Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

আইপিএল, আইপিএল

সন্ধে নেমে গিয়েছে, বেপাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফিরছি। হঠাৎ কানে এল হই চই। সামনেই একটা ক্লাব ঘরে জনা কুড়ি কমবয়সি ছেলে হল্লা করছে। ক্রিকেট। মাঠ হোক আর টিভি হোক, চলতি পথে ক্রিকেটের গন্ধ পেলে থমকে দাঁড়ানো বাঙালির চিরকেলে অভ্যেস। আমিও দাঁড়ালাম। এলসিডি স্ক্রিনে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স আর কলকাতা নাইট রাইডার্সের খেলা চলছে। এক্ষুনি কলকাতার একটা বাউন্ডারি হয়ে গেল, তারই উল্লাস। মুহূর্তে আমিও তাদের দর্শকতুতো দাদা হয়ে উঠলাম।

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১৬
Share: Save:

সন্ধে নেমে গিয়েছে, বেপাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফিরছি। হঠাৎ কানে এল হই চই। সামনেই একটা ক্লাব ঘরে জনা কুড়ি কমবয়সি ছেলে হল্লা করছে। ক্রিকেট। মাঠ হোক আর টিভি হোক, চলতি পথে ক্রিকেটের গন্ধ পেলে থমকে দাঁড়ানো বাঙালির চিরকেলে অভ্যেস। আমিও দাঁড়ালাম। এলসিডি স্ক্রিনে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স আর কলকাতা নাইট রাইডার্সের খেলা চলছে। এক্ষুনি কলকাতার একটা বাউন্ডারি হয়ে গেল, তারই উল্লাস। মুহূর্তে আমিও তাদের দর্শকতুতো দাদা হয়ে উঠলাম। একটা সিঙ্গল দিয়ে ওভার শেষ হল, কমার্শিয়াল ব্রেক। সঙ্গে সঙ্গে এক জন রিমোট টিপে চ্যানেল বদলে ফেলল। এ বার একটি নিউজ চ্যানেল, ভোট নিয়ে জোর তরজা চলছে। চার দলের চার জন লড়াকু প্রতিনিধি আসর রীতিমতো গরম করে ফেলেছেন। প্রত্যেকেই অন্যের দিকে আঙুল তুলে তুমুল চিৎকার করে চলেছেন। ফলে কারও কথাই স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে না। এই কাকস্য ক্যাকোফোনির উপরে গলা তুলে অ্যাঙ্কর বলছেন ‘নিয়ে নেব একটা ছোট্ট বিরতি।’ এটা শোনা মাত্রই আবার চ্যানেল ঘুরিয়ে ফিরে গেল ম্যাচে। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি চোখেমুখে রোমাঞ্চ নিয়ে আমায় বলল, ‘খেলা পুরো জমে গিয়েছে দাদা।’

আবার ধরলাম বাড়ির পথ। পাড়ায় ঢুকতে ঢুকতে হঠাৎ মনে হল, কোন খেলার কথা বলল ছেলেটি? আইপিএল না ভোট? মজা হচ্ছে, দু’ক্ষেত্রেই কথাটা সমান প্রযোজ্য। ভেবে দেখতে গেলে, আইপিএল আর ভোটের ছকটা মোটামুটি এক। তফাত কিছু একটা আছে ঠিকই, তবে মিলই বেশি। প্রধানতম মিল বিনোদন। আসলে যাকে ক্রিকেট বলে, সে-জিনিস এখন মোটামুটি জাদুঘরে। শেষ দেড় দশকে ক্রিকেট মানে অন্ধের মতো ব্যাট চালানো আর যে ভাবে হোক স্কোর বোর্ডে দৌড় চালু রাখা। একটা বল ব্লক করার মধ্যে যে আভিজাত্য বা ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে যে রাজকীয়তা, আজকের ক্রিকেটীয় পরিভাষায় তার কোনও জায়গা নেই। মানুষ উত্তেজনা চায়, তাই পেটাও। এই কারণে আইপিএল-এর চরম বোলবোলাও।

আপাতত ভোটও তাই। রাজনৈতিক মতাদর্শ বা তাত্ত্বিক তর্কের অবকাশ নেই, সে সব করার মতো লোকও নেই। বরং চার জন লোক যদি বসে চূড়ান্ত ঝগড়াঝাটি করতে থাকে, খেলা জমবে। উত্তেজনায় সস্তা সুড়সুড়ি দেওয়া অভব্য খেউড়ের বন্যা বইয়ে দিতে পারলেই টিআরপি চড়চড় করে চড়বে। চ্যানেল তোমাকে দশ ওভার দিয়েছে, তার মধ্যে বল ব্লক করলে দলও তোমায় ব্লক করবে। অতএব আস্তিন গুটিয়ে হুক করো। ব্যাকরণের বাইরে মেরে বাউন্ডারি পার করে দাও। আইপিএল তবু ক্রিকেটের একটা বেসিক নিয়ম এখনও ভাঙেনি। সেটা হল এই যে, এক দল যখন ব্যাট হাতে ছত্রখান করে দিচ্ছে। আর এক দল দাঁতে দাঁত চেপে হলেও দশ ওভার বোলিং কমপ্লিট করছে। এক ওভারে তিনটে চার আর দু’টো ছয় খাওয়ার পর ব্যাট হাতে ‘দাঁড়া তো দেখাচ্ছি মজা!’ বলে নেমে পড়ছে না। একটা ন্যূনতম চক্ষুলজ্জা থেকেই বোধ হয় আইপিএল কর্তৃপক্ষ এখনও এইটুকু ক্রিকেটসুলভ সৌজন্য বজায় রেখেছে। আমাদের রাজনীতি সে সবের ধার ধারে না। প্রত্যেকে একই সঙ্গে প্রত্যেককে গালিগালাজ করে চলেছে। দর্শক জমিয়ে বসে দেখছে, চার জন মানুষ কী চরম দাঁত নখ বের করে একে অপরকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে। নিজের কাজের খতিয়ান বলতে কিস্যু নেই। বাকিরা কতটা অধম, কতটা শঠ ও নীচ, পারলে মেরে ধরে হলেও সেটা প্রতিষ্ঠা করা। নিজেদের পকেটের কাদা অন্যের মুখে ছুড়ে মারার খেলা। এই তো আদিম বিনোদন। আইপিএল-এর সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্য এই চরম অশিক্ষিতপনা না থাকলে চলবে না। মিল আরও আছে। উত্তেজনার পারদ আরও একটু উস্কে দেওয়ার জন্য দু’পক্ষের চিয়ার লিডার্স। চার বা ছয় হলেই এই দলের চিয়ার লিডাররা শরীর কাঁপিয়ে নাচছেন, আউট হলে ওই দলের চিয়ার লিডাররা বিভঙ্গের ফোয়ারা ছোটাচ্ছেন। এও সেই আদিম বিনোদনেরই অঙ্গ। ইদানীং আমাদের রাজনীতিতেও চিয়ার লিডারদের ভূমিকা ভালই। চার ছয় এবং আউটের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরও নাচতে দেখা যাচ্ছে। মাঠে না নেমেও উত্তেজনা ছড়ানোয় দিব্যি সফল। প্রত্যেক দলেরই নিজ নিজ চিয়ার লিডারগণ আছেন, তাঁরা আবার মাঝে মধ্যে দলও পাল্টান।

তবে সেরা মিল বোধ হয় অন্য দু’জায়গায়। নিলাম এবং ফিক্সিং। প্রত্যেক সিজন-এর আগেই খেলোয়াড়দের বেচাকেনা চলে। ক্রিকেটাররা বিক্রি হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকেন, তাঁদের দাম হাঁকা হয় এবং শেষমেশ একটা চড়া দামে রফা হয়। আগের সিজন-এ যিনি হয়তো চেন্নাই সুপার কিংস-এর হয়ে চার-চারটে সেঞ্চুরি করেছিলেন, এই সিজন-এ তাঁকেই দেখা যাবে দিল্লি ডেয়ার ডেভিলস্-এর ক্রিজে ঝড় তুলতে। এর মধ্যে কোনও অনৈতিকতা নেই। কারণ, আইপিএল টাকার উপর দাঁড়িয়ে আছে। এবং ক্রিকেটাররাও পেশাদার। তাই কেনাবেচা প্রকাশ্যেই হয়ে থাকে। ভারতীয় রাজনীতি এই দিক থেকে আইপিএল-এর গুরুস্থানীয়। কারণ, সিজন-এর আগে নিলাম এতটাই গোপনে হয় যে যিনি বিক্রি হন তিনি নিজেও অনেক সময় বুঝতে পারেন না। আর ফিক্সিংয়ের কথা না বলাই ভাল। লোকাল কমিটি থেকে গ্লোবাল কমিটি পর্যন্ত ফিক্সিং এখন একটা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে। সে সবের সামনে শ্রীনি নেহাতই মিনি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই যে ভারতীয় রাজনীতি নিয়ে এত অভিযোগ, এতে শেষমেশ হবেটা কী? সব কিছুকে সারাক্ষণ নস্যাৎ করে দিতে থাকলে তো গ্রহণযোগ্য পথও বাতলাতে হবে এক খানা। রাজনীতির সবটাই খারাপ বলে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকলে কোন উপকারটা হবে? মুশকিলটা এই যে, আমরা ভারতের আম নাগরিকরা, কিন্তু মুখ ফেরাইনি এখনও। রাজনীতি থেকেও অনেক বেশি করে বিনোদনের খাতিরেই মুখ ফেরাইনি। কিন্তু মুখ খুলিওনি। বাড়িতে, ক্লাবে, রকে বসে সমালোচনায় ধুইয়ে দিয়েছি, কিন্তু কখনও কোনও রাজাকেই প্রশ্ন করিনি, ‘তোর কাপড় কোথায়?’ কারণ, প্রশ্ন করার জন্য একটা শিরদাঁড়া লাগে। আমাদের অভিযোজন হতে হতে শিরদাঁড়াটা ক্ষয়ে গিয়েছে, চিতা শুধু পড়ে থাকে তার। তাই যুগের পর যুগ ধরে আমরা টিভির সামনে, জীবনের সামনে, সময়ের সামনে হাঁ করে বসে থেকেছি কেবল দর্শকের ভূমিকা পালন করব বলেই। কখনও প্রশ্ন করিনি, যেখানে অসংখ্য মানুষ পানীয় জলটুকুও পান না, সেখানে নির্বাচনী প্রচার সভায় কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে কী ভাবে? কারণ, সেই বিনোদন। টাকা না উড়লে রাধা নাচবে কেমন করে?

আমরা মেনে নিয়েছি, মানিয়ে নিয়েছি। নিজেদের এমন ভাবে বুঝিয়ে নিয়েছি, যেন বাস্তব আসলে কল্পনারই একটা অংশ। আমরা দিব্যি বিশ্বাস করে নিয়েছি জাক কালিস কলকাতার, মুনমুন সেন বাঁকুড়ার, বাপ্পি লাহিড়ী শ্রীরামপুরের, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের। আমরা বরাবরই অতিথিপরায়ণ, তাই মুহূর্তে আপন করে নিতে আমাদের সময় লাগে না। কেবল অসুবিধে হয় ডিরোজিও বা নিবেদিতাকে নিজেদের বলে মেনে নিতে। হাজার হাজার বছর পাশাপাশি থাকার পরও অন্য ধর্মের বন্ধুকে মেনে নিতে। অসুবিধে হয় এই কথাটা স্বীকার করতে, আমরা প্রত্যেকেই এখন জড়।

সুতরাং, খেলা পুরো জমে গিয়েছে। এ খেলার কোনও মার নেই। বিজ্ঞাপনের বন্যায় ভেসে যাওয়া বিনোদনের ভেলায় ভেসে চলেছে আমাদের সাপে কাটা লাশ। কোন কিনারায় গিয়ে ঠেকবে কেউ জানে না। তত দিন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর সত্যি খেউড়ের মাঠে আইপিএল তার কব্জির জোর ফলিয়ে যাবে। সাদা জার্সির শান্ত অভিজাত ক্রিকেটের পাশেই দেখা যাবে শিক্ষিত, মার্জিত রাজনীতির সমাধি। কারণ, ভারত এখন দু’খানা আইপিএল নিয়ে আত্মহারা। যার একটার নাম ইন্ডিয়ান পার্লামেন্ট লিগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

srijata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE