Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

কিচ্ছু জানি না, আতঙ্কে রা কাড়ছে না পাড়া

রেললাইন পিছনে রেখে বাঁক ঘুরতেই সরু পিচের রাস্তা এগিয়ে গিয়েছে মধ্যপাড়ার দিকে। সেই রাস্তাতেই দেখা মিলল পরিচিত দুই মুখের। বছরখানেক আগে দশম শ্রেণির ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের অভিযোগের পরে প্রতিবাদ মিছিলে দেখা দুই মুখ।

ধূপগুড়ি থানায় স্মারকলিপি সিপিএমের। নিজস্ব চিত্র।

ধূপগুড়ি থানায় স্মারকলিপি সিপিএমের। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ধূপগুড়ি শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০২:৪১
Share: Save:

রেললাইন পিছনে রেখে বাঁক ঘুরতেই সরু পিচের রাস্তা এগিয়ে গিয়েছে মধ্যপাড়ার দিকে।

সেই রাস্তাতেই দেখা মিলল পরিচিত দুই মুখের। বছরখানেক আগে দশম শ্রেণির ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের অভিযোগের পরে প্রতিবাদ মিছিলে দেখা দুই মুখ। সেই প্রতিবাদী ছাত্রীর বাবা এবং মামাকে শনিবার দুপুরে পুলিশ প্রধান সাক্ষীকে খুনের মামলায় গ্রেফতার করেছে! সে খবর অবশ্য জানেন বলে দাবি করলেন দু’জনেই। তবে এ দিন বিকেলের বছরখানেক আগের প্রতিবাদ মিছিলের কথা যেন মনেই করতে পারলেন না দু’জন! সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলেই, উত্তর মিলল ‘‘দোহাই দাদা! আমরা কিছু জানি না। কোনও মিছিলেও হাঁটিনি। আমাদের বাঁচতে দিন। আমরা জেলে যেতে চাই না।’’

মেয়েকে গণধর্ষণের পরে খুন করা হয়েছে বলে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যিনি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, পাল্টা খুনের মামলায় তাঁকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই ধূপগুড়ির মধ্যপাড়া সহ লাগোয়া এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কে, কে, কী ভাবে, কাকে, কাকে ফাঁসালেন তা নিয়ে কত কানাকানি চলছে ভাবা যায় না। বাতাসে ভাসছে একাধিক নেতার নাম। কিন্তু, কথা বলতে গেলেই চকিতে যেন চারদিক সুনসান। মুখে কুলুপ এঁটেছেন অনেকেই। এমনকী, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে রেল লাইনের পাশে এলাকার দশম শ্রেণির মেয়েটির বিবস্ত্র ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হওয়ার পরে যে মুখগুলি প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন তাঁদের অনেকে ভীত-সন্ত্রস্ত। এ দিন দুপুরের পরে অনেকের চেহারা তা-ই যেন বলল।

কেন এমন হল? কয়েকজন ফিসফিস করে জানালেন, ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের মামলায় প্রধান সাক্ষী হয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা নিতাই সিংহরায়। আদালতে দেওয়া বয়ানে নিতাইবাবু দাবি করেছিলেন, গত বছরের ১ সেপ্টেম্বরে পাকা রাস্তায় বাতিস্তম্ভের নীচে সালিশি সভা বসেছিল। সেই সভায় বাবাকে মারধরের প্রতিবাদ করে ছাত্রীটি। তখনই ছাত্রীকে ‘আরও কয়েকজন মিলে চুলির মুঠি ধরে মারতে থাকে এবং থুতু ফেলে চাটতে বলতে থাকে।’ এর পরেই ছাত্রীটি সভাস্থল থেকে থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় বলে আদালতে লিখিত বয়ান দেন নিতাইবাবু। গত ২ নভেম্বর এলাকার একটি ঝোপের পাশ থেকে নিতাইবাবুর দেহ উদ্ধার হয়। অভিযোগে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রীর বাবা-মামা সহ অন্যদের নাম। সেই মামলাতেই এ দিন সকালে থানায় ডেকে পুলিশ ছাত্রীর বাবা-মামাকে গ্রেফতার করে। তার পরেই চেপে বসেছে আতঙ্ক।

অভিযোগ ওঠে, ছাত্রীকে গণধর্ষণ, খুনের মামলাটি ভেস্তে দিতেই প্রধান সাক্ষীকে খুন করা হয়। প্রধান সাক্ষী খুন হলে অভিযুক্তদের দিকেই আঙুল উঠতে পারে বলে চাপ দিয়ে উল্টে ছাত্রীর পরিবারের সদস্যদের নামেই অভিযোগ দায়ের করানো হয় বলে অভিযোগ। ছাত্রী খুনের মামলায় অভিযুক্তরা সকলেই তৃণমূলের নেতা-সমর্থক হওয়ায়, পুরো ঘটনার নেপথ্যে শাসকদলের নেতারাই জড়িত রয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, নিতাইবাবুর দেহ উদ্ধারের পরে শাসক দলের বড় ছোট নেতারা মুখ না খোলার হুমকিও দিয়েছে।

নিতাইবাবুর দেহ উদ্ধারের পরে মধ্যপাড়া এলাকায় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরও ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়, সাংবাদিকদের দিকে তেড়েও যায় বেশ কয়েকজন। ধৃতের পরিবারের এক সদস্যের অভিযোগ, ‘‘গত এক বছর ধরে ক্রমাগত হুমকি পেয়েছি। আমাদেরই জেলে পুরে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হল। এ দিন সেই হুমকি সত্যি হল।’’

শনিবার দুপুরের পরে এলাকায় তৃণমূল নেতাদের কাউকে দেখা যায়নি। তবে বাসিন্দাদের মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট দেখা গিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছাত্রী মৃত্যুর পরে একটি মিছিলে সামিল হয়েছিলেন বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী। এ দিন তাঁদের কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া, ‘‘মামলার প্রধান সাক্ষীকে খুন হয়ে যাওয়া মেয়ের বাবা খুন করতে পারে! পুলিশ আমাদের কী মনে করে?’’ এর পরেই তাঁদের সংযোজন, ‘‘দয়া করে, আমার নাম কিন্তু লিখবেন না।’’ ধূপগুড়ি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান তথা তৃণমূল নেতা অরূপ দে-র দাবি, ‘‘পুলিশ তদন্তের স্বার্থে কোনও পদক্ষেপ করেছে। এরসঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। এলাকায় কোনও আতঙ্কও নেই।’’

এ দিন বিকেলে সিপিএমের তরফে প্রতিবাদ মিছিল করে থানায় গিয়ে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। ছাত্রী খুনের পরে গঠিত ধূপগুড়ি প্রতিবাদী নাগরিক মঞ্চের তরফেও স্মারকলিপি দেওয়া হয়। প্রতিবাদী মঞ্চের মিছিলে এ দিনর ভিড় অবশ্য বেশি ছিল না। মঞ্চের দাবি, আতঙ্ক চেপে বসাতেই প্রতিবাদে সামিল হতে ভয় পাচ্ছেন বাসিন্দারা। মঞ্চের তরফে নজরুল হক বলেন, ‘‘এ রাজ্যে যেই প্রতিবাদী তাকে হয় খুন করা হচ্ছে, না হলে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE