাকটিস সূচি বাতিল। হোটেল থেকে মাঠমুখো হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনাও নেই। যদি শারীরিক কসরত করারও থাকে, সেটা হবে হোটেলের মধ্যেই। রবি শাস্ত্রী-বিরাট কোহালি জুটির জমানায় পর-পর দু’দিন হোটেলের মধ্যে আটকে থাকার রেওয়াজ বন্ধ। এমনিতেই হেড কোচ ও অধিনায়কের ক্রিকেটীয় ঘরানাতে দারুণ মিল। কুম্বলে-কোহালি সময়কার মতো আবহ নেই যে, কোচ আর অধিনায়কে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। শাস্ত্রী এবং কোহালির মনস্তত্ত্বটাও একই রকম। দু’জনেই খোলামেলা ভঙ্গি এবং মনের ভাব প্রকাশ করার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। শাস্ত্রীয় মত হচ্ছে, যত পারো বহির্জগতে সক্রিয় হও। অবাক হওয়ার থাকবে না যদি তিনিই ব্রেকফাস্ট টেবলে বিরাটদের বলে থাকেন, বৃষ্টি হোক না হোক, চলো আমরা মাঠে যাই। ফুল ফুটুক না ফুটুক, মনে বসন্ত থাকলেই বসন্ত।

তারকা নয়, দলই তারকা: অধিনায়ক কোহালি থেকে শুরু করে তাঁর পূর্বসূরি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি— কেউ বাদ গেলেন না ইডেনের প্র্যাকটিসে আসতে। ‘অপশনাল’ বলে কিছু নেই। বৃষ্টিভেজা ইডেনে এসে কোহালি, ধোনিরা ক্রিকেট খেলতে নামতেই পারলেন না। কে এল রাহুল শুধু গিয়েছিলেন ইন্ডোরে ব্যাট করতে। বাকিরা ড্রেসিংরুমের সামনের লনে ফুটবল খেললেন। তবু সকলে এলেন। ইডেনে বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী রোহিত শর্মা বেশিক্ষণ ফুটবল খেললেন না। কিন্তু চপ্পল পরে ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ালেন। অর্থাৎ, কাল যেখানে ম্যাচ খেলতে হবে সেখানকার ঘ্রাণ নাও। দেখতে দেখতে মনে হবে, ফুটবলটাও কোহালিদের এই টিমে আর শখের খেলা নয়, একটা নিয়ম। শাস্ত্রী-কোহালি যুগলবন্দি তারকাপ্রথার অবলুপ্তি সম্পূর্ণ ভাবে ঘটিয়ে দলগত বন্ধন তৈরি করতে চাইছেন। ইডেনে ফুটবল খেলার দিনেও তাই হাজির কোহালি, ধোনি-রা। সেই ফুটবল খেলার মধ্যেও বারবার ধরা পড়ল ধোনি-কোহালি সৌহার্দের ছবি। ভারতীয় ক্রিকেটের বরাবরের ইতিহাস মেনে ক্যাপ্টেন-ভাইস ক্যাপ্টেন তিক্ততার সম্পর্ক নয়, যেন বড় ভাই আর ছোট ভাই খেলছে।

মেজাজ: বৃষ্টিতে নেট প্র্যাকটিস বন্ধ। ফুট-ভলি খেলে সময় কাটাচ্ছেন ধোনি, কোহালিরা। বুধবার ইডেনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

গ্যালারিকে সঙ্গে রাখো: কলকাতার পরিচিতদের মাধ্যমে কোহালিদের কাছে খবর পৌঁছেছিল, এখানকার ক্রিকেট ভক্তরা তাঁদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন মঙ্গলবারেও। প্রিয় তারকাদের দেখতে না পেয়ে তাঁদের মন খারাপ হয়ে যায়। কলকাতার ক্রীড়াপ্রেমী মানুষদের আবেগ সম্পর্কে দলের সকলেই ওয়াকিবহাল। কোহালির জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি এখানে। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ওয়ান ডে ম্যাচে। আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের হয়ে কাটা হাত নিয়ে সেঞ্চুরি করেছেন ভরা ইডেনে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জিতিয়েছেন। শাস্ত্রী ক্রিকেটার হিসেবে বহুবার তো এসেইছেন, ধারাভাষ্যকার হিসেবেও বার বার কলকাতার আবেগের সাক্ষী থেকেছেন। ক্লাব হাউসের বাইরে অপেক্ষমান জনতাকে উপর্যুপরি দ্বিতীয় দিনে আর হতাশ করতে চাননি তাঁরা। এবং, কোহালিরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের দেখে যে রকম গর্জন উঠল ভিড়ের মধ্যে থেকে, তা শুনলে মনে হবে বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভক্তদের এই দাঁড়িয়ে থাকাটাও হয়তো ইডেনের ম্যাচের আগে উদ্বুদ্ধ করবে গোটা দলকে। সকলেই তাই টিমবাসে ওঠার মুখে ভক্তদের দিকে হাত নেড়ে গেলেন। মাঠে যখন চাপ তৈরি হবে, সত্তর হাজারের ওই গর্জনই তোমার অক্সিজেন হয়ে উঠবে। সেই কারণে কোহালিকে চেন্নাইতেও দেখা গিয়েছে গ্যালারির দিকে হাত নেড়ে চেঁচাতে বলছেন।

ভয়ডরহীন ক্রিকেটের শপথ: নতুন একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে ‘ডর’ অর্থাৎ ভয়কে আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, মিতালি রাজ-রা। বিজ্ঞাপনে ধোনিকে বলতে শোনা যায়, ‘খড়গপুরে রেলের চাকরিটা যখন ছেড়ে দিলাম, বাড়ি থেকে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। কী করবে যদি ক্রিকেটে সফল না হতে পারো? কিন্তু আমি জানতাম, ভয়কে হারাতে না পারলে কিছুই করতে পারব না’। শুধু বিজ্ঞাপনে ধোনির ভাষা নয়, এখনকার ভারতীয় দলেরই মন্ত্র এটা। সবচেয়ে বেশি করে যে মন্ত্র শেখানো হচ্ছে যশপ্রীত বুমরা-দের, মানে বোলারদের। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ‘নো বল’ আতঙ্ক আর অপমানের সেই দিনগুলো থেকে বেরিয়ে বুমরা যে রাতারাতি এক নম্বর বোলার হয়ে উঠেছেন, তার পিছনে ভয়ডরহীন হয়ে ওঠার মন্ত্র। বোলিং কোচ বি. অরুণ সারাক্ষণ তাঁর সঙ্গে লেগে রয়েছেন। মাঠে নেট প্র্যাকটিস একটা দিক। মাঠের বাইরে বোলারদের সঙ্গে অবিরাম কথা বলে তাঁদের মননকেও গড়ে তোলার দিকে নজর দিচ্ছেন অরুণ। ‘ফিয়ারলেস ক্রিকেট’— এটাই এখন কোহালিদের দলের এক নম্বর ‘থিম সং’। অরুণের কৃতিত্ব হচ্ছে, বরাবর ম্যাচ হারানোর গ্লানি নিয়ে পড়ে থাকা ভারতীয় বোলিংকে তিনি এক দল ডাকাবুকো, ম্যাচউইনারে পরিণত করেছেন। বুমরার ‘নো বল’ করার অভ্যেস ছিল। সেটা কাটানোর জন্য নেট প্র্যাকটিসে তাঁর দিকে আলাদা নজর দিয়েছেন বোলিং কোচ অরুণ। তাঁকে বুঝিয়েছেন, অনুশীলনেও ‘নো বল’ করবে না। অরুণের আমলে অবিশ্বাস্য স্ট্রাইক রেট ভারতীয় বোলারদের। প্রতিপক্ষকে সবচেয়ে বেশি বার অলআউট করেছেন শামি, উমেশরা।

ইডেনে বুধবার ক্রিকেট দেখা যায়নি। কিন্তু কোহালিদের স্কুলে ‘রেইনি ডে’-ও ঘোষিত হয়নি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE