Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

একই লোক দু’বার ধৃত, ক্ষুব্ধ বিচারক

যে ব্যক্তিকে মঙ্গলবার রাতে ধরা হল এবং আদালত তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল, তাকেই ফের গ্রেফতার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার আদালতে তুলল বীরভূমের পাড়ুই থানার পুলিশ। শুধু তাই নয়, ফের সেই ধৃতকে পুলিশি হেফাজতে রাখার আবেদনও জানাল! এই ঘটনার জেরে বীরভূমের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের (সিজেএম) তীব্র ভর্ত্‌সনার মুখে পড়তে হল পাড়ুই থানার ওসি-কে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বিচারকের সমালোচনা হজম করলেন ওসি। বৃহস্পতিবার সিউড়ি আদালত চত্বর দিনভর সরগরম রইল এই ঘটনা ঘিরে। আবারও প্রশ্নের মুখে পড়ল বীরভূম জেলা পুলিশের ভূমিকা।

সিউড়ি আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন ধৃত আলি জিন্না।

সিউড়ি আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন ধৃত আলি জিন্না।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৪ ০২:১০
Share: Save:

যে ব্যক্তিকে মঙ্গলবার রাতে ধরা হল এবং আদালত তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল, তাকেই ফের গ্রেফতার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার আদালতে তুলল বীরভূমের পাড়ুই থানার পুলিশ। শুধু তাই নয়, ফের সেই ধৃতকে পুলিশি হেফাজতে রাখার আবেদনও জানাল!

এই ঘটনার জেরে বীরভূমের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের (সিজেএম) তীব্র ভর্ত্‌সনার মুখে পড়তে হল পাড়ুই থানার ওসি-কে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বিচারকের সমালোচনা হজম করলেন ওসি। বৃহস্পতিবার সিউড়ি আদালত চত্বর দিনভর সরগরম রইল এই ঘটনা ঘিরে। আবারও প্রশ্নের মুখে পড়ল বীরভূম জেলা পুলিশের ভূমিকা।

কে, কবে, কেন ধৃত

ধৃতের নাম আলি জিন্না। বাড়ি পাড়ুই থানার ভগবতী বাজার। মাখড়া গ্রামে সোমবার বিজেপি-তৃণমূল সংঘষের্র ঘটনায় চারটি এফআইআর হয়েছে পাড়ুই থানায়। তার একটির ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে পুলিশ বাড়ি থেকেই ধরেছিল তৃণমূল কর্মী হিসাবে পরিচিত জিন্নাকে।

সিজেএম ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায় আলি-সহ ধৃত ১০ জনকে পাঁচ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। সেই আলিকেই ফের গ্রেফতার দেখিয়ে (পুলিশের স্বতঃপ্রণোদিত মামলায়) বৃহস্পতিবার সিজেএমের এজলাসে তোলে পুলিশ। পুলিশের এই ‘ভুল’-এর ব্যাপারে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী।

‘ভুলের’ ফল কী হল

৪৫ মিনিটের মধ্যে পাড়ুই থানার ওসি এবং অ্যারেস্টিং অফিসারকে এজলাসে এসে জবাবদিহি করার নির্দেশ দেন সিজেএম। ওসি কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর পরে বিচারক তাঁর উদ্দেশে বলেন, “পুলিশ রিমান্ড চেয়ে যে ফরওয়ার্ডিং লেটার পাঠিয়েছেন, তাতে আপনি সই করেননি? সই করার আগে তা পড়ে দেখেননি? যে লোকটা আপনার হেফাজতেই রয়েছে, তাকে আবার নিজের হেফাজতে চাইছেন!”

নিছক ভুল নাকি ইচ্ছাকৃত

জেলার এক পুলিশকর্তার দাবি, “পাড়ুই থানার এক কর্মী এত বড় ভুল করেছেন। তার খেসারত দিয়েছেন ওসি!” কিন্তু, ওসি কেন সই করে দিলেন ফরওয়ার্ডিং লেটারে, তার সদুত্তর মেলেনি। জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, কী ভাবে ওই ভুল হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই পুলিশকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।

নিয়ম কী

ফৌজদারি কার্যবিধি বা সিআরপিসি-র ১৬৭(৫) ধারা এবং সুপ্রিম কোর্টে ২০০৩-এর নির্দেশ অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর অ্যারেস্ট মেমো ঘটনাস্থলেই লিখতে হয়। সেখানে গ্রেফতারির তারিখ, সময় ও স্থান লেখা আবশ্যিক। ধৃতের পরিজন বা স্থানীয় কাউকে সাক্ষী করে সই করাতে হয়। ঘটনাস্থলেই নথির প্রতিলিপি হয় পরিজন বা ধৃতকে দিতে হয়।

প্রশ্ন, জিন্নাকে মঙ্গলবার রাতেই ‘অ্যারেস্ট’ দেখিয়ে হাজতে নেওয়া হয়। তাদের হাজতে থাকাকালীন একই লোককে ফের কী ভাবে গ্রেফতার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার কোর্টে তোলা হল?

কী বলছেন বিশেষজ্ঞেরা

সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “পুলিশ যে মিথ্যা কথা বলছে, এটা প্রমাণিত। পুলিশ শাসক দলের দাসানুদাসের মতো আচরণ করছে।” কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। পুলিশ নিজের বুদ্ধির বদলে অন্য কারও কথা শুনছে। পুলিশ আইনের চাকর। অন্য কারও নয়!”

“আইনটা আপনারা জানেন না, মানেনও না”

• ঘটনাস্থল: সিউড়ি আদালতে মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়ের এজলাস।

• সময়: বৃহস্পতিবার দুপুর ২টো।

• মামলা: মাখড়া-কাণ্ড।

• উপস্থিত: সরকারি আইনজীবী কুন্তল চট্টোপাধ্যায়, অভিযুক্ত আলি জিন্না (এই আদালতই তাকে বুধবার মাখড়া-কাণ্ডে পুলিশ হেফাজতে পাঠায়) এবং অভিযুক্তের আইনজীবী মলয় মুখোপাধ্যায় (তৃণমূলের বীরভূম জেলা সহ-সভাপতি)।

মলয়বাবু: বুধবারই জিন্নাকে আদালত ৫ দিনের পুলিশি হেফাজতে নিয়েছে। এর পরেও পুলিশ কোন আইনে ওই একই ব্যক্তিকে গ্রেফতার দেখিয়ে ফের নিজের হেফাজতে চাইছে?

বিচারক চট্টোপাধ্যায়: গ্রস মিসটেক! মিস ইউজ অব পাওয়ার! এত বড় ঘটনা কী করে ঘটাল পুলিশ?

বিচারক চট্টোপাধ্যায় (সরকারি আইনজীবীকে উদ্দেশ করে): পাড়ুই থানা থেকে সিউড়ি আসতে কত ক্ষণ সময় লাগে?

সরকারি আইনজীবী: তিরিশ মিনিট।

বিচারক: ওসি এবং অ্যারেস্টিং অফিসারকে ৪৫ মিনিটের মধ্যে আসতে বলুন। তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে।

(বেলা সাড়ে ৩টে। পাড়ুই থানার ওসি কার্তিকমোহন ঘোষ এবং অ্যারেস্টিং অফিসার এসআই ধ্রুবজ্যোতি দত্ত এলেন আদালতে)

বিচারক: পাড়ুই থানার ওসি কে?

(ওসি টুপি খুলে কাঠগড়ায় গিয়ে উঠলেন)

বিচারক: কেন এমন করলেন?

(নিচু স্বরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন ওসি। শোনা যায় না।)

বিচারক (ধমক দিয়ে): আপনারা এ বার থেকে আর ‘ল অ্যান্ড অর্ডারে’র কথা বলবেন না। বলবেন কেবল, অর্ডার! আইনটা আপনারা জানেন না। মানেনও না।

ওসি (নিচু স্বরে): স্যার, ভুল হয়ে গিয়েছে।

বিচারক (ফের ধমকে): এটা ভুল নয়। এটা মিথ্যা। আপনারা আদালতকে মিথ্যা কথা বলেছেন। যে ব্যক্তি ইতিমধ্যেই পুলিশ হাজতে রয়েছেন, তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার দেখালেন কী ভাবে?

(ওসি কিছু বলতে চাইছিলেন। তাঁকে থামিয়ে দেন বিচারক)

বিচারক: টু প্লাস টু সিক্স লিখলে, সেটাকে ভুল বলা চলে। কিন্তু টু প্লাস টু কেউ যদি শেক্সপিয়র লেখে, তা হলে সেটা ভুল নয়।

ওসি: স্যার ভুল হয়ে গিয়েছে।

আসলে আমাদের অন্য একটি মামলাতেও ওই ব্যক্তি অভিযুক্ত। এ দিন ভুল করে সেই মামলাতেই তাকে তোলা হয়েছে।

বিচারক: পুলিশ রিমান্ড চেয়ে যে ফরোয়ার্ডিং লেটারটি পাঠিয়েছেন, তাতে আপনি সই করেননি? আপনি সই করার আগে তা পড়ে দেখেননি? যে লোকটা আপনার হেফাজতে রয়েছে, তাকেই আবার নিজের হেফাজতে চাইছেন?

(বিচারকের নজর পড়ে কাঠগড়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যারেস্টিং অফিসারের উপরে)

বিচারক: আপনি তখন কী করছিলেন? কী করে লিখলেন ওই ব্যক্তিকে আজ তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছেন?

(অ্যারেস্টিং অফিসার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বলা হল না।)

বিচারক: আপনি থামুন। ওসিকেই জিজ্ঞেস করি। ওসি আমি এখন এই লোকটিকে নিয়ে কী করব? আমি কি এর জামিন মঞ্জুর করে দেব? নাকি জেল হাজতে পাঠাব?

(ওসি আর অ্যারেস্টিং অফিসার নিরুত্তর থাকেন।)

বিচারক: যদি ওই ব্যক্তিকে পুলিশ হেফাজতে পাঠাই, তা হলে আমাকে আপনাদের মিথ্যার উপরে ভুল নির্দেশ দিতে হবে!

বিচারক (ওসি-কে উদ্দেশ করে): এঁকে (জিন্না) জামিন দিলে, আগের দিন যে ব্যক্তিকে হেফাজতে নিয়েছেন, তাঁকে নির্ধারিত দিনে হাজির করবেন কী করে? যদি জেল হাজতেই দিই, তা হলে মামলার তদন্তকারী অফিসারই বা নির্ধারিত দিনে এসে আদালতকে কী জবাব দেবেন?

বিচারক (সরকারি আইনজীবীকে উদ্দেশ করে): আপনি বলুন, আমি এ বার কী করব?

সরকারি আইনজীবী: পুলিশ কী করেছে, তার কিছুই আমাকে জানায়নি। আমাকে যদি পুলিশ সঠিক তথ্য না দেয়, তা হলে আমিই বা কী করব! ফল ভোগ করতে হবে।

বিচারক (অভিযুক্তের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে): আপনি কি কিছু বলতে চান?

অভিযুক্তের আইনজীবী: স্যার, আমি প্রথম থেকেই বলছি, পুলিশ নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে যা ইচ্ছে তা-ই করছে। যাকে তাকে ধরছে। এ দিনের ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।

বিচারক (ওসি-কে উদ্দেশ করে): আপনাদের এই কাণ্ডকারখানার কথা এসপি জানেন?

ওসি (ঘাড় নেড়ে): এসপি-ই আমাকে এখানে আসতে বলেছেন।

বিচারক: আপনাদের এখানে আসতেই হতো। এসপি কোনও করুণা করেননি। না এলে আপনাদের এখানে তুলে আনার মেশিনারি আদালতের কাছে আছে।

(আলি জিন্নার পুলিশ হেফাজতের আবেদন নামঞ্জুর করে এক দিনের জন্য জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক)

বিচারক: শুক্রবার সকালে পাড়ুই থানার ওসি, ঘটনার তদন্তকারী অফিসার এবং অ্যারেস্টিং অফিসারকে এজলাসে হাজির হয়ে কেন এমন ভুল হল, তার লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হবে। অধস্তনেরা কী কাণ্ড করছে, তা দেখার জন্য এসপি-কেও

ব্যক্তিগত হাজিরা দিতে হবে।

(আদালতের কাজ শেষ)

(প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত)

তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE