Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আবার আইনে বদল, উপাচার্য নিয়োগে নিয়ন্ত্রণ বাড়াল রাজ্য

রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের পথ আরও প্রশস্ত হল। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় আইনে তৃতীয় পরিমার্জনটি বিধানসভায় পাশ করল রাজ্য সরকার। সেখানে বলা হয়েছে, উপাচার্য বাছাইয়ের সার্চ কমিটিতে আচার্য কাকে সদস্য মনোনীত করবেন, তা ঠিক করতে হবে মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই। এতে কি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সরকারের নিয়ন্ত্রণই আরও জোরদার করা হল না? বিধানসভার বাইরে প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কবুল করেন, “আমরা মনে করি তা-ই (নিয়ন্ত্রণ) থাকা দরকার। সরকার আর দল এক নয়!”

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৪ ০২:৫৫
Share: Save:

রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের পথ আরও প্রশস্ত হল।

বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় আইনে তৃতীয় পরিমার্জনটি বিধানসভায় পাশ করল রাজ্য সরকার। সেখানে বলা হয়েছে, উপাচার্য বাছাইয়ের সার্চ কমিটিতে আচার্য কাকে সদস্য মনোনীত করবেন, তা ঠিক করতে হবে মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই।

এতে কি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সরকারের নিয়ন্ত্রণই আরও জোরদার করা হল না? বিধানসভার বাইরে প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কবুল করেন, “আমরা মনে করি তা-ই (নিয়ন্ত্রণ) থাকা দরকার। সরকার আর দল এক নয়!”

বিষয়টি আর একটু বিশদে বলার জন্য অনুরোধ করাতে অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বাছাই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা ঠেকাতেই মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার শর্ত ঢোকানো হয়েছে বিলে। যদিও বিল-এর ‘স্টেটমেন্ট অব অবজেক্টস অ্যান্ড রিজন্স’-এ (লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য) কিন্তু এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।

গত আড়াই বছরে এই নিয়ে তিন-তিন বার বিশ্ববিদ্যালয় আইনে পরিমার্জন আনল রাজ্য। ২০১১-য় ক্ষমতায় এসেই তৃণমূল সরকার আইনটি ঢেলে সেজেছিল। সেই সময়ই ঠিক হয়েছিল, উপাচার্য বাছাই করা হবে তিন সদস্যের সার্চ কমিটি মারফত। ঠিক হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), আচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মনোনীত তিন জন সদস্য কমিটিতে থাকবেন। কিন্তু ২০১২ সালেই ফের সংশোধনী এনে ইউজিসি-র সদস্যের জায়গায় ঢোকানো হয় রাজ্য সরকার মনোনীত সদস্যের নাম। এর মধ্য দিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা হচ্ছে বলে তখনই বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। সরকারের তরফে তখন বলা হয়েছিল, এক জন সরকারি প্রতিনিধি রাখার মানে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা নয়। কারণ কমিটির বাকি দুই সদস্যের মনোনয়নে রাজ্য সরকারের সরাসরি হাত নেই। এখন এই তৃতীয় পরিমার্জনের পরে কিন্তু কার্যত উপাচার্য বাছাই পর্বটি পুরোটাই রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে এল।

প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, বাম আমলে যেমন শিক্ষা জগতের নিয়োগ পর্বের উপরে আলিমুদ্দিন ছড়ি ঘোরাত, এই আমলে সেই কাজটা তৃণমূল করতে চাইছে সরকারি বকলমে। আইআইএম কলকাতার অর্থনীতির শিক্ষক অনুপ সিংহ যেমন এ দিন সখেদে বলছিলেন, “শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সরকার নিয়ন্ত্রণ চায়। উনি না বললেও সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এতে ওঁদের স্বল্পমেয়াদি লাভ হতে পারে, কিন্তু শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে।”

অথচ ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, শিক্ষাক্ষেত্রকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করা হবে। সেই লক্ষ্যেই উপাচার্য বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু আড়াই বছরের মধ্যেই তা কার্যত ‘পুনর্মূষিক ভব’র রূপ নিয়েছে বলে শিক্ষা জগতের অধিকাংশেরই মত। বাম আমলে উপাচার্য বাছাই হতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা কোর্ট বা সেনেট-এর মাধ্যমে। তখন অহরহ অভিযোগ উঠত যে, সেনেটে বাম-ঘনিষ্ঠ প্রতিনিধিরাই সর্বেসর্বা। তাঁরাই পার্টির কথা শুনে ঠিক করতেন, কে উপাচার্য হবেন। এর পর সেনেট ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে তিন সদস্যের নাম পাঠানো হতো আচার্য তথা রাজ্যপালের কাছে। তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই উপাচার্য নিয়োগ করতেন। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ঘরানার নিয়োগ-পদ্ধতিই ‘অনিলায়ন’ নামে পরিচিত ছিল।

এ দিন যখন বিধানসভায় বিরোধীরা নতুন বিলটি নিয়ে সরব হন, তখন সিপিএম বিধায়কদের দিকে তাকিয়ে শিক্ষামন্ত্রী সেই স্মৃতিই উস্কে দিয়ে বলেন, “আপনাদের তো পার্টি অফিস থেকে সব বলে দিত, সেই মতো হতো। আমাদের তো তা নয়। তাই আইনের দরকার হচ্ছে।”

শিক্ষামন্ত্রীর এই মন্তব্যের ব্যাপারে বিরোধী নেতাদের একাংশ বলছেন, পার্থবাবুর কথা থেকেই স্পষ্ট, ওঁরা শুধু দলীয় নির্দেশ পাঠিয়েই নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। তাই একেবারে আইন করে রাশ হাতে নিতে চাইছেন। আবার অনেকের মতে, এখন কেন্দ্রে বিজেপি সরকার। সেই সরকার যাঁকে রাজ্যপাল হিসেবে পাঠাবে, পদাধিকারে তিনিই হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। সেই আচার্যের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও বিলে এই সংশোধনী আনা জরুরি মনে করেছে রাজ্য।

শিক্ষামন্ত্রী নিজে অবশ্য বারবার দাবি করছেন, উপাচার্য নিয়োগে স্বচ্ছতা ও দ্রুততার স্বার্থেই আইন বদলানো হয়েছে। পাশাপাশি এই সংশোধনীতে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটির তিন সদস্য উপাচার্য বা কোনও কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা বা অধ্যাপক পদমর্যাদার থেকে কম হতে পারবেন না। বিলের ‘স্টেটমেন্ট অব অবজেক্টস অ্যান্ড রিজন্স’-এও সেটাই উদ্দেশ্য হিসেবে সামনে রাখা হয়েছে। যদিও তাতে বিতর্ক থামেনি। এ দিন বিধানসভায় এসইউসি-র বিধায়ক তরুণ নস্কর প্রশ্ন তোলেন, আড়াই বছরের মধ্যে একই আইনে এতগুলি পরিবর্তনের কারণ কী?

নতুন আইনের সমালোচনা করে প্রাক্তন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীও পরে বলেন, “আচার্যের মতো সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে থাকা কাউকে মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সদস্যের নাম মনোনীত করতে হবে কেন? এটা তো সৌজন্য বিরোধী।” কিন্তু তাঁদের সময়েও তো উপাচার্য নিয়োগের সময় মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে হত আচার্যকে। সেটা সৌজন্য বিরোধী ছিল না? সুদর্শনবাবুর জবাব, “আচার্য চাইলে আলোচনা করতেই পারেন। আমায় কখনও ডাকেননি।”

সিপিএম নেতারা যাই বলুন, শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকের অভিজ্ঞতাই বলছে, কার্যক্ষেত্রে সিপিএমের জুতোয় পা গলিয়েই হাঁটা শুরু করেছে তৃণমূল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভর্তি, পরীক্ষা, ফল প্রকাশ, ছাত্র সংসদ নির্বাচন সবেতেই টিএমসিপি-র দাদাগিরি মনে করাচ্ছে বিগত জমানাকেই। বাম আমলের মতোই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট-ইসিতে শাসক ঘনিষ্ঠদের বসানোর অভিযোগ উঠছে বর্তমান শাসক দলের বিরুদ্ধে। আইএসআই-এর শিক্ষক অভিরূপ সরকার তাই মনে করছেন, “আইন সংশোধন হোক না হোক, সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে কোনও ভাবেই তা আটকানো যায় না।”

সরকার যে নিয়ন্ত্রণ চায়, সেটা তো বলেই দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। এ দিন রাতে ফোনে পার্থবাবুকে ফের প্রশ্ন করা হয়, তাঁরা কি তবে অনিলায়নের পথই নিলেন? উত্তর না দিয়েই ফোনটা রেখে দেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

vicechancellor westbengal universities
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE