Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

অনুব্রতর কণ্ঠস্বর-রিপোর্ট পেয়েও নিষ্ক্রিয় পুলিশ

তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের বিতর্কিত বক্তব্যের (পুলিশকে বোম মারা) ‘ভয়েস টেস্ট রিপোর্ট’ এসে গিয়েছে প্রায় দিন দশেক। পুলিশ সূত্রের খবর, চণ্ডীগড়ের ফরেন্সিক ল্যাবের পরীক্ষায় প্রমাণ মিলেছে গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের আগে প্রচারসভায় ওই উস্কানিমূলক বক্তৃতা তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রতরই দেওয়া। কিন্তু এই রিপোর্টের কথা প্রকাশ্যে আসতেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এর পরেও কি শাসকদলের এই দাপুটে নেতার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে পুলিশ, গ্রেফতার করা হবে তাঁকে?

ভাঙচুরের পরে তছনছ এক বিজেপি কর্মীর বাড়ি।  —নিজস্ব চিত্র

ভাঙচুরের পরে তছনছ এক বিজেপি কর্মীর বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
সিউড়ি ও পাড়ুই শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৫৩
Share: Save:

তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের বিতর্কিত বক্তব্যের (পুলিশকে বোম মারা) ‘ভয়েস টেস্ট রিপোর্ট’ এসে গিয়েছে প্রায় দিন দশেক। পুলিশ সূত্রের খবর, চণ্ডীগড়ের ফরেন্সিক ল্যাবের পরীক্ষায় প্রমাণ মিলেছে গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের আগে প্রচারসভায় ওই উস্কানিমূলক বক্তৃতা তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রতরই দেওয়া। কিন্তু এই রিপোর্টের কথা প্রকাশ্যে আসতেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এর পরেও কি শাসকদলের এই দাপুটে নেতার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে পুলিশ, গ্রেফতার করা হবে তাঁকে?

সরাসরি জবাব না দিয়ে বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া শনিবার বলেন, “ল্যাবের রিপোর্ট এসেছে ঠিকই। তবে আরও প্রমাণ জোগাড় করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পুলিশের এই বক্তব্যে আশ্বস্ত হচ্ছেন না বিরোধীরা। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, “পাড়ুইয়ের ওই সভায় বোমা মারার উস্কানি যে অনুব্রতই দিয়েছিলেন, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু রাজ্য সরকারের চাপে পুলিশ তা নিয়ে টালবাহানা করে চলেছে।” তাঁর সংযোজন: “আইনকে শ্রদ্ধা করলে এ বার অন্তত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচিত তাঁর পুলিশকে অনুব্রতর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া।” বিশিষ্ট আইনজীবী তথা কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষের দাবি, “অনুব্রত কখনওই অস্বীকার করেননি যে, ওই কথাগুলো তাঁর বলা নয়। তবু পুলিশ তাঁকে ঘাঁটায়নি। এই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে শাসক দলের বীরভূমের ওই নেতার বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োজনীয় ধারা প্রয়োগে আর বাধা থাকল না।”

এ ব্যাপারে এ দিন খোদ অনুব্রতর বক্তব্য বহু চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। বার কয়েক তাঁর ফোন ধরে কেউ এক জন বলেন, “দাদা মিটিংয়ে ব্যস্ত।” পরে এক জন বলেন, “সকালে (রবিবার) ফোন করবেন।”

গত বছর ১৭ জুলাই পাড়ুই থানার কসবা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারসভায় রাজ্যের দুই মন্ত্রী মলয় ঘটক এবং চন্দ্রনাথ সিংহের সামনেই অনুব্রত বলেন, “কসবাতে যদি কোনও নির্দল প্রার্থী বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেন, তার বাড়িটা ভেঙে, জ্বালিয়ে দিন। কোনও নির্দল প্রার্থী যদি কোনও হুমকি দেয়, তার বাড়িতে চড়াও হন। এটাই কিন্তু আমি বলতে এসেছি আপনাদের।” এর পরেই তিনি বলেন, “আর যদি কোনও প্রশাসন ভাবে, নির্দলকে সমর্থন করবে, সেই প্রশাসনের পুলিশের উপরে বোম মারুন। আমি বলছি, বোম মারতে।” তার দিনকয়েক আগে রামপুরহাটে দলের কর্মিসভাতেও কতকটা একই কায়দায় বিরোধীদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল অনুব্রতর বিরুদ্ধে।

দু’টি ক্ষেত্রেই রাজ্য নির্বাচন কমিশন অনুব্রতর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেয়। ১৭ জুলাই ওই বক্তৃতার পরেই কসবা অঞ্চলে একাধিক নির্দল প্রার্থীর (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) বাড়িতে হামলা হয়। কসবা পঞ্চায়েতের নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ খুন হন। ওই খুনের ঘটনায় জেলার তত্‌কালীন এসপি-র কাছে ডাকযোগে অনুব্রত-সহ ৪১ জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর নামে অভিযোগ করে নিহতের পরিবার। তার পরেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকেছে বলে অভিযোগ।

নির্বাচন কমিশনের চাপে গত বছর ২৫ জুলাই সিউড়ি সিজেএমের এজলাসে পাড়ুই থানার পুলিশ উস্কানিমূলক বক্তৃতার জন্য অনুব্রতর বিরুদ্ধে মামলা শুরু করার আবেদন করে। আবেদনের সঙ্গে ছিল না অনুব্রতর ওই বক্তৃতার সিডি। পরে বিচারক নিজে ওই বক্তৃতার সিডি দেখে পুলিশকে অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করার নির্দেশ দেন। গোটা মামলায় পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বিচারক সে দিন লিখিত নির্দেশে বলেছিলেন, ‘এটি পুলিশের দিক থেকে নিষ্ক্রিয়তা। যা হাল্কা ভাবে নেওয়া উচিত নয়।’

এর পরেও পুলিশ অনুব্রতকে গ্রেফতার তো দূর, কোনও দিন জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। অনুব্রত নিজে বিষয়টিকে ‘স্লিপ অফ টাং’ বলেছেন। তাঁর দলও প্রকাশ্যে কখনও বীরভূমের এই দাপুটে নেতাকে সতর্ক করেনি। উল্টে খোদ মুখ্যমন্ত্রী একাধিক বার তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। দক্ষ সংগঠক অনুব্রতর ‘অসুস্থতা’র কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেছেন, “কেষ্টর (অনুব্রত) জন্য শেষ শক্তি পর্যন্ত থাকব।” বিরোধীদের অভিযোগ, সে জন্যই শাসকদলের এই নেতাকে ঘাঁটানোর সাহস পুলিশ দেখায়নি।

শনিবার ‘ভয়েস টেস্ট’ রিপোর্ট-এর কথা জানাজানি হতে চাপ বাড়াতে শুরু করেছে বিজেপি। এ দিন সিউড়িতে দলীয় সভায় গিয়ে বিজেপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার দাবি করেন, “এ বার অনুব্রতকে গ্রেফতার করতেই হবে।” অন্য দিকে, কসবা অঞ্চলের বিজেপি নেতা তথা নিহত সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষের বক্তব্য, “পুলিশ আর অনুব্রতকে আড়াল করতে পারবে না।”

এরই মধ্যে শুক্রবার গভীর রাতে পাড়ুই থানা এলাকার মাঠপাড়া, শিমুলিয়া গ্রামে বিজেপি নেতা-কর্মীদের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুঠপাটের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শনিবারই পাড়ুই থানায় তৃণমূলের সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফা-সহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে। শেখ মুস্তফা সাগর ঘোষ খুনে অন্যতম অভিযুক্ত। পাড়ুই থানারই মাখড়া, চৌমণ্ডলপুর ও শিরটিট্টা গ্রামে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও বিজেপি কর্মীদের খুনের ঘটনাতেও এফআইআরে তাঁর নাম রয়েছে। যদিও মুস্তফার দাবি, “বিজেপি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অভিযোগ করেছে। আমি কোনও ঘটনাতেই যুক্ত নই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anubrata mondal parui suri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE