Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
বাঙালির বিশ্বকাপ: মেসিতে ভাসল কলকাতাও

‘মেসি বন্দনায় নীল-সাদা স্রোত দেখলাম মধ্যরাতেও’

কিশোর স্পোর্টিং বিশ্বকাপ উপলক্ষে সেজে উঠেছে রাশিয়ার বিভিন্ন কেন্দ্রের ‘ফ্যান জোন’-এর মতো। মেসি, নেমার, রোনাল্ডোর কাটআউট।

উচ্ছ্বাস: রুদ্ধশ্বাস জয়ের রাতে টালিগঞ্জে কিশোর স্পোর্টিং ক্লাবে এ ভাবেই আবেগে ভাসলেন কলকাতার আর্জেন্টিনা-সমর্থকেরা। মেসিময় হয়ে থাকল আনন্দের রাত। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

উচ্ছ্বাস: রুদ্ধশ্বাস জয়ের রাতে টালিগঞ্জে কিশোর স্পোর্টিং ক্লাবে এ ভাবেই আবেগে ভাসলেন কলকাতার আর্জেন্টিনা-সমর্থকেরা। মেসিময় হয়ে থাকল আনন্দের রাত। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

শিশির ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৮ ০৫:২৬
Share: Save:

গোলের জন্য একটি দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে। নেমার, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, হ্যারি কেনরা যেখানে ছুটতে শুরু করে দিয়েছেন। লিয়োনেল মেসি ছুটছেন উল্টো দিকে।

টালিগঞ্জের চাঁদপুর কলোনিতে আর্জেন্টিনা বনাম নাইজিরিয়া ম্যাচটা দেখতে গিয়েছিলাম বুধবার রাতে। নরেন্দ্রনাথ ঘোষ লেনের সেই কিশোর স্পোর্টিং ক্লাবে ঢোকার মুখেই এক ব্রাজিল সমর্থকের হাতে দেখলাম মেসিকে নিয়ে আঁকা এই ব্যঙ্গচিত্র।

বাচ্চা ছেলেটি হয়তো বুঝতে পারেনি, এই বিশ্বকাপে জয় ও গোল না পাওয়া মেসি ভিতরে ভিতরে কী রকম ফুটছেন। রাশিয়ায় গোলমুখী ১২টা শট নিয়েও যিনি গোল করতে পারেননি। সেই এলএম টেন এ বার বিশ্বকাপে গোলের খাতা খুললেন ১৩ তম প্রয়াসে। যে সংখ্যা অনেকের কাছেই নাকি অপয়া, মেসির কাছে তা পয়া হয়েই ধরা দিল। মেসি শুধু গোলই করলেন না, রূপকথার গল্পের মতো জাগিয়ে দিলেন গোটা আর্জেন্টিনা দলটাকেই। আর তার পরেই অ্যাঙ্খেল দি মারিয়া, মার্কোস রোহো-রা খেললেন সেই পুরনো আর্জেন্টিনার মতোই।

কিশোর স্পোর্টিং বিশ্বকাপ উপলক্ষে সেজে উঠেছে রাশিয়ার বিভিন্ন কেন্দ্রের ‘ফ্যান জোন’-এর মতো। মেসি, নেমার, রোনাল্ডোর কাটআউট। দেওয়াল-চিত্রে হাজির পেলে, মারাদোনা, বেকেনবাউয়াররাও। প্রতিটি দেশের পতাকা ও ক্রীড়াসূচি দিয়ে তৈরি পোস্টার, ফেস্টুন ঝুলছে ক্লাবের সামনে। ক্লাবঘরের বাইরের বারান্দা কৃত্রিম ঘাস দিয়ে ছোট মাঠের মতো সাজানো। সেখানে বিশ্বকাপ দেখতে প্রিয় দলের জার্সি গায়ে রাত জাগছেন গোটা পাড়ার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। সঙ্গে হাজির ড্রাম, ঢাকের বাদ্যি।

আরও পড়ুন: ‘ভুল শুধরেই ভয়ঙ্কর, মাঠ মাতালেন পাওলিনহো-কুটিনহো’

বর্ষার এই ভরা মরসুমে কিশোর স্পোর্টিং ক্লাব তাই কোন দিন হয়ে উঠছে সাও পাওলোর আড্ডাখানা। কোনও দিন আবার বুয়েনস আইরেস শহরতলীর মেজাজ সেখানে। মঙ্গলবার যেমন রাতটা ছিল লিয়ো মেসির সমর্থকদের। রাত দশটা বাজতেই আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে হাজির তিয়াসা দত্ত, অন্বেষা বসুরা। যাঁরা মেসির গোলের জন্য নাকি বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার দিন থেকে। মেসির দর্শনীয় গোলটার পরে গোটা ক্লাবে তাঁদের এমন আবেগের সূর্যোদয় হল, যে বাড়িতেই পালিয়ে গেলেন সেই বঙ্গচিত্র বহনকারী ব্রাজিল সমর্থক।

আর্জেন্টিনার কোচ হর্হে সাম্পাওলি প্রথম দুই ম্যাচে খেলেছিলেন ৪-২-৩-১ এবং ৩-৪-৩ ছকে। নাইজিরিয়ার বিরুদ্ধে সাম্পাওলি ফিরেছিলেন ৪-৪-২ ছকে। আর তাতেই কামাল করে দিলেন মেসিরা। এই বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত সেরা পারফরম্যান্স সাম্পাওলির দলের।

ভিক্টর মোজেসদের জার্মান কোচ গেরনট রোর গত বছর ৩-৫-২ ছকে খেলেই প্রীতি ম্যাচে হারিয়েছিলেন আর্জেন্টিনাকে। তাই মেসিদের স্বপ্ন ভঙ্গ করতে তিনি সেই ছকই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ মানেই যে আর্জেন্টিনার ‘প্রিয় খাদ্য’ হয়ে ওঠে নাইজিরিয়া। এই পর্যন্ত পাঁচ বার মুখোমুখি হল এই দুই দেশ। প্রতি বারই জিতে মাঠ ছাড়ল আর্জেন্টিনা।

যে দু’টো গোল আর্জেন্টিনা করল, সেই দু’টোই তারিয়ে তারিয়ে দেখার মতো। প্রথম গোলের সময় এভার বানেগা যে লম্বা বলটা মেসিকে বাড়িয়েছিলেন, তা আর্জেন্টিনা অধিনায়ক নামালেন বাঁ উরু দিয়ে। এতটাই যত্নশীলভাবে যা দেখলে মনে হবে, জুলিয়েটের কপালে রোমিয়ো একটা চুম্বন এঁকে দিলেন। তার পরে বাঁ পায়ে একটা ছোট্ট টোকা। ‘পেরিফেরাল ভিসন’-এ ততক্ষণে মেসি দেখে নিয়েছেন নাইজিরিয়ার ডিফেন্ডার কেনেথ উমেইরো ঘাড়ের কাছে চলে এসেছেন। মেসি তাই বলটা একটু সামনে ঠেলে দিলেন। যাতে বিপক্ষ ডিফেন্ডার পিছন থেকে ধাক্কা মারলেই পেনাল্টি হয়। কিন্তু গতিতে নাইজিরিয়ার ডিফেন্ডার মেসির নাগাল পাননি। ততক্ষণে ডান পায়ের জোরালো শটে গোল করে গিয়েছেন ফুটবলের রাজপুত্র লিয়ো মেসি। যেমন টেকনিক, তেমন চাট। তেমন ফিনিশ। বিশ্বকাপে চার বছর আগে এই নাইজিরিয়ার বিরুদ্ধে শেষ গোলটা করেছিলেন মেসি। এ বার তিনি গোলের খাতা খুললেন সেই দেশের বিরুদ্ধে।

গোলের পরেই যে ফ্রি-কিকটা নিয়েছিলেন সেটা থেকেও গোল হতে পারত। কিন্তু ভাগ্য তখন সদয় হয়নি মেসির। প্রথমার্ধে দুই উইং ব্যবহার করে নাইজিরিয়া রক্ষণে ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে দিয়েছিলেন দি মারিয়া, এনজো পেরেজরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি বলব এই ম্যাচের নায়ক আর্জেন্টিনা মাঝমাঠের ফুটবলার এভার বানেগা। দুর্দান্ত লোড নিয়ে খেলতে দেখলাম বানেগা ও মাসচেরানোকে।

আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলটা দেখে মনে হল, দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফল। মার্কোস রোহো যে ভাবে ডান প্রান্ত থেকে উড়ে আসা বলে চকিতে শট করে ২-১ করলেন তা চোখের সুখ বাড়ায়। অবাক লাগল এটা দেখে যে তখন নাইজিরিয়ার রাইটব্যাক কোথায় ছিলেন! বলটা উড়ে এল কী ভাবে?

প্রথমার্ধে ০-১ পিছিয়ে গিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে ওদিয়ন ইঘালোকে নামিয়ে ৪-৩-৩ ছকে চলে গিয়েছিলেন নাইজিরিয়া কোচ। এর পরেই যে পেনাল্টি থেকে ভিক্টর মোজেস ১-১ করলেন তা সঙ্গত। এর পরেই মেসিদের আর্জেন্টিনা অর্ধে ঠেলে দিয়ে ম্যাচটা প্রায় ড্রয়ের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন নাইজিরিয়া কোচ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেসি, আগুয়েরোদের গতি সামলাতে পারেনি নাইজিরিয়া।

গোল পেলেন মেসি। এই ম্যাচ জিতে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে চলে গেল আর্জেন্টিনা এ বার সামনে ফ্রান্স। এই চনমনে মেসিকে কিন্তু এ বার সামলানো মুশকিল। বড় কোনও অঘটন না হলে, এই আর্জেন্টিনাকে সেমিফাইনালে দেখছি। কারণ, মনোবল ফিরে পাওয়া মেসিকে সামলানো এ বার কষ্টকর হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE