Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
নজরবন্দি মন্ত্রীমশাই

ইডি ডাকতে পারে তৃণমূল নেতাদেরও

সারদার বেপাত্তা অর্থের হদিশ পেতে তৃণমূলের একাধিক নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ইঙ্গিত দিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বুধবার সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পিয়ালি সেন ও প্রথম পক্ষের ছেলে শুভজিৎ সেনকে গ্রেফতার করার পর থেকে তাঁদের জেরা করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে বলে ইডি সূত্রের খবর। উঠে এসেছে রাজ্যের শাসক দলের বেশ কয়েক জন নেতা, এমনকী গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর নামও। ওই নেতা-মন্ত্রীদের ডেকে পাঠিয়ে জেরা করার কথা ভাবছেন ইডি-কর্তারা।

বীরভূমে ভোট প্রচারে যাওয়ার আগে মালদহ বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

বীরভূমে ভোট প্রচারে যাওয়ার আগে মালদহ বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:০৮
Share: Save:

সারদার বেপাত্তা অর্থের হদিশ পেতে তৃণমূলের একাধিক নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ইঙ্গিত দিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বুধবার সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পিয়ালি সেন ও প্রথম পক্ষের ছেলে শুভজিৎ সেনকে গ্রেফতার করার পর থেকে তাঁদের জেরা করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে বলে ইডি সূত্রের খবর। উঠে এসেছে রাজ্যের শাসক দলের বেশ কয়েক জন নেতা, এমনকী গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর নামও। ওই নেতা-মন্ত্রীদের ডেকে পাঠিয়ে জেরা করার কথা ভাবছেন ইডি-কর্তারা।

এ রাজ্যে ভোট হয়েছে মাত্র এক দফা। মোট ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৮টিতেই ভোটগ্রহণ এখনও বাকি। ২৪ তারিখ দ্বিতীয় দফা ভোটের আগের দিনই সুপ্রিম কোর্টে সারদা মামলার শুনানি। এই অবস্থায় ইডি যে ভাবে সক্রিয় হয়েছে, এবং তাতে যে ভাবে দলের নেতাদের নাম উঠে আসছে, তাতে বেশ অস্বস্তিতে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব।

সারদা-কাণ্ডে তৃণমৃল নেতাদের নাম জড়ানোটা অবশ্য নতুন ঘটনা নয়। এক বছর আগে গা-ঢাকা দেওয়ার আগে সিবিআই-কে সুদীপ্ত সেন যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে একাধিক তৃণমূল নেতার নাম ছিল। এর পর গত নভেম্বরে গ্রেফতার হন তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ। আদালত চত্বরে একাধিক বার তিনি সারদার সঙ্গে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু সুদীপ্ত ও কুণাল যে সব রাজনীতিকের নাম করেছিলেন, তাঁদের কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেনি সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজ্যের তৈরি করা বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)।

ইডি সূত্রে বলা হচ্ছে, সারদার টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়েছে, তা খুঁজে বার করার জন্য এই রাজনীতিকদের জেরা করাটা অত্যন্ত জরুরি। রাজ্য সরকার সারদার ব্যাপারে যে কমিশন গঠন করেছে তার ৯টি বিচার্য বিষয়ে মধ্যে ৪ নম্বরটি হল, সারদা কাণ্ডের জন্য যারা দায়ী তাদের খুঁজে বের করা। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে সিট তাদের সাহায্য করবে। অথচ বছর ঘুরতে চললেও সিট সম্ভাব্য দায়ী ব্যক্তিদের কোনও তালিকা কমিশনকে পাঠায়নি। সিট কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে এই তদন্ত ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল কিনা, ইডি সূত্রে এমন প্রশ্নও তোলা হয়েছে।

এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্তের রাশ কার্যত হাতে নেওয়ার পরে মদনবাবু ছাড়াও তৃণমূলের রাজ্যসভার একাধিক সাংসদ, এক জন লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী এবং কলকাতার একটি নামজাদা ফুটবল ক্লাবের কর্মকর্তাকে নোটিস পাঠানো হতে পারে বলে ইডি সূত্রের খবর। যদিও সরকারি ভাবে ইডির তরফে এখনও এমন নোটিস পাঠানোর সম্ভাবনার কথা স্বীকার করা হয়নি। সুদীপ্তর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেবির কয়েক জন কর্তা সারদার বিরুদ্ধে তদন্ত ধামাচাপা দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। জেরার মুখে এমন অভিযোগ করেছেন পিয়ালিদেবী। তাঁর সে অভিযোগও খতিয়ে দেখছে ইডি।

সুদীপ্ত সেনের স্ত্রীকে বৃহস্পতিবার রাতভর জেরা করে কী কী তথ্য পেয়েছেন ইডির তদন্তকারীরা?

ইডির একটি সূত্রের বক্তব্য, আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মোট ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে, এমন ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করেছিল সিট। কিন্তু জেরায় পিয়ালি বলেছেন, সারদার কোনও টাকা বিদেশে পাঠানো হয়নি। সুদীপ্তের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন রাজ্যের কয়েক জন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং সেবির কয়েক জন কর্তা। তাঁরা একটা সময়ে এত টাকা দাবি করতে থাকেন যে, সুদীপ্ত মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। এমনকী, এক সময়ে আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলেন।

পিয়ালিদেবীর জিজ্ঞাসাবাদে রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর নামও বারবার উঠে এসেছে বলে জানাচ্ছেন ইডির তদন্তকারী অফিসারেরা। তাঁরা বলছেন, গত আট মাস ধরে বিধাননগর কমিশনারেট এলাকার মধ্যে বসবাস করছিলেন পিয়ালিদেবী। তা সত্ত্বেও তাঁকে সিট কেন ধরতে পারল না, সেটাই প্রশ্ন। পিয়ালিদেবীকে না-ধরার জন্য সিটের উপরে কোনও চাপ ছিল কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইডির এক তদন্তকারী এ দিন বলেন, “রাজ্যের এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরাই পিয়ালিদেবীর বাগুইআটির বাড়ি খুঁজে দিয়েছিলেন বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে। ওই মন্ত্রীর সঙ্গে সারদার সম্পর্ক নিয়ে গত দু’বছর ধরেই অভিযোগ উঠেছে। সারদার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি কখনও সভাপতি, কখনও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন।” ইডির ওই সূত্রের আরও দাবি, ওই মন্ত্রীই সুদীপ্ত সেনের জামিনের ব্যাপারে এক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন।

কুণাল ঘোষ যে হেতু একাধিক বার সারদার সঙ্গে মদন মিত্রের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন এবং তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবি তুলেছেন, সে হেতু ইডির সন্দেহের তালিকায় থাকা মন্ত্রী তিনিই কিনা, নানা মহলে সেই গুঞ্জন উঠেছে। মদনবাবু অবশ্য এ দিন জোর গলায় বলেছেন, “পিয়ালিকে আমি চিনতামই না। তিনি যে সুদীপ্ত সেনের স্ত্রী তা মাত্র দু’দিন আগে খবরের কাগজ পড়ে জেনেছি। আমার নাম কেন উঠে আসছে, তা বুঝতে পারছি না। তবে যে কোনও জিজ্ঞাসাবাদের সামনে হাজির হতে আমি রাজি।”

সারদার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও রকম সম্পর্কের কথা এ দিন অস্বীকার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নলহাটির জনসভায় তিনি বলেন, “কারও কাছে এক পয়সা নিয়ে রাজনীতি করি না। চিট ফান্ডের টাকা সিপিএম-কে নিতে হয়। চিট ফান্ড আমাদের আমলে হয়নি। ৩০ বছর আগে সিপিএমের আমলে হয়েছে। মিথ্যা কথা বলার একটা লিমিট আছে। সব প্রমাণ করে দেব।”

যার উত্তরে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর মন্তব্য, “কিছু বললেই বলেন, বাম আমলে হয়েছিল। বাম আমলে কিছু চিট ফান্ড হয়েছে, তার পরেও হয়েছে। সিবিআই তদন্তে সবটাই দেখা হোক। বামপন্থীদের কেউ দোষী হলে তাকে ধরে জেলে পোরা হোক! বামপন্থীরা তো সিবিআই-কে ভয় পাচ্ছে না। ওঁদের এত আপত্তি কীসের?” সিবিআই তদন্তের দাবিই ফের জোরালো করতে চেয়ে বিমানবাবু এ দিন আরও বলেছেন, “কুণাল ঘোষ যা বলেছেন, সিবিআই তদন্ত হলে কান টানলে মাথা আসবে। তৃণমূল দলের সঙ্গে দহরম-মহরম কী ভাবে ছিল, উদঘাটিত হবে। রাজ্য সরকার তাই প্রকৃত তদন্ত এড়িয়ে যাচ্ছে।” আর শ্রীরামপুরের সভায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, “সততার প্রতীক এখন সারদার প্রতীক!”

ভোটবাজারে সারদা নিয়ে বিরোধীদের প্রচার যে তাঁদের অস্বস্তিতে ফেলতে পারে, তা কবুল করছেন তৃণমূলের অনেক শীর্ষ নেতাই। তাঁদের দাবি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই এই সময়ে ইডি-কে সক্রিয় করা হয়েছে।

কিন্তু রাজ্য সরকারের তৈরি করা সিট যে ভাবে সারদা মামলা থেকে পিয়ালিদেবী ও শুভজিতের নাম বাদ দিয়েছিল, তা নিয়েই আবার প্রশ্ন তুলেছেন ইডির কর্তারা। সারদার কর্মীদের প্রাপ্য অর্থ জমা না-করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিল প্রভিডেন্ট ফান্ড দফতর। এই মামলায় সুদীপ্ত ছাড়াও অভিযুক্ত ছিলেন পিয়ালি ও শুভজিৎ। চার্জশিটেও ওই দু’জনের নাম ছিল। কিন্তু পরে অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়।

বিধাননগর কমিশনারেটের তদন্তকারী কর্তাদের অবশ্য যুক্তি, যে হেতু ডিরেক্টর হিসেবে ওই দু’জনের কোনও কার্যকরী ভূমিকা ছিল না, তাই তাঁদের নাম তদন্তের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। বিধাননগরের গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষের দাবি, ইডি-র এই গ্রেফতারি অন্ধকারে পথ হাতড়ানোর সামিল। তাঁর মতে, পিয়ালি বা শুভজিৎ সারদার বিভিন্ন সংস্থার কাগুজে ডিরেক্টর ছিলেন।

যে ভাবে সুদীপ্ত সেনের রাঁধুনিও বিভিন্ন সংস্থার ডিরেক্টর ছিলেন। সংস্থার দৈনন্দিন কাজকমের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ ছিল না। সেই কারণে তদন্তের সময় বেশ কয়েক বার পিয়ালি, শুভজিৎকে জেরা করা হলেও তাঁদের গ্রেফতার করার প্রয়োজন হয়নি।

কিন্তু পুলিশের এই যুক্তি মানতে রাজি হননি ইডি-র তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, সারদার টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়েছে, তা খুঁজে বের করতে স্ত্রী-পুত্রের দেওয়া তথ্য প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

পিয়ালির দেওয়া তথ্য এবং ইডির নিজস্ব তদন্তে উঠে আসা বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নিতে শুক্রবার দিল্লি থেকে ইডি-র উচ্চপদস্থ কর্তাদের একটি তদন্তকারী দল কলকাতায় এসে পৌঁছেছে। এই দলে রয়েছেন ইডির জয়েন্ট ডিরেক্টর পদের এক অফিসার।

সারদা-কাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়া বিভিন্ন ব্যক্তিকে ওই বিশেষ তদন্তকারীরা ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলে জানিয়েছেন ইডি-র অফিসাররা।


ক্লিক করুন...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ed mamata banerjee Saradha chit fund scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE