কান্নায় ভেঙে পড়েছেন ধৃত অরজিতের দিদি শুক্লা দাস। ছবি: বিতান ভট্টাচার্য।
আইটিআই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যে ফাঁস হয়ে গিয়েছে তা পরীক্ষার আগের দিনই জানতে পেরেছিল রাজ্য পুলিশ। শুধু তাই নয়, এই কেলেঙ্কারির দুই অভিযুক্তকে কল্যাণী থানায় এনে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, অরজিৎ দাস ও তুহিন দাস নামের ওই দুই আইটিআই-ছাত্র জেরার সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এর পরেও পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার না করে ছেড়ে দিয়েছিল।
এই ঘটনার পরের দিন, ২৮ জুন, আইটিআই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে গিয়ে ১ লক্ষ ১১ হাজার পড়ুয়া জানতে পারেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়েছে। চড়া দামে ওই প্রশ্ন বাজারে বিক্রি করছে একটি চক্র। রাজ্য জুড়ে এই নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। ছাত্রদের বিক্ষোভের পরে শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায় প্রবেশিকা পরীক্ষা। ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডি-কে।
তদন্ত শুরু করার এক সপ্তাহ পরে রবিবার ও সোমবার সিআইডি গ্রেফতার করেছে সেই দুই ছাত্র অরজিৎ ও তুহিনকেই। অরজিৎ কল্যাণীর বাসিন্দা, তুহিন রানাঘাটের। তদন্তকারীদের অভিযোগ, এই দুই ছাত্রই প্রশ্নফাঁস করার চক্রের সঙ্গে যুক্ত। অরজিৎকে সোমবার বারাসত আদালতে পেশ করে তাঁকে আট দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে সিআইডি। তুহিনকে আজ, মঙ্গলবার আদালতে তোলা হবে। সোমবার রাতে সিআইডি কল্যাণী থেকে বাপ্পা পাইন নামের আর এক যুবককে গ্রেফতার করেছে। অরজিৎ ও তুহিনের দাবি, তারা বাপ্পার কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পেয়েছিল। আজ, মঙ্গলবার, বারাসত আদালতে তোলা হবে বাপ্পাকেও।
তবে সিআইডি-র হাতে অরজিৎ ও তুহিনের গ্রেফতারের ঘটনাটি রাজ্য পুলিশের একটি অংশকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পুলিশের একটি অংশের বক্তব্য, অরজিৎ এবং তুহিনকে জিজ্ঞাসাবাদের পরে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে চক্রের মূল পাণ্ডাদের গ্রেফতার করা অনেক সহজ হতো। তাতে রাজ্য সরকারের মুখ এ ভাবে পুড়ত না। সিআইডি-র একটি অংশ বলছে, অরজিৎ-তুহিন জেরায় স্বীকার করেছেন, তাঁরা কোথা থেকে প্রশ্নপত্র পেয়েছেন তা ওই দিন থানায় জিজ্ঞাসাবাদের সময়েই জানিয়ে দিয়েছিলেন। সিআইডি-র এক কর্তা এ দিন বলেন, ‘‘এর পরেও কেন যে তাঁদের দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হল, তা বুঝতে পারছি না।’’
রাজ্য পুলিশের একটি অংশ অবশ্য এই ঘটনার দায় চাপিয়ে দিয়েছে এলাকায় শাসক দলের এক প্রভাবশালী নেতার ঘাড়ে। তাদের বক্তব্য, ওই দু’জনকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ফোন করে চাপ দিতে থাকেন ওই নেতা। কল্যাণী থানার পুলিশও তাঁর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নেয়। কেন পুলিশ এই কাজ করল? এ ব্যাপারে নদিয়া জেলার পুলিশ সুপার ভরতলাল মিনা বলেন, ‘‘আমি বিষয়টি জানতাম না। তবে ধরার পরেও কেন অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়া হল, তা খতিয়ে দেখা হবে।’’
তবে এই প্রশ্নফাঁস কেলেঙ্কারির সঙ্গে যে বড় ধরনের একটি চক্র জড়িত, তার আভাস প্রাথমিক তদন্তেই পেয়েছেন সিআইডি-র গোয়েন্দারা। সিআইডি সূত্রের খবর, রীতিমতো ‘মার্কেটিং চেন’ তৈরি করার মতো করে আইটিআই প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে। পরিকল্পনা মাফিক রাজ্যের প্রতিটি জেলাতেই ছিল ওই চক্র এক জন করে প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে একটি চক্র। গত ২৪ ঘণ্টায় আইটিআই-এর দুই ছাত্রকে গ্রেফতার করার পরে এই তথ্য সামনে এসে পড়ছে।
দুই ছাত্রকে জেরা করার পরে সিআইডি জানিয়েছে, ওই দু’জনের দায়িত্ব ছিল নদিয়া জেলার পরীক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেওয়া। দু’জনেই জেরায় জানিয়েছেন, নির্দেশমতো তাঁরা পরীক্ষার দু’দিন আগেই বেশ কয়েক জনের কাছে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দিয়েছিলেন। গোয়েন্দাদের দাবি, জেরায় জানা গিয়েছে, ওই দু’জনে মিলে প্রায় ২০ জন পরীক্ষার্থীর কাছে ওই প্রশ্নপত্র বিক্রি করেছিলেন। একেক জনের কাছে থেকে তাঁরা প্রশ্নপত্র বাবদ পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। প্রাথমিক ভাবে গোয়েন্দাদের দাবি, কল্যাণীর কোনও কেন্দ্র থেকেই প্রথম ওই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। সেখান থেকেই কিছু প্রশ্ন যায় উত্তর ২৪ পরগনাতে।
কিন্তু কী ভাবে আইটিআই প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পেলেন এই দু’জন? সিআইডির দাবি, ধৃত দু’জনেই জেরায় জানিয়েছেন, ওই এলাকার এক যুবকের কাছ থেকে তাঁরা ওই প্রশ্ন পেয়েছিলেন। তদন্তকারীদের বক্তব্য, এই যুবকই এই চক্রের নদিয়া জেলার প্রতিনিধি। তাঁর খোঁজ শুরু করেছে পুলিশ। তদন্তকারীদের অনুমান, ওই চক্রের মাথাও নদিয়া জেলাতেই রয়েছেন। তাঁর নির্দেশেই প্রতি জেলাতেই একজন করে প্রতিনিধি রাখা
হয়েছিল। এই প্রতিনিধিরাই তাঁদের পরিচিত ছাত্রদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন বলে তদন্তকারীদের দাবি।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, কোন কোন জেলায় কারিগরি শিক্ষা দফতরের কার কার দায়িত্বে প্রশ্নপত্র ছিল সেটা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলা গেলেই পুরো চক্রটি সামনে আসবে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। সিআইডির এক কর্তা বলেন, ‘‘সবে তদন্ত শুরু হয়েছে। কানের টান পড়েছে। চক্রের মাথাকে ধরতে গেলে আরও সময় লাগবে।’’
সিআইডি জানিয়েছে, অরজিৎ কল্যাণী আইটিআই-র প্রথম বর্ষের ছাত্র। কল্যাণী মাঝেরচরে দু’কামরার টিনের ঘরে দুই ভাই, মা, দিদি-জামাইবাবু, তাঁদের এক ছেলে নিয়ে তাঁদের টানাটানির সংসার। অরজিতের বাবা মারা গিয়েছেন আট বছর আগে। মা কল্যাণী আইটিআই মোড়ে রাস্তার ধারে উনুন পেতে ভুট্টা বিক্রি করেন। হাতখরচের টাকার জন্য কেটারিং-এর কাজ ও চা বিক্রি করেন অরজিৎ। গোয়েন্দারা জানান, অরজিৎ প্রশ্ন বিক্রি করার টাকা চেয়ে এক পরীক্ষার্থীকে হুমকি দিয়েছিলেন। সেই কলটি রেকর্ড করে রাখেন ওই পরীক্ষার্থী। সেটি গোয়েন্দারা পেয়েছেন।
এ দিন এলাকায় গিয়ে অরজিতের খোঁজ করায় স্থানীয় বাসিন্দা বরুণ দাস বলেন, ‘‘আপনি কি পাওনাদার? অনেক টাকা চোট হয়েছে?’’ বিশদে জানতে চাইলে বরুণবাবুর বক্তব্য, ‘‘একটি ছোট চিটফান্ড সংস্থার এজেন্ট হয়েছিল অরজিৎ। কিন্তু উঠে যাওয়ার পরে অনেকে টাকার জন্য ওকে চাপ দিচ্ছিল।’’ অরজিতের দিদি শুক্লাও স্বীকার করেছেন ওই হুমকি ফোনের কথা। তিনি বলেন, ‘‘বন্ধুদের সঙ্গে মজা করতে গিয়েই গালিগালাজ করতে করতে ভাই বলেছিল, প্রশ্নপত্র যদি দিতে পারি তা হলে ৮ হাজার টাকা দিবি না কেন?’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘বন্ধুরাই ওকে ফাঁসিয়েছে। কারণ ও আগে স্থানীয় ক্লাব, তৃণমূল পার্টি অফিসে যেত। এখন পড়াশোনায় মন দিয়েছিল বলে কয়েক জন বন্ধু ওকে বলেছিল, এর জন্য পস্তাতে হবে।’’ শুক্লা বলেন, ‘‘গত শনিবার সন্ধ্যায় বাবাই নামে একজন ফোন করে ভাইকে বলেছিল, সিআইডি ওর খোঁজ করছে। ভাই খুব ভয় পেয়েছিল। আমি কল্যাণীর একটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করি। সেখানেই ভাইকে লুকিয়ে রেখেছিলাম।’’ অরজিৎকে কেউ ফাঁসিয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় তৃণমূল ছাত্র নেতা সৌরিক মুখোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘‘প্রথম যখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি আমার নজরে আসে তখনই প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম। অরজিৎ কোনও ভাবে ফেঁসে থাকতে পারে। এর পিছনে যে মাথারা আছে তাদের ধরা দরকার।’’ প্রশ্ন ফাঁসে বার বার শাসকদলের নাম উঠছে কেন? তা হলে কি তৃণমূলের ছাত্রনেতারাও এতে জড়িত? দলের এক শীর্ষ নেতার অবশ্য পাল্টা দাবি, দলের ছাত্রনেতারা তৎপর হয়েছিলেন বলেই আইটিআই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy