Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অধিগৃহীত জমি ফেরানো যায় না, মানলেন মন্ত্রীই

তৃণমূলের সরকার সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরত দিতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন এখনও সুপ্রিম কোর্ট ঝুলছে। তার আগেই রাজ্যের এক মন্ত্রী প্রকাশ্যে কবুল করলেন, অধিগৃহীত জমি ফেরত দেওয়ার কোনও আইনি উপায় নেই। এই স্বীকারোক্তি যাঁর, সেই মলয় ঘটকই সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফিরিয়ে দিতে নতুন আইন তৈরির সময়ে রাজ্যের আইনমন্ত্রী ছিলেন। সেই আইন আদৌ সাংবিধানিক কি না, নভেম্বরে তা নিয়ে রায় দেওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের।

সুব্রত সীট
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩৭
Share: Save:

তৃণমূলের সরকার সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরত দিতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন এখনও সুপ্রিম কোর্ট ঝুলছে। তার আগেই রাজ্যের এক মন্ত্রী প্রকাশ্যে কবুল করলেন, অধিগৃহীত জমি ফেরত দেওয়ার কোনও আইনি উপায় নেই।

এই স্বীকারোক্তি যাঁর, সেই মলয় ঘটকই সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফিরিয়ে দিতে নতুন আইন তৈরির সময়ে রাজ্যের আইনমন্ত্রী ছিলেন। সেই আইন আদৌ সাংবিধানিক কি না, নভেম্বরে তা নিয়ে রায় দেওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের। বুধবার অন্ডাল বিমাননগরীর ‘অনিচ্ছুক’ জমিদাতাদের নিয়ে প্রশ্নে সেই মলয়বাবুই (বর্তমানে শ্রমমন্ত্রী) মেনে নিলেন, “অধিগ্রহণ এক বার যদি করা হয়, সেই জমি ফেরত দেওয়ার আইনি সংস্থান নেই।”

বর্ধমানের অন্ডালে প্রস্তাবিত বিমাননগরীর ক্ষেত্রে প্রায় ৬৩০ জন অনিচ্ছুক জমিমালিকদের (যাঁদের হাতে প্রায় ১০৯ একর জমি রয়েছে) সমর্থনে ইতিমধ্যেই মাঠে নেমেছে বিজেপি। সিঙ্গুরের মতোই বাম আমলে ওই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তার পরেই সরকারে চলে আসা তৃণমূল আর অনিচ্ছুকদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি। রাজ্যে রাজনীতিতে উদীয়মান বিজেপি সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি। এ দিন আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের দফতরে মলয়বাবু যখন প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের উপর দিয়ে যাওয়া উচ্চ বিদ্যুত্‌বাহী লাইন সরানো নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করছেন, তখনও ‘অন্ডাল ব্লক কৃষি জমি রক্ষা কমিটি’র তরফে আশপাশে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে।

বৈঠকের পরে মন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, অনিচ্ছুক কৃষকদের হাতে থাকা ১০৯ একর জমির কী হবে? মন্ত্রী বলেন, “ওই জমিমালিকেরা কোর্ট-কাছারি করছেন বলে শুনেছি। সেটা পরে দেখা যাবে।” তবে কি প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ওই জমি দরকার নেই? মলয়বাবু বলেন, “ওই জমি ইতিমধ্যে সরকার অধিগ্রহণ করেছে। সিঙ্গুরে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, এখানেও করা হয়েছে। এবং আপনারা জানেন, অধিগ্রহণ এক বার যদি করা হয়, সেই জমি ফেরত দেওয়ার কোনও আইনি সংস্থান নেই।” কিন্তু এখানে তো অনেকে চেক নেননি? মন্ত্রীর জবাব, “সে তো সিঙ্গুরেও অনেকে নেননি!”

বর্তমান আইনে জমি অধিগ্রহণ হলে যে আর ফেরানো যায় না, সেই যুক্তি আইনজ্ঞেরা এর আগে বারবার দিয়েছেন। সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর গাড়ি কারখানার জন্য অধিগৃহীত জমি অনিচ্ছুক চাষিদের ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস যে অমূলক, সেই সওয়ালও করেছেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর মন্ত্রীরা সে সব কানেই তোলেননি। বরং সরকারে এসে তৃণমূল অর্ডিন্যান্স করে টাটা গোষ্ঠীর হাত থেকে জমি ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজও তা আইনে পরিণত হয়নি। বছরের পর বছর গড়িয়ে যেতে দেখে হতাশ অনিচ্ছুক চাষিরা জমি ফেরত পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছেন।

প্রশ্ন হল, সিঙ্গুর এবং অন্ডালের ক্ষেত্রে তৃণমূলের এই বিপরীত নীতি কেন? সে কি বিরোধী দল হিসেবে জমি আন্দোলনের হাওয়া পালে টানার বাধ্যবাধকতা ফুরিয়ে যাওয়ায়? না কি, শাসকদল হিসেবে রাজ্যে শিল্প আনার বাধ্যবাধকতায়? বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “একে দ্বিচারিতা বললেও কম বলা হয়। মলয়বাবু যে আইনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, সেটা কি তৃণমূল বিশ্বাস করে? যদি করে, তা হলে ওরা সিঙ্গুরে আন্দোলন করল কেন? আসলে ওদের কাজ হল, যেখানে যা করলে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে, তা-ই করে যাওয়া।” সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেন, “আইনমন্ত্রী হিসেবে এই পরামর্শটা উনি সিঙ্গুর নিয়ে আইন এবং অর্ডিন্যান্স করার সময়ে মুখ্যমন্ত্রীকে দিতে পারতেন। উনি কি আইনটা নতুন পড়লেন? না হলে, তাঁদের মেনে নেওয়া উচিত, সিঙ্গুরে আন্দোলন অন্যায় ছিল।”

মলয়বাবু অবশ্য দাবি করেন, “আমাদের নীতি সর্বত্র এক। কিন্তু এই মুহূর্তে আইন নেই। যদি সুপ্রিম কোর্ট অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরতের পক্ষে সার্বিক রায় দেয়, তা হলে এখানেও তা প্রযোজ্য হবে।” ঘটনা হল, যে আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে, তা কেবলই সিঙ্গুরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ওই আইনে অন্য কোথাও অধিগৃহীত জমি ফেরত দেওয়ার সংস্থান রাখেনি রাজ্য। তাই সুপ্রিম কোর্ট সিঙ্গুরে জমি ফেরত দেওয়ার পক্ষে রায় দিলেও অন্ডালের অনিচ্ছুক চাষিদের লাভ নেই। মলয়বাবুও মেনে নেন, “জমি ফেরতের রায় যদি শুধু সিঙ্গুর-কেন্দ্রিক হয়, এখানে তা প্রয়োগ করা যাবে না।”

তবে এই সুযোগে বিজেপি যে শক্তিবৃদ্ধি করছে, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের তৃণমূল নেতারা তা জানেন। ফলে, অনিচ্ছুকদের জমি ফেরতের দাবি তাঁরা উড়িয়েও দিতে পারছেন না। মলয়বাবু যেমন আপাতত কেন্দ্রের কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছেন। তাঁর আশ্বাস, “কেন্দ্র নতুন জমি আইন আনছে। তাতে যদি অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত দেওয়ার সুযোগ থাকে, তা হলে জমি ফেরত দেওয়া যাবে।” কিন্তু সেই সঙ্গেই প্রশ্ন, ওই ১০৯ একর জমি কি তবে প্রস্তাবিত বিমাননগরীর জন্য আবশ্যিক নয়?

মন্ত্রীর ব্যাখ্যা, “ওই জমিতে একটি রাস্তা করার কথা ছিল। অন্য একটি রাস্তা আছে। কাজেই ওই রাস্তাটি না হলেও সমস্যা নেই।” রাস্তা না হলেও যদি চলে, তবে তা গড়ার পরিকল্পনা কেন হয়েছিল, সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, অধিগৃহীত জমির জন্য ২০১১ সাল থেকে টানা খাজনা দিয়ে আসছে বিমাননগরী নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বেঙ্গল এরোট্রোপলিস। তার পরেও জমি ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত, সেই প্রশ্নও উঠছে। তবে বেঙ্গল এরোট্রোপলিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পার্থ ঘোষ এই সব নিয়ে একটি কথাও বলতে চাননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE